logo
আপডেট : ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০৯:১৭
ছড়াকার তাছাদ্দুক হোসেন ও তার ছড়াগ্রন্থ 'লবডঙ্কা।'
মো. রফিকুল ইসলাম

ছড়াকার তাছাদ্দুক হোসেন ও তার ছড়াগ্রন্থ 
'লবডঙ্কা।'


হাতে পেলাম ছড়াকার তাছাদ্দুক হোসেনের ছড়ার বই 'লবডঙ্কা।'  বইটি ছড়াকার নিজে আমার হাতে তুলে দেয়ায় অসংখ্য ধন্যবাদ ছড়াকারকে। এ সময়ের একজন  প্রতিশ্রুতিবান ছড়াকার তাছাদ্দুক হোসেন। তিনি লিখেন,অনবরত লিখেন, বিরামহীন লিখেন, অবলীলায় লিখেন। যাকে বলা যায় স্বভাবছড়াকার। যে কোনো বিষয়কে তিনি তার ছড়ায় তুলে আনেন অসাধারণ দক্ষতায়। শুধু ছড়া নয়, কবিতা এবং গান রচনায়ও  সমান পারদর্শী।  তবে ছড়াকার হিসেবে পরিচয় দিতেই তিনি আত্মতৃপ্তি বোধ করেন বেশি। তার অবশ্য কারণও আছে যথেষ্ট। আধুনিক ছড়ার মূলমন্ত্র যে তার নখদর্পনে। তাই ছড়ার বিচিত্র আঙ্গিকে ছন্দের নিপুণ খেলায় মেতে ওঠেন তিনি স্বমহিমায়। 
ছড়ার প্রাণ তার ছন্দ এবং অন্ত্যমিল। ছন্দের বিচিত্র প্রয়োগে এবং অন্তমিলের যাদুতে ছড়াকার তাছাদ্দুক হোসেনের একেকটি ছড়া
দেদীপ্যমান। 
শিশুতোষ থেকে শুরু করে প্রেম, সমাজ, রাজনীতি, রঙ্গ-ব্যঙ্গ,সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ কোনোটিই বাদ যায় নি তার লেখায়। 
ছড়াকার হিসেবে তাছাদ্দুক হোসেনের সাথে পরিচয় ঘটে আনন্দমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের একটি দেয়ালিকায় প্রকাশিত "শিল-পাটা সমাচার " ছড়াটির মধ্যে দিয়ে। 
সে দীর্ঘ দিন আগের কথা।  "শিল-পাটা সমাচার"  ছড়াটির বিষয়, ছন্দ এবং অন্ত্যমিল সবমিলিয়ে এক অসাধারণ সৃষ্টি। 
ছড়াকারের অমিত সম্ভাবনার দ্যুতি অনুভব করেছিলাম উক্ত ছড়ায়। রাজনীতি এবং সাধারণ মানুষের অবস্থার চিত্র রূপকের আশ্রয়ে  কীভাবে এ ছড়ায় ফুটে ওঠেছে  ছড়ার শেষের স্তবকটিই  তার প্রমাণ-
"শিল-পাটা ঘষাঘষি 
জমে ওঠে বেশ,
বেচারা সে মরিচের 
দফারফা শেষ। "
এরপর দীর্ঘদিন তার আর  কোন লেখা পড়া হয় নি।  ইদানিং ফেসবুকে সরব থাকায় তার লেখা পড়ার  সুযোগ আমরা পাচ্ছি। সেই সাথে পেলাম তার প্রথম প্রকাশিত ছড়ার বই
'লবডঙ্কা।' 
'লবডঙ্কা' শব্দের অর্থ হলো- ফাঁকি, শূন্য, কাঁচকলা দেখানো। বইয়ের শেষ ছড়া 'লবডঙ্কা।' এ ছড়ার নামানুসারেই বইয়ের নাম 
'লবডঙ্কা।' বিনয়ী ছড়াকার এ নামকরণের মধ্যে দিয়ে হয়তো বুঝাতে চেয়েছেন, এ বই সারশূন্য। ছড়ার বই হিসেবে তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করে না এটি। কিন্তু, আসলে কি তাই? মোটেই না। যারা বইটি পড়েছেন, নিঃসন্দেহে তারা বলবেন, এটি একটি  অসাধারণ ছড়ার বই। পাঠককে ধরে রাখার মতো যাদু আছে এতে। 
বইটি প্রকাশ করেছে বাঁধন পাবলিকেশন্স, ঢাকা। মোট আটান্নটি ছড়া রয়েছে বইটিতে।
প্রত্যেকটি ছড়াই সুখপাঠ্য।  প্রথম ছড়া 'ইচ্ছে।' শিশু থেকে শুরু করে যেকারো ভালো লাগবে লেখাটি। কারণ, উচ্ছে যে বড় বেপরোয়া।  ছড়ায়-
                              "ইচ্ছে
  মনের ভেতর দিচ্ছে নাড়া
                             দিচ্ছে
                             ইচ্ছে।
            ইচ্ছে নামের ইচ্ছে
ভীষণ রকম একরোখা সে
         ঘাড় বাঁকিয়ে নিচ্ছে।"
ভুঁইফোড় বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র উন্মোচন 
'কাণ্ড কী অদ্ভুত' ছড়ায়-
"জমির মিয়ার পুত
আসলো সেবার বিদেশ ঘুরে
শ্রমের জোরে
আনলো টাকার থলে
রোদ্দে গলে গলে...।
জমির মিয়ার পুত 
চড়লো বসে লোকের মাথায়
ফেললো যাঁতায়
লক্ষ লোকের ঘাড়
বুদ্ধিজীবীর খাতার পাতায়
নাম লেখালো তার।
'টোকাই' আমাদের সবার পরিচিত। আমাদের সমাজেরই অংশ। সেই টোকাইয়ের জীবন চিত্র ছড়ায় তুলে এনেছেন নিপুণ দক্ষতায়। টোকাই চরিত্রটির মধ্য দিয়ে তীব্র প্রতিবাদের ঝাঁকুনিও দিয়েছেন সুকৌশলে। 
" আমরা টুকাই
  টুকাই কী?
