logo
আপডেট : ১০ জুলাই, ২০২০ ০৮:২৪
টক শো ও হাসপাতাল ব্যবসা সাহেদের অপকর্মের পুঁজি
নিজস্ব প্রতিবেদক

টক শো ও হাসপাতাল ব্যবসা সাহেদের অপকর্মের পুঁজি

রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ‘হাত’ করতে ব্যবহার করেছিলেন টক শো আর হাসপাতাল ব্যবসা। হাসপাতালে র‌্যাবের অভিযান শুরুর পর তিনি প্রভাবশালীদের কারও কারও কাছে ফোনও করেন। গতকাল বুধবার পর্যন্ত তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছেন। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার আছেন রিজেন্ট গ্রুপ ও হাসপাতালের বেতনভোগী সাত খুদে কর্মকর্তা ও কর্মচারী।

সাহেদের সঙ্গে ছবি আছে বা যোগাযোগ ছিল এমন চার–পাঁচজনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁদের প্রত্যেকের কাছেই প্রশ্ন ছিল, মো. সাহেদকে তাঁরা কীভাবে চেনেন। তাঁরা বলেছেন, তিনি টক শোর পরিচিত মুখ। তাঁদের কাছে গিয়ে তিনি নিজেই বলেছেন, কোভিড–১৯–এর চিকিৎসায় দুটি হাসপাতাল ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁরা স্বচ্ছন্দে রোগী পাঠাতে পারেন। গণমাধ্যমে উপস্থিতি ও জোরালো বক্তব্য দেওয়ায় অনেকেই তাঁকে ‘খাঁটি’ লোক ভেবেছিলেন। তাঁরা রোগীও পাঠিয়েছেন। কোনো কোনো সংবাদকর্মী তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাসও দিয়েছেন। এই পরিচয়ের আড়ালে তিনি তাঁর প্রতারণার ব্যবসা চালিয়ে গেছেন।


স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাহেদ করিম বেশ কয়েকবার সচিবালয়ে গেছেন। একদিন বললেন, তিনি দুটো হাসপাতাল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। রোগী থাকলে যেন পাঠাই। আমি সেখানে রোগী পাঠিয়েছি। একজন ইন্তেকাল করেছেন, বাকিরা সেরে উঠেছেন।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, করোনা মহামারির আগে তিনি সাহেদ করিমকে চিনতেন না। র‌্যাবের অভিযানের পর সাহেদ করিম তাঁকে ফোন করেছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর কিছু করার নেই।


সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ছবি আছে সাহেদের। কত দিন ধরে তিনি সাহেদকে চেনেন, এ বিষয়ে জানতে চেয়ে খুদে বার্তা দিলেও তিনি সাড়া দেননি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সাহেদ করিমকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না। কেউ কখনো ছবি তুলতে চাইলে তিনি না করেন না। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।

তবে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির প্রথম আলোকে বলেছেন, সাহেদ করিম মাঝে মাঝে আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির বৈঠকে আসতেন। তিনি সাবেক একটি কমিটির সদস্য ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কমিটির বৈঠকে দু–চারবার দেখা হয়েছে। আর দেখা হয়েছে টিভির টক শোতে। মোহাম্মদ জমির বলেন, ‘মোহনা টিভিতে আমি টক শোতে গিয়েছি কয়েকবার। সেখানে সাহেদ করিম সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলেন।’

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক শহীদুল হকের কার্যালয়ে একসময় সাহেদের যাতায়াত ছিল। গতকাল শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সাহেদ করিম একবার তাঁর কার্যালয়ে এসেছিলেন। তাঁর হাসপাতালের নামে একটা মামলা হয়েছিল সেটার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার তদবির নিয়ে। ওই সময়ে সাহেদ তাঁকে বলেছিলেন, তিনি ক্যানসারের রোগী। সন্তান ছোট। এরপর বিভিন্ন সময় তিনি ফোন করেছেন। তবে সাহেদ করিমকে তিনি চিনতেন টক শোর কারণে।

 

