বাংলাদেশে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি বলছে তাদের ওপর দিয়ে এখন ‘গ্রেফতার ঝড়’ চলছে। যদিও ‘মাঠের রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় নন’ এমন কিছু নেতার গ্রেফতার দলের মধ্যেই অনেককে বিস্মিত করছে।
পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হতে পারে -এই বিবেচনায় হরতাল অবরোধ ছাড়াও নতুন কী ধরনের কর্মসূচি দেয়া যায় তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে দলটি।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
দলটি এখন ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে, যা চলবে মঙ্গলবার ভোর ছয়টা পর্যন্ত। এরপর বুধ ও বৃহস্পতিবারের জন্য নতুন কর্মসূচি আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে দলীয় সূত্রগুলো বলছে, হরতাল কিংবা অবরোধ ছাড়াও আর কী কী ধরনের কর্মসূচি দেয়া যায় তা নিয়ে চিন্তা করতে দলের নেতাদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে শীর্ষ পর্যায় থেকে।
“বিএনপির আন্দোলন দারুণভাবে চলছে এবং আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি সহিংস না হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে। সামনের পরিবেশ পরিস্থিতিই বলে দিবে আমরা কোন দিকে যাবো,” দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন।
দলের কেন্দ্রীয় কমিটির আরেকজন নেতা কায়সার কামাল বিবিসি বাংলাকে বলছেন, যে কর্মসূচিতে জনগণের অংশগ্রহণ থাকবে বলে মনে হবে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী যে ধরনের কর্মসূচির প্রয়োজন অনুভূত হবে সামনে সে ধরনের কর্মসূচিই আসবে।
ওদিকে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নিয়মিত ব্রিফিং-এ জানিয়েছেন, ২৮শে অক্টোবরের মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে এবং এরপর রবিবার পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১২২ টি মামলা হয়েছে এবং গ্রেফতার হয়েছেন ৫২৮৪ জন।
তবে পুলিশ জানিয়েছে, ২৮শে অক্টোবর থেকে পরবর্তী সাত দিনে ৮৯টি মামলায় ২১৭২ জনকে গ্রেফতার করেছে তারা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ২৮শে অক্টোবরের সহিংসতা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা ও পুলিশ হত্যার জন্য তাদের (আটক বিএনপি নেতাদের) বিচার হতেই হবে।
গ্রেফতার-ঝড়ের দাবি বিএনপির
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেছেন, সারা দেশে তাদের নেতাকর্মীদের ওপর এখন ‘গ্রেফতার ঝড়’ বয়ে চলেছে এবং তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কেউই এর বাইরে থাকছেন না।
“তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত কাউকেই রেহাই দেয়া হচ্ছে না। একাত্তরের পরিস্থিতি বিরাজ করছে এখন দেশে। এভাবে সারা দেশকে বিএনপি শূন্য করে নির্বাচনের নামে তামাশা করবে তারা। নির্বাচন কমিশন শেখ হাসিনার তালিকা অনুযায়ী বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করবে,” অনলাইন ব্রিফিংয়ে বলছিলেন মি. রিজভী।
এদিকে শনিবার রাতে ঢাকা থেকে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও শাজাহান ওমরকে আটকের ঘটনায় দলের মধ্যেই বিস্ময় তৈরি হয়েছে। কারণ এই দুজন সমাবেশগুলোতে নিয়মিত বক্তৃতা দিলেও মাঠের রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় নন।
এর আগে সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ও মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দিন স্বপনকে আটকের ঘটনাও অনেককে অবাক করেছিলো। সংঘাত সহিংসতার মধ্যে কখনো তাদের খুব একটা দেখাও যায়নি।
তারও আগে দলের মহাসচিব হওয়ার কারণে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেব মির্জা আব্বাসকে গ্রেফতার করা হলেও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে আটক করা হবে না বলেই ধারণা ছিলো দলের অনেকের।
“আসলে একটি কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। কাকে কি জন্য টার্গেট করা হচ্ছে সেটা বোঝাই কঠিন। কিন্তু এতে আন্দোলনে কোন প্রভাব পড়বে না। কারণ মানুষই এখন আন্দোলনকে এগিয়ে নিচ্ছে,” বলছিলেন সেলিমা রহমান।