  জানতে বুঝি ইচ্ছেটা খুব 
  আচ্ছা তবে বলেই দি।
                  ... কাপড় টুকাই
  বড় লোকের থাপড়  টুকাই
  হারামি মীরজাফর টুকাই
  টপটপাটপ ঢুকিয়ে দিয়ে
  ছেঁড়া জামার পকেট ঢুকাই,
  এই এভাবেই জীবন চুকাই।
  ঘুম নিয়ে মজার ছড়া 'ঘুম।' শেষ স্তবকটি
  পড়লেই পুরু ছড়ার মাহাত্ম্য বুঝতে খুব  
  একটা অসুবিধা হয় না।
 "ঘুমের মতো আরাম কী সে!
  না ঘুমালে পাইনে দিশে
  তাইতে ঘুমে কাতরাই,
  আলসেমি কই সারাজীবন 
  ঘুমের মধ্যে সাঁতরাই।"
  যুগ যুগ ধরে যারা শোষিত, লাঞ্ছিত -
  তাদের জেগে ওঠার প্রতিবাদী কণ্ঠ 
  অবলীলায় ওঠে এসেছে ছড়ায়-
 'আদ্যিকালের পাল্টে গেছে 
  দিন
  এবার থেকে শুধতে হবে
  সাত পুরুষের 
  ঋণ।"
 [ সাত পুরুষের ঋণ ]
কতো রকমের সখই তো থাকে মানুষের। 
'কাজের কাজী' ছড়ায় এক অদ্ভুত সখের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে-
"স্যার,
 অনেক দিনের একটা সখ-ই
 মারছে বুকে পার্
 একটুখানি বসবো সোনার চেয়ারে
 একবারে ডেমকেয়ারে।"
বিজ্ঞান এবং সৌরজগতও বাদ যায় নি
ছড়ার ছন্দ থেকে। অপূর্ব ছন্দ-লয়ে মহাকাশ
জয়ের কথা-
"কল্পনা না, কল্পনা  না,
 নিরেট খাঁটি সত্যি কথা এক,
 বিশাল মহাশূন্য এখন 
 মানব জাতির হাতের মুঠোয় দেখ।"
 [ সৌরজগত ]
যুগ যুগ ধরে চাঁদের বুড়ির গল্প ছোট-বড় সবার মুখে। চাঁদের বুড়িকে নিয়ে বহু ছড়া-কবিতা লেখা হয়েছে। এখানেও ছড়াকারের হাত থেকে ফসকে যেতে পারে নি চাঁদের বুড়ি। কতো চমৎকারভাবেই না চাঁদের বুড়িকে ধরেছেন ছড়ার ফ্রেমে-
"...চাদের বুড়ি, চাঁদের বুড়ি 
  গল্পকথার নেইকো জুড়ি
  জানে হাজার কিচ্ছা,
  শুনতে পারো সন্ধ্যে হলেই
  থাকলে মনে ইচ্ছা।
  সবটা কাজেই চাঁদের বুড়ি পাক্কা
  হাতের মুঠোর মধ্যে রাখে
  জীবন নামের চাক্কা। "
[ চাক্কা ]
বন্যার ভয়াবহ রূপ নিয়ে বন্যাকে ব্যঙ্গ করতে
ছাড়েন নি ছড়াকার -
" এলোমেলো করে দিস
  পরিপাটি সংসার,
  সবচেয়ে সেরা তুই?
  কী হনু, এ ঢং ছাড়।"
  [ বন্যা ]
ঘুষ আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত। 
ঘুষ নিয়ে মজার ছড়া 'বকশিস।' অসাধারণ অন্ত্যমিল এবং ছন্দের কারুকাজে যে কারো মন কেড়ে নেবে এ ছড়া।
"...লোকে বলে ঘুষ খান
  তকি আলী তখশিশ,
  তিনি হেসে কনঃ ওটা
  ঘুষ নয় বকশিস। 
নাক নিয়ে অসাধারণ আরেকটি ছড়া 'নাক।'
নাক যে কতো রকমের, আর নাক নিয়ে এতো চমৎকার  ছড়া হতে পারে তা অবাক করার মতো। প্রথম  স্তবকেই দেখি-
"... উঁচা নাক বোঁচা নাক
    তেলে কুচকুচা নাক,
    সোজা নাক, বুঁজা নাক
    বিটকেলে গোঁজা নাক।"
বইয়ের শেষ ছড়া ' লবডঙ্কা। ' ছন্দ এবং অন্তমিলের দারুণ খেলা খেলেছেন এ ছড়ায়। ছড়ার শুরুতেই দেখি-
  " হচ্ছে একি! চক্ষে দেখি
   যা যা,
   সবটা মেকি, কাঠের ঢেঁকি 
   গিলছি, গিলেই রাজা।"
এমনিভাবে বইয়ের প্রায় প্রতিটি ছড়াই পাঠকের মন কেড়ে নেবে নির্দ্বিধায় বলা যায়।
 বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য এবং ছন্দের যাদুকরী খেলায় ছড়াকার তাছাদ্দুক হোসেনের ছড়া, ছড়াসাহিত্যের  ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। এ ক্ষেত্রে ছড়াগ্রন্থ  'লবডঙ্কা ' একটি অনন্য সংযোজন তা বলতেই পারি।