ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ ঘিরে ফেলেছে রাশিয়ার সৈন্যরা। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের কেন্দ্রস্থলে একটি টিভি টাওয়ারে রকেট হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনী। হামলায় কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ। ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে সমঝোতা আলোচনার পর হামলা জোরদার করেছে রাশিয়া। গতকাল মঙ্গলবার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ, দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরনগরী মারিওপোলিতে ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলা নিক্ষেপ করেছেন রুশ সেনারা। উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় শহর ওখতিরকায় সামরিক ঘাঁটিতে গোলা হামলায় ৭০ জনের মতো ইউক্রেনীয় সেনা নিহত হয়েছেন।
একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, কিয়েভের দিকে রাশিয়ার বিশাল সেনাবহর এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৪০ কিলোমিটার সড়কজুড়ে থাকা এই বহরে সাঁজোয়া যান, ট্যাংক, কামান ও সেনাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের গাড়ি রয়েছে। রুশ বাহিনীর আক্রমণ ও গতিবিধি পর্যালোচনার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, চার দিনের মধ্যে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের পতন হতে পারে।
যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসসহ বিভিন্ন দেশের নেতারা আহ্বান জানিয়ে আসছেন। রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের নিষেধাজ্ঞা আরোপও অব্যাহত রয়েছে। গত সোমবার ইউক্রেন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিরা বেলারুশের গোমেলে সমঝোতা আলোচনায় বসলেও যুদ্ধ বন্ধে কোনো অগ্রগতি হয়নি। আবার আলোচনায় বসতে মতৈক্য হলেও কবে বৈঠক হবে, তা ঠিক হয়নি।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু বলেন, লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে। গতকাল মস্কোয় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের মূল লক্ষ্য পশ্চিমাদের তৈরি করা নিরাপত্তা হুমকি থেকে রাশিয়ার সুরক্ষা নিশ্চিত করা। ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ এবং সেখানে নাৎসিবাদ দমন না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে।
কিয়েভবাসীর উদ্দেশে রাশিয়ার সতর্কতা : গত বৃহস্পতিবার তিন দিক থেকে ইউক্রেনে হামলা চালায় রুশ বাহিনী। এত দিন তারা অভিযানের বিষয়ে আগাম কোনো তথ্য দেয়নি। গতকালই প্রথম কিয়েভের বাসিন্দাদের সতর্ক করেছে তারা। বিকেলে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, সেনারা ইউক্রেনের রাজধানীতে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইউক্রেনের নিরাপত্তা বাহিনীর স্থাপনা লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হবে। এসব স্থাপনার আশপাশের বাসিন্দাদের নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি ইউক্রেনের যেসব নাগরিক অস্ত্র হাতে রুশ বাহিনীকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁদেরও সরে যাওয়ার আহ্বান জানায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। এই সতর্কতার পর কিয়েভে টিভি টাওয়ারের কাছে রুশ বাহিনীর হামলায় অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন।
হামলার প্রথম দিনেই কিয়েভের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে হোস্টোমেল বিমানঘাঁটি দখলে নিয়েছিল রুশ বাহিনী। এরপর দুই দিন কিয়েভের উপকণ্ঠে রুশ সেনাদের হামলা চালানোর কথা জানিয়েছিল ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ। পরে তারা শহরকে রুশ সেনামুক্ত করার ঘোষণা দেয়। এদিকে রাশিয়ার একটি সেনাবহর কয়েক দিন ধরে কিয়েভের ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান নিয়ে আছে। এগিয়ে আসতে থাকা বড় সেনাবহর তাদের সঙ্গে যোগ দিলে একযোগে কিয়েভে বড় ধরনের হামলা চালানো হতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সামরিক বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।
রুশ বাহিনীর বড় ধরনের আক্রমণের শঙ্কায় কিয়েভের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, শহর ছাড়ার ট্রেন ধরতে মরিয়া চেষ্টা করছেন মানুষ।
টিভি টাওয়ারে হামলা : ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের কেন্দ্রস্থলে একটি টিভি টাওয়ারে রকেট হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনী। হামলায় কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ।
হলোকাস্ট মেমোরিাল কেন্দ্রের পাশের এই টিভি টাওয়ারে হামলায় কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ থাকে। হামলায় টিভি টাওয়ারের কাছের মেমোরিয়ালটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এর আগে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকোভ এ ধরনের হামলার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেনের তথ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে চাইছে রাশিয়া। ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করেছে, রাশিয়া এমন ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দিতে চাইছে বলেও অভিযোগ করেন রেজনিকোভ।
যেসব জায়গায় হামলা চলছে : পশ্চিমা গোয়েন্দাদের ভাষ্যমতে, হামলা শুরুর আগে রাশিয়া সীমান্তে যেসব সেনা মোতায়েন করেছিল, তাদের ৭৫ শতাংশই এখন ইউক্রেনে ঢুকেছেন। গতকাল রুশ সেনারা ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খেরসনে প্রবেশ করেছেন। সেখানে ইউক্রেনের সেনাদের সঙ্গে তাঁদের লড়াই চলছে। রুশ সেনারা সব দিক থেকে শহরটি ঘিরে প্রবেশপথগুলোতে তল্লাশিচৌকি বসিয়েছেন।
পূর্ব দিকে ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভের কেন্দ্রস্থলের স্বাধীনতা চত্বরে গতকাল ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলা নিক্ষেপ করেছে রুশ বাহিনী। স্থানীয় প্রশাসনিক ভবনসহ কয়েকটি স্থাপনায় এসব হামলায় অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় বন্দরনগরী মারিওপোলির বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সেখানে অনবরত গোলা নিক্ষেপ করছে রুশ বাহিনী।
গত রোববার রাতে কিয়েভ ও খারকিভের মধ্যবর্তী শহর ওখতিরখায় চারতলা ভবনের একটি সামরিক ঘাঁটিতে গোলা নিক্ষেপ করে রুশ বাহিনী। তাতে অন্তত ৭০ সেনা নিহত হন বলে স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
হতাহত : রুশ বাহিনীর ছয় দিনের হামলায় ১৪ শিশুসহ ৩৫২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে রাশিয়ার ৫ হাজার ৭১০ জন সেনা নিহত হওয়ার দাবি করেছে ইউক্রেন। তবে এ বিষয়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। এদিকে জাতিসংঘ ইউক্রেনে ১৩৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, হামলা শুরুর পর ইউক্রেন থেকে ৬ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ পাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। পোল্যান্ড সীমান্তে শরণার্থীর ঢল এত বেশি যে অনেককে সীমান্তের ওপারে যেতে ৬০ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে।