
মাশরাফি বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহীম, তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও মুমিনুল হক- সাম্প্রতিক সময়ে তিন ফরমাটে বাংলাদেশের ছয় অধিনায়ক। সবাইকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। সাকিব, মুশফিক, মুমিনুল তার ছাত্র। বিকেএসপিতে অন্য শিক্ষকদের পাশাপাশি সালাউদ্দিন স্যারের সান্নিধ্য পেয়েছেন সাকিব, মুশফিক ও মুমিনুল।
এর বাইরে তামিম ইকবালও সালাউদ্দিন স্যারের সান্নিধ্যেই থাকেন। জাতীয় দলের কোচিং স্টাফের বাইরে তার ব্যক্তিগত পর্যায়ের কোচিংটা সালাউদ্দিন স্যারের সঙ্গেই। এছাড়া জাতীয় দলের কোচিং প্যানেলে কাজ করার সময় আর সবার মত ঐ ৬ জনকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। ক্লাব ক্রিকেট এবং বিপিএলেও কমবেশি সবার সঙ্গে কাজ করেছেন।
সব মিলে মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ ও মুমিনুল সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে কোচ সালাউদ্দিনের। তাদের কে কেমন অধিনায়ক?- তা খুব ভাল জানা। বুধবার রাতে ক্রিকফ্রেঞ্জির ফেসবুক লাইভে সে কথা গুলোই জানিয়েছেন কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন।
আসুন শোনা যাক, তার চোখে কে কেমন অধিনায়ক?
আবেগতাড়িৎ না হয়ে যুক্তি দিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে সাকিব
সাকিব মাঠে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ভাল না মন্দ, সঠিক না ভুল?- তা নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে সাকিব যতটা সম্ভব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। পরে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে সে চিন্তা করবে না, একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিবে। এটাও একটা বড় গুণ। সাকিব আক্রমণাত্মক অধিনায়ক, একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আছে তার। আবেগ দিয়ে না দেখে ক্রিকেটীয় যুক্তিটাই তার কাছে প্রাধান্য পায়। মাঠের ভেতরে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আছে সাকিবের। আমার চোখে এটাই তার অন্যতম স্বাতন্ত্র।
মাশরাফি ক্রিকেটারদের অন্যরকম আস্থা ও নির্ভরতা
সবমিলিয়ে খেলোয়াড়দের মাঠ ও মাঠের বাইরে আগলে রাখার ক্ষমতাটা অনেক ভাল। ক্রিকেটারদের একটা অন্যরকম আস্থা ও নির্ভরতা সে। প্লেয়াররা তাকে ভাবে বড় ভাই এবং সবার মাথার ওপরে একটা ছাতার মত আছে। ক্রিকেটারদের ভাল জানা, মাশরাফি ভাই তার জন্য টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে ফাইট করবে, তার ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখবে।
এ কারণে সবাই মাশরাফিকে পছন্দ করে। প্রতিটি খেলোয়াড় তাকে ভালবাসে। এই কোয়ালিটিই মাশরাফির বড় বিষয়। যা বাকিদের চেয়ে তাকে আলাদা করে দিয়েছে। আর একটি বড় বিষয় হলো সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ- সবাই প্রায় কাছাকাছি বয়সের। মাশরাফি তাদের চেয়ে কয়েক বছরের বড়। কাজেই একটা শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি হয়ে গেছে। এটা অধিনায়ক মাশরাফির বাড়তি সুবিধা।
মুশফিক সাজানো গোছানো পরিকল্পনা করে আগাতে চায়
