logo
আপডেট : ২২ অক্টোবর, ২০২৩ ১১:০২
গাজায় প্রবেশের আগে ইসরায়েলের যত হিসাব-নিকাশ

গাজায় প্রবেশের আগে ইসরায়েলের যত হিসাব-নিকাশ

গাজার উত্তর সীমান্তে ব্যাপক সৈন্য জড়ো করেছে ইসরায়েল

ফ্রাঙ্ক গার্ডনার

বিবিসি নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা

বেশ কয়েকদিন ধরে ইসরায়েল আভাস দিয়ে যাচ্ছে যে, তাদের বিশাল সৈন্য বাহিনী হামাসকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে গাজায় অভিযান চালানোর জন্য প্রস্তুত।
ইসরায়েলের ডিফেন্স ফোর্স-আইডিএফের তিন লাখ সংরক্ষিত সেনা সদস্যকে ডাকা হয়েছে এরই মধ্যে। গাজা সীমান্তের অন্যপাশে ইসরায়েল অংশের ছোট ছোট শহর, মাঠ আর শস্যক্ষেত সব এখন ট্যাংক, গোলা বারুদ এবং ভারী অস্ত্রে সুসজ্জিত হাজারো সেনা সদস্য দিয়ে ভর্তি।

ইসরায়েলি বিমান ও নৌ বাহিনী যত হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের সন্দেহজনক আস্তানা ও অস্ত্রাগার আছে - সেসব লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। এসব হামলায় অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক মারা যাচ্ছেন ও আহত হচ্ছেন, আর অল্প সংখ্যক হামাস নেতা মারা পড়ছেন।

গাজার একটি হাসপাতালে বিস্ফোরণের ফলে যে বিপুল মানুষ হতাহত হয়েছে, তা এই অঞ্চলের উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, যদিও এ হামলার দায় অস্বীকার করে দু'পক্ষই একে অন্যকে অভিযুক্ত করছে।

কিন্তু কেন এখনো গাজায় অভিযানের ঘোষণা দিয়েও তা শুরু করছে না ইসরায়েল? এর পেছনে আসলে অনেকগুলো কারণ আছে।
বাইডেন ফ্যাক্টর :
চলতি সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তাড়াহুড়ো করে ইসরায়েল সফর জানান দেয় পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে হোয়াইট হাউজ কতোটা চিন্তায়। ওয়াশিংটনের দুশ্চিন্তার জায়গা দুটো: মানবিক বিপর্যয় ক্রমেই বেড়ে যাওয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে পড়া।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এরই মধ্যে পরিষ্কার করে জানিয়েছেন, যে গাজা থেকে ২০০৫ সালে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিল ইসরায়েল, সেটা আবারও দখলে নেয়ার বিরুদ্ধে তিনি। তার ভাষায়, এটা হবে ‘একটা বড় ভুল’।

সরকারিভাবে তার এই ইসরায়েল সফরের প্রধান কারণ মধ্যপ্রাচ্যে অ্যামেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রকে কৌশলগত সহায়তা প্রদান এবং একইসাথে গাজা নিয়ে ইসরায়েলের পরিকল্পনা শোনা।

তবে অপ্রকাশিত কারণ হল মি. বাইডেন এই সফরে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চরমপন্থী সরকারকে একটু ছাড় দেয়ার ব্যাপারে কথা বলবেন। যুক্তরাষ্ট্র জানতে চায়, ইসরায়েল যদি গাজায় প্রবেশ করে, তবে তারা সেখান থেকে কখন ও কীভাবে বের হওয়ার পরিকল্পনা করছে।

ইসরায়েল যদি গাজায় পুরোমাত্রার সামরিক অভিযান চালাতে চায়, তাহলে সেসময় তেল আবিবে এয়ারফোর্স ওয়ান হাজির থাকাটা অ্যামেরিকা ও ইসরায়েল কারো জন্যই ভালো দেখায় না।

আল আহলি হাসপাতালে ভয়াবহ বিস্ফোরণের আড়ালে চাপা পড়ে যাওয়া এই সফরে জো বাইডেন প্রকাশ্যেই ইসরায়েলের যে বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। ইসরায়েল দাবি করেছে, একটা ফিলিস্তিনি রকেট ভুল করে এই হাসপাতালে পড়লে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

ইরান ফ্যাক্টর :

গত কয়েক দিনে ইরান স্পষ্ট হুমকি দিয়ে বলেছে গাজায় ইসরায়েল যে ঘৃণ্য হামলা চালাচ্ছে তার যথাযথ উত্তর দেয়া হবে। এখন এটার মানে কী?

