পাকিস্তানের আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ চলতি সপ্তাহের শেষে স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে দেশে ফিরছেন। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক পরিক্রমায় প্রায় পুরোটা সময়ই তিনি সেনাবাহিনীর পথের কাঁটা হয়েছিলেন। সে কারণে তার এমন নাটকীয় ভাবে দেশে ফেরার ব্যাপারে খুব কম লোকই ধারণা করতে পেরেছিলেন।
এর আগে শেষবার তিনি যখন পাকিস্তানে ছিলেন তখন দুর্নীতির দায়ে সাজা খেটেছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে ২০১৯ সালের নভেম্বরে জেল থেকে বাইরে আসার সুযোগ পান তিনি।
এখন অবস্থায় মনে হচ্ছে, সেনাবাহিনী একদিন যাকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল তাকেই আবারও স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনকি তিনি আবারও প্রধানমন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন।
শুধু এখানেই শেষ নয়, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সব চরিত্রই যেন বদলে যাচ্ছে। নওয়াজ শরীফের প্রতিপক্ষ ইমরান খান ২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু তিনিই এখন সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে কারাগারে রয়েছেন।
নওয়াজ পাকিস্তানে ফিরলে কী ঘটবে?
তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ জামিন পাওয়ার পর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে মূলত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান এবং গত চার বছর ধরে তিনি সেখানেই ছিলেন। ২০২২ সাল থেকে যখন ইমরান খান সংসদের অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হন তখন থেকেই তিনি আবারও রাজনীতিতে সরব হতে থাকেন।
নওয়াজ শরীফের দল পিএমএল-এন পার্টি সে সময় পাকিস্তানের অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেয়, যার প্রধান ছিলেন নওয়াজ শরীফের ছোট ভাই শাহবাজ শরীফ।
বড় ভাই নওয়াজ শরীফ যখন দেশে ফিরছেন তখন শাহবাজ শরীফও দুবাই থেকে ইসলামাবাদের পথে রয়েছেন। তিনি তার নিজের শহর লাহোরের এক জনসমাবেশে যোগ দেবেন বলে জানা গেছে।
যদিও এখনো আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে নওয়াজ শরীফের গ্রেফতার হওয়ার ভয় নেই, কারণ তিনি আগামী সপ্তাহের পরবর্তী শুনানির আগ পর্যন্ত জামিনে আছেন।
নির্বাসন থেকে নওয়াজ শরীফের ফিরে আসার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। ২০০৭ সালেও তিনি ফিরে এসেছিলেন। সে সময় তিনি ও তার প্রতিপক্ষ বেনজীর ভুট্টো সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে আসেন। ১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হারানোর পর আবারও তাকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
তখন অবশ্য সব বিরোধী দল একসঙ্গে জোট বাঁধে এবং এক নির্বাচনী সমাবেশে বেনজীর ভুট্টোর হত্যাকাণ্ডের সপ্তাহখানেক পর তার দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জয়লাভ করে।
নওয়াজ শরীফ আবারও প্রধানমন্ত্রী হবেন?
নওয়াজ শরীফের দল পরিষ্কার করে বলেছে যে, চলতি বছরের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী তিনিই হবেন। যদিও নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু ৭৩ বছর বয়সী নওয়াজ শরীফের সামনে অনেকগুলো ইস্যু আছে। আর সেটা শুধু চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটই নয়। এই সঙ্কটের জন্য তার দলকে বেশি দায়ী করা হয়। আরেকটা বড় ইস্যু হচ্ছে- তার প্রধান প্রতিপক্ষ ইমরান খান জেলে থাকায় নির্বাচন সুষ্ঠ হবেনা বলেও মনে করেন অনেকেই।
এছাড়া সেনাবাহিনীর ব্যাপার তো আছেই। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান কীভাবে চলবে তার অনেকটাই তাদের ওপরই নির্ভরশীল। দেশের বাইরে থাকার সময় এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই সামরিক শক্তির সমালোচনা করেছেন।
বিশেষ করে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য তিনি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর এক সাবেক প্রধান ও সাবেক এক আর্মি চিফ অব স্টাফকেই দায়ী করেছেন। তবে এসব অভিযোগ তারা অস্বীকার করেছেন।
নওয়াজ শরীফ দাবি করেন, তিনি ‘মিথ্যা মামলার’ শিকার এবং একই সঙ্গে দেশের বিচারকরাও যোগসাজশে কাজ করেন বলে অভিযোগ আনেন। এসব কারণে পাকিস্তানের গণতন্ত্র পঙ্গু হয়ে পড়েছে এবং তিনি মনে করেন এসব কারণেই পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদ শেষ করতে পারেন না।
তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা মনে করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার একটা বোঝাপড়া হয়েছে যাতে তিনি দেশে ফিরতে পারেন। কিন্তু তারাও বলছেন যে, এতে নিশ্চিত নয় যে নওয়াজ শরীফই নির্বাচনে জয়লাভ করবেন।
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) জুলফি বুখারী বলেন, আমি তো তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোনো রাস্তা দেখিনা, কারণ তার বিরুদ্ধে মামলা চলছে এবং আদালতের আদেশেই তিনি রাজনীতিতে আজীবনের জন্য অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন।
তবে অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করেন, ভবিষ্যতে সবকিছুই নওয়াজ শরীফের পক্ষে ঘুরে যাবে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওয়াজাহাত মাসুদ বলেন, আমাদের রাজনীতির চেহারা ও চিত্রনাট্য কোনটাই বদলায়নি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক চরিত্রের পরিবর্তন ঘটছে।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরান খান সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতায় আসে। আর এখন তারা ব্যস্ত নওয়াজ শরীফের জন্য নির্বাচন করতে।
তবে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে এ ব্যাপারে কিছুই জানা যায়নি যে, তারা নওয়াজ শরীফকে চায় কি না। একই সঙ্গে সেনাবাহিনী ও ইমরান খান কোনো পক্ষই নিজেদের মধ্যে কখনো বোঝাপড়া ছিল বলে স্বীকার করেনি।
ইমরান খান একদিকে কারাগারে আর অন্যদিকে গত মে মাসে তার গ্রেফতারের প্রতিবাদে হওয়া ব্যাপক বিক্ষোভের পর ধরপাকড়ে তার দলও এখন অনেকটাই দুর্বল অবস্থানে। এমন অবস্থায় বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা নির্বাচন সুষ্ঠ হবেনা।
ইমরান খান গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে পিটিআই এগিয়ে ছিল। কিন্তু জুলফি বুখারী বলছেন, এখন আর নির্বাচনের মাঠে সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। একই মত অন্যান্য দলেরও।
তাই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে শুধু এবার পিটিআইয়ের জায়গায় সুবিধা পাচ্ছে পিএমএল-এন। প্রধান ফ্যাক্টর এখানে অর্থনীতি। আর এ জন্য দুই দলই একে অন্যকে দায়ী করছে। আকাশ ছোঁয়া মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধিই হবে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে ভোটারদের ভাবনার বিষয়।
যদিও পিএমএল-এন দাবি করছে যে, নওয়াজ শরীফ আগেও ক্ষমতায় ছিল এবং তিনি জানেন কীভাবে সব ‘আবারও ঠিক করতে হবে’। তবে অনেকেই নিশ্চিত না যে কীভাবে তিনি এটা করবেন।