মুশফিক টিম ডিসিপ্লিন থেকে শুরু করে সাজানো গোছানো পরিকল্পনা নিয়ে যেতে চায়, প্ল্যান করে আগাতে চায়। প্ল্যানের বাইরে যেতে চায় না। যে লক্ষ্য ও পরিকল্পনা আঁটা হয় সেটাই করতে চায়। টিমের ডিসিপ্লিনের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস থাকে। দলের সবাইকে একতাবদ্ধ রাখতে তার চেষ্টাও থাকে বেশ। তবে মাঠে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে তাকে আরও একটু সৃজনশীল হতে হবে। মাঠের সিদ্ধান্তগুলো যদি আরও একটু ইনোভেটিভ হয়, তাহলে অধিনায়ক মুশফিক আরও ভাল করবে।
আগে সিদ্ধান্ত ভুল হলে অস্থির হয়ে যেত, এখন অনেকটাই শান্ত ও কৌশলী তামিম
যেকোন টুর্নামেন্ট শুরুর আগে পুরো দলকে এক সুঁতোয় গেথে রাখার কাজটি তামিম খুব ভালভাবে করতে পারে। দলের সম্প্রীতি ও ঐক্য বাড়াতে তার নিজস্ব কিছু চিন্তাভাবনা থাকে। কিভাবে দলকে চাঙা ও ফুরফুরে রাখতে হয়, সেটাও খুব ভাল জানা তামিমের।
খেলার বাইরের কাজ যেমন বাইরে ঘুরতে যাওয়া, লাঞ্চ-ডিনারে বহর ধরে খেতে যাওয়া খুব ভাল পারে। কোন সময় কোন ক্রিকেটারকে কীভাবে অনুপ্রাণিত করতে হবে, সে কাজটিও খুব ভাল করতে পারে। সবাইকে এক রাখার জন্য্য যা যা করা দরকার সে তা পারে। মাঠের ভেতরে প্রথম দিকে খুব ভাল ছিল না। মনে হয় একটু অস্থির চিত্তের ছিল, মাথা গরম হয়ে যেত। এখন সে থিতু হয়েছে, মাথা ঠান্ডা থাকে।
একদিন বিপিএলে মোহাম্মদ নাবী বল করছিল, সে মাঠের বাইরে আমাকে সিগন্যাল দিয়ে জানতে চাইল কে বল করবে? আমি নাবীর কথা বললাম। কিন্তু নাবী ঐ ওভারে ২২-২৩ রান দিয়ে দিয়ে ফেলেছিল। তামিম আমার ওপর এমন রাগ হয়েছে যে কথাই বলবে না। পরের ম্যাচে গিয়ে দেখা গেছে আমার ডিসিশনটাই রাইট। এখন তামিমকে বলতে হয় না, নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ম্যানেজমেন্ট পাওয়ারও বেড়েছে, ট্যাকটিসটাও ভাল রপ্ত করেছে। আগে একটা সিদ্ধান্ত ক্লিক না করলে অনেক উত্তেজিত হয়ে যেত, এখন অনেক শান্ত। আমার মনে হয় অধিনায়ক হিসেবে তামিমের সামনে ভাল করার বেশ সম্ভাবনা আছে।
মাহমুদউল্লার শেষ ওভারে বোলিং করতে আসাটা ভাল লাগে
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের সঙ্গে আমি আসলে তেমন কাজ করিনি। যখনই দেখেছি রিয়াদ খুলনায়, তখনই দেখেছি খুলনাকে খুব স্পিরিটেড দল। রিয়াদ থাকলেই খুলনাকে অন্যরকম দল হিসেবে দেখা গেছে। তার খেলার শেষ ওভারে বল করতে আসার একটা প্রবণতা আছে। এটা আমার ভাল লাগে। অনেক ম্যাচে দেখা গেছে শেষ ওভারে রিয়াদ বল করতে এসেছে। কখনও সফল হয়েছে, কখনও হয়তো হয়নি। তারপরও আমার মনে হয় এটাও অনেক বড় গুণ।
অধিনায়ক মুমিনুলকে আরও সময় দেয়া দরকার
মুমিনুলের তো মাত্র শুরু। তার সঙ্গে অনেকগুলো সিনিয়র ক্রিকেটার আছে। সে গিয়েই সব নিয়ন্ত্রণ করে ফেলবে এমন নয়, চাইলেও হবে না। অধিনায়ক মুমিনুলকে একটু সময় দিতে হবে। এখন সময়ের প্রবাহতায় মনে হচ্ছে ইম্প্রুভড। আস্তে আস্তে দুই তিনটি সিরিজ যাবে, তখন আরও অনেক কিছু শিখে যাবে। আসলে কেউ তো আর জন্ম থেকে শিখে আসে না। লিডারশিপ কোয়ালিটি সবার আগে আসে না। কেউ একটু কম বয়সেই নেতৃত্বগুণ পায়। আবার কারও সে গুণ আসে দেরিতে।
সবচেয়ে বড় কথা অধিনায়ক যখন নিয়মিত ভাল পারফরম করবে, তখন অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। মুমিনুলও নিয়মিত রান করলে দেখবেন তার দল পরিচালনা আপনাআপনি ভাল হয়ে যাবে। আসলে যখন সে পারফরম করবে, যে যত বড় অধিনায়কই হোন না কেন দল না জেতাতে পারলে তার কোন মূল্য নেই। যখন টিম হারে তখনই সমস্যা হয়। আর অধিনায়ক যদি ভাল পারফরম করতে থাকে, তখন দল হারলেও সে টিমের কন্ট্রোল নিতে পারে। তাই মুমিনুল সম্পর্কে আমার শেষ কথা হলো, সে যদি ভাল অধিনায়ক হতে চায় তাহলে আগে তাকে ভাল পারফরম করতে হবে।