ইরান মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীকে তহবিল, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণও করে থাকে।

এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর লেবাননের হেজবুল্লাহ, যাদের অবস্থান একেবারে ইসরায়েলের উত্তর সীমান্ত ঘেঁষে।

হেজবুল্লাহ ২০০৬ সালে ইসরায়েলের সাথে এক রক্তক্ষয়ী ও বিধ্বংসী যুদ্ধে জড়ায়, যখন ইসরায়েলের আধুনিক সব অস্ত্র প্রতিপক্ষের পরিকল্পিত হামলা এবং লুকানো মাইনের কাছে হার মানে।

তারপর থেকে ইরানের সহায়তায় হেজবুল্লাহ পুনরায় নতুন করে নিজেদের সংগঠিত করেছে এবং ধারণা করা হয় তাদের কাছে এখন অন্তত দেড় লাখ রকেট ও মিসাইল আছে, যার অনেকগুলোই দূরপাল্লার এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম।

ফলে একটা হুমকি তো আছেই যে যদি ইসরায়েল গাজায় অভিযান শুরু করে তাহলে হেজবুল্লাহ হয়তো ইসরায়েলের উত্তর সীমান্ত দিয়ে পাল্টা হামলা শুরু করবে, যা তাদের দুই দিকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিতে পারে।

তবে এর কোনই নিশ্চয়তা নেই যে হেজবুল্লাহ বাহিনী এসময় এরকম একটা যুদ্ধে জড়াবে। বিশেষ করে যখন ভূমধ্যসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি রণতরী প্রস্তুত হয়ে আছে যে কোন সময় ইসরায়েলকে সহায়তা করার জন্য।

এটি বরং ইসরায়েলকে ভরসা দিচ্ছে যে হেজবুল্লাহর দিক থেকে যদি কোন আঘাত আসে তাহলে তাদের যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে।

তবে এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০০৬ সালের যুদ্ধের সময় হেজবুল্লাহর একটি অত্যাধুনিক অ্যান্টি-শিপ মিসাইল ইসরায়েলের একটি যুদ্ধজাহাজকে আঘাত করতে পেরেছিল।

মানবিক ফ্যাক্টর
ইসরায়েলি সরকার গাজা থেকে হামাসকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়টি যেন বাকি বিশ্বের উপর চাপিয়ে দিয়েছে।

টানা ইসরায়েলি বিমান হামলায় যখন ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু সংখ্যা বাড়তে শুরু করে, তখন সারা বিশ্ব সাতই অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর ইসরায়েলিদের দিকে যে সমবেদনা দেখিয়েছে, সেটা আস্তে আস্তে বিমান হামলা বন্ধ ও নিরাপরাধ গাজাবাসীকে রক্ষার দিকে গিয়েছে।

যদি কখনো ইসরায়েলি বাহিনী স্থল অভিযান শুরু করে তাহলে হতাহতের এ সংখ্যা আরও বাড়তেই থাকবে।

ইসরায়েলি সেনারাও মারা পড়বে, গুপ্ত হামলা, স্নাইপার এবং বুবি ট্র্যাপে – আর বেশিরভাগ যুদ্ধই হয়তো হবে মাটির নিচে ছড়িয়ে থাকা মাইলের পর মাইল টানেলে।

কিন্তু সেক্ষেত্রেও শেষ পর্যন্ত এর মূল্য হয়তো দিতে হবে সাধারণ মানুষকেই।