পাঁচ বছর আগে চট্টগ্রামে বহুল আলোচিত মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডে তাঁর স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারকে 'আটক' করে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তবে রিমান্ডে বাবুল আক্তার মুখ খুলছেন না বলে জানা গেছে।
বুধবার (১২ মে) দুপুরে তাকে মিতু হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রট সরোয়ার জাহানের আদালতে হাজির করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডের প্রতিবেদন ১০ দিনের মধ্যে আদালতে দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রথম দিন বৃহস্পতিবার (১৩ মে) বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা না গেলেও শুক্রবার (১৪ মে) দ্বিতীয় দিন জিজ্ঞাসাবাদে তিনি তেমন কোনো তথ্য দেননি বলে পিবিআই সূত্রে জানা গেছে। শনিবার (১৫ মে) তাকে আবারো জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানার চেষ্টা চলছে।
এদিকে মিতু হত্যা মামলায় বাবুল আক্তারের ছেলের সঙ্গেও কথা বলবে পিবিআই। ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরের জিইসি মোড়ে সাত বছরের ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় সড়কে খুন হন মিতু। এসময় ছেলেকে ধরে রেখেছিল বাবুল আক্তারের সোর্স কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসা, যাকে সিসিটিভির ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা হয়েছে।
ওই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ছেলে মাহিরের বক্তব্য নেওয়া হবে বলে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা। তিনি বলেন, 'বাবুল আক্তার এখন পুলিশের হেফাজতে আছেন। রিমান্ড শেষে পিবিআই তার ছেলের সঙ্গে কথা বলবে'।
বাবুল-মিতু দম্পতির ছেলের বয়স বর্তমানে ১২ বছর, মেয়ের বয়স ৮ বছর। গত তিন বছর ধরে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই বলে জানিয়েছেন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন।
পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, মিতুকে হত্যাকাণ্ডের দিন সকাল ৭টা ৩৭ মিনিটে মুসা নামের এক ব্যক্তির মোবাইলে ফোন করেন বাবুল আক্তার। সালাম দিয়ে মুসা ফোনটি রিসিভ করতেই ওপার থেকে বাবুল আক্তার বলেন, 'তুই কোপালি ক্যান?' ৩ থেকে ৪ সেকেন্ড থেমে আবার বলেন, 'বল তুই কোপালি ক্যান? তোরে কোপাতে কইছি?' এর পর ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন বাবুল আক্তার।
হত্যাকাণ্ডের প্রায় দুই সপ্তাহ পর পুলিশের কাছে এই ফোন রেকর্ড আসার পর ঢাকার বনশ্রী শ্বশুরের বাসা থেকে ঢাকা গোয়েন্দা কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয় বাবুল আক্তারকে। গোয়েন্দা কার্যালয়ে প্রায় ১২ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি থাকার পর তিনি পুলিশের চাকরি থেকে পদত্যাগপত্র দিয়ে মুক্তি পান। যদিও বাবুল বলছেন, তাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।
পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, বাবুল আক্তার সন্তানদের নিয়ে চিন্তিত। তবে রিমান্ডে তিনি মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও প্রশ্নের সদুত্তর দিচ্ছেন না। তিনি বলেছেন, তার ‘নার্ভ’ যথেষ্ট শক্ত আছে। এছাড়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাবুল আক্তার পুলিশকে তার ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসার ভুল ঠিকানা দিয়েছেন। পরে বাবুল আক্তারের গাড়িচালকের সহায়তায় সঠিক ঠিকানা পাওয়া যায়। ওই গাড়িচালক বাবুল আক্তারকে চট্টগ্রাম পিবিআই কার্যালয়ে নিয়ে এসেছিলেন। যদিও মোহাম্মদপুরের ওই বাসায় বাবুলের বর্তমান স্ত্রী ও সন্তানদের পাওয়া যায়নি। তার সন্তানরা কার জিম্মায় থাকবে, তা নিয়ে শনিবার (১৫ মে) থেকে আইনানুগভাবে কাজ শুরু করছে পিবিআই।
অপরদিকে মিতু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত বুধবার পিবিআই এর দায়ের করা প্রথম মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, তদন্তে পাওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণ, এজাহার, আগের তদন্ত কর্মকর্তাদের তদন্তের ফলাফল, বিভিন্ন আলামত, সিসিটিভি ফুটেজ, সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, অস্ত্রের ব্যালেস্টিক পরীক্ষা, আসামি ও সাক্ষীদের জবানবন্দি, মোটরসাইকেল উদ্ধার ও সিডিআর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাবুল আক্তার হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। নিজেকে বাঁচাতে তিনি জঙ্গি হামলার কাল্পনিক ঘটনা সাজিয়েছিলেন।
মাহমুদা খানম মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনের অভিযোগ, বাবুল আক্তারের পরকিয়ার কারণে দাম্পত্য কলহের জেরে মিতুকে হত্যা করা হয়েছে। কক্সবাজার জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে কর্মরত থাকাকালে ২০১৩ সালে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর কর্মী গায়ত্রী অমর শিংয়ের সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়েন বাবুল। এ নিয়ে পারিবারিক কলহের সময় মিতুকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেন বাবুল।
এরই মধ্যে ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত সুদানে জাতিসংঘ শান্তিমিশনে ছিলেন বাবুল আক্তার। এ সময় বাবুল আক্তারের মোবাইল ফোনটি চট্টগ্রামের বাসায় ছিল। ওই মোবাইল ফোনে মোট ২৯ বার ম্যাসেজ দেন গায়ত্রী। এরই মধ্যে গায়ত্রী অমর শিংয়ের দেওয়া দুটি বই পাওয়া যায়। বই দুটি বাবুল আক্তারকে উপহার দিয়েছিলেন গায়ত্রী। এই পরকীয়া প্রেমের কারণে বাবুল মিতুর দাম্পত্য জীবনে চরম অশান্তি সৃষ্টি হয়। বাবুল আক্তারের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করলে মিতুর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এই নির্যাতনের বিষয়টিও মিতু বাবা-মাকে জানিয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় সড়কে খুন হন পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু। পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগ দিতে ওই সময় ঢাকায় ছিলেন বাবুল। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে কর্মরত ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পর নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন বাবুল। তবে পুলিশ তদন্তে তার সম্পৃক্ততার গুঞ্জন ছিল আগে থেকেই। এরপর তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। বাবুল সেসময় দাবি করেন তার স্ত্রী জঙ্গি হামলায় নিহত হয়ে থাকতে পারেন।
সূত্র : কালের কণ্ঠ