কিন্তু নেতারা যাই বলুন দলের সব পর্যায়ের নেতাদের গ্রেফতারের বিষয়টি নিয়ে বিএনপির মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা আছে। কেউ কেউ মনে করেন নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়টিকে নির্বিঘ্ন করতেই সব স্তরের নেতাদের আটক করা শুরু হয়েছে।
আবার কেউ কেউ মনে করেন সম্প্রতি বিএনপিরই দুজন সাবেক নেতা যে একটি নতুন দল গঠন করেছেন তার সাথেও এসব আটকের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।
বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও যাতে বিচ্ছিন্নভাবে নেতারা অংশ নেন, সেজন্য গত নির্বাচনে ঢাকায় বিএনপির প্রার্থী রবিউল ইসলাম ও আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ারকে এবং কিশোরগঞ্জে শরিফুল আলমসহ সারাদেশে বিএনপির সম্ভাব্য অনেক প্রার্থীকে আটক করা হয়েছে।
আটকের নামে এসব নেতাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে পারে সরকারের তরফ থেকে করা হতে পারে-এমন আলোচনাও আছে বিএনপির ভেতরে।
যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পুলিশ হত্যা কিংবা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার মতো ঘটনা এবং ২৮শে অক্টোবরের সহিংসতার জন্যই বিভিন্ন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করছে পুলিশ।
“তাদের বিচার হতেই হবে। ২৮ অক্টোবর পুলিশ পিটিয়ে হত্যা করেছে। এই অপরাধের ছাড় দেওয়া হবে না। সাংবাদিকদের পিটিয়েছে। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা করেছে। পুলিশ হাসপাতালে হামলা করেছে,” দলীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রোববার তিনি বলছিলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী থাকুন না বাইরে। দু-একজন কথা বলার লোক থাকা দরকার। তবে ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় গ্রেপ্তার করা যায় না। তাদের তো বিভিন্ন সারির নেতারা রয়েছেন''।
নতুন কর্মসূচির সন্ধান
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন সামনে আন্দোলনের কর্মসূচি কী হতে পারে, সেজন্য দলীয় হাইকমান্ড থেকে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের চিন্তা করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ হরতাল- অবরোধ ছাড়াও আর কী কর্মসূচি দেয়া যায় সেটি নিয়ে দলের বিভিন্ন স্তরে আলোচনা চলছে এখন।
নেতাদের ঘনিষ্ঠ কিছু সূত্র জানিয়েছে, হরতাল-অবরোধ চললেও সামনে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর, এমনকি নির্বাচনের পরেও আন্দোলন অব্যাহত রাখার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে-এমন বিবেচনা থেকেই আরও নতুন কর্মসূচির খোঁজ করছে বিএনপি।
আগে নির্বাচন কমিশন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সচিবালয় ঘেরাও পালন করে হরতাল-অবরোধে যাওয়ার চিন্তা থাকলেও ২৮শে অক্টোবরের সহিংসতার পরদিন হরতাল এবং এরপর একদিন বিরতি দিয়ে তিন দিনের অবরোধ পালন করেছে বিএনপি।
চলতি সপ্তাহে রবিবার সকাল থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত অবরোধের পর বুধ ও বৃহস্পতিবার হরতালের মতো কর্মসূচী ঘোষণার চিন্তা আছে দলের ভেতরে।
বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হতে পারে পরবর্তী সপ্তাহের প্রথম দুদিনের কর্মসূচি। এরপর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিনকে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক কর্মসূচি আসার সম্ভাবনা থাকলেও সেগুলো কী ধরণের কর্মসূচি হতে পারে তা নিয়েই এখন বিশ্লেষণ করছেন দলের নেতারা।
আবার এতো দিন ধরে আন্দোলন আর দেশজুড়ে এতো নেতার গ্রেফতারের পর কর্মসূচি ঘোষণার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া মোকাবেলার মতো সাংগঠনিক সক্ষমতা দলটির থাকবে কি-না তাও চিন্তায় আছে অনেকের।
সেলিমা রহমান অবশ্য বলছেন যে, সরকার গ্রেফতার মামলা ও হামলা করে যে অবস্থা তৈরি করেছে তাতে এমন চিন্তা বা আলোচনা ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু তার দাবি এখন আন্দোলন শুধু বিএনপির বিষয় নয়।
“দেখুন