সাহেদ আওয়ামী লীগে কীভাবে

যুবদলের একজন কর্মী প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের জুনে তিনি উত্তরায় রিজেন্ট কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। সে সময় সাহেদ করিম তাঁর সামনেই স্কাইপেতে তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর সঙ্গে গিয়াসউদ্দিন আল মামুনেরও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।

রিজেন্ট গ্রুপের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, সাহেদ আত্রাই নদ ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ করেছেন। কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপ ও কক্সবাজারে সাইক্লোন শেল্টার ও প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কাজেও তিনি যুক্ত আছেন।

বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, দলের সঙ্গে সাহেদ করিমের যোগাযোগ ছিল না। তবে তাঁদের দলের কোনো কোনো নেতার সঙ্গে উঠবস ছিল বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। তাঁরা আরও বলেছেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন সুবিধাভোগী ও বিতর্কিত লোকজনের সঙ্গে সাহেদ যোগাযোগ করতেন।

আওয়ামী লীগ সূত্রগুলো বলছে, ২০১৫ সালের আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সাহেদ করিমের কোনো উপস্থিতি ছিল না। ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন তিনি। ওই বছরের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২০১৭ সালেআন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য হন। তবে গত ডিসেম্বরে ২১তম সম্মেলনের পর নতুন উপকমিটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। প্রস্তাবিত নতুন কমিটিতে তাঁকে রাখা হয়নি বলে নিশ্চিত করেন উপকমিটির দুই শীর্ষস্থানীয় নেতা।

দলের একাধিক নেতা জানান, আওয়ামী লীগের উপকমিটি নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। এই কমিটির সদস্যদের সবার চিঠিও থাকে না। তাই কমিটির চেয়ারম্যান ও সদস্যসচিবের সম্মতি নিয়ে কেউ কেউ সদস্য হিসেবে কাজ করেন।

 

গ্রেপ্তার সাতজন রিমান্ডে

করোনা পরীক্ষা না করেই সনদ দেওয়াসহ নানা অভিযোগে গ্রেপ্তার রিজেন্ট হাসপাতালের সাতজনকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। রাজধানীর উত্তরা থানা পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত গতকাল এই আদেশ দেন। এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া আটজনকে আদালতে হাজির করা হয়। একজন আসামি কিশোর হওয়ায় তাকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়নি।

রিমান্ডে নেওয়া সাত আসামি হলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা আহসান হাবীব, হেলথ টেকনিশিয়ান আহসান হাবীব হাসান, হেলথ টেকনোলজিস্ট হাতিম আলী, রিজেন্ট গ্রুপের প্রকল্প প্রশাসক রাকিবুল ইসলাম, মানবসম্পদ কর্মকর্তা অমিত বনিক, নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুর রশীদ খান ও গাড়িচালক আবদুস সালাম।

রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে প্রধান আসামি করে ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে উত্তরা পশ্চিম থানায় এই মামলা করে র‌্যাব।

 

রিজেন্টের মিরপুর শাখাও সিলগালা

সরকারের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করে করোনা রোগীদের কাছ থেকে বিল আদায় এবং করোনার ভুয়া প্রতিবেদন তৈরি করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়সহ বিভিন্ন অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর শাখা গতকাল বুধবার সিলগালা করে দিয়েছেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর আগে মঙ্গলবার একই অভিযোগে হাসপাতালটির উত্তরা শাখা ও চেয়ারম্যানের কার্যালয়ও বন্ধ করে দেয় র‌্যাব।

সোমবার অভিযান চলার সময় র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তিন ধরনের অভিযোগ ও অপরাধের প্রমাণ তাঁরা পেয়েছেন। প্রথমত, তারা করোনার নমুনা পরীক্ষা না করে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করত। এ ধরনের ১৪টি অভিযোগ র‌্যাবের কাছে জমা পড়ে, যার পরিপ্রেক্ষিতে এই অভিযান। দ্বিতীয়ত, হাসপাতালটির সঙ্গে সরকারের চুক্তি ছিল ভর্তি রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার। সরকার এই ব্যয় বহন করবে। কিন্তু তারা রোগীপ্রতি লক্ষাধিক টাকা বিল আদায় করেছে। পাশাপাশি রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে এই মর্মে সরকারের কাছে ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকার বেশি বিল জমা দেয়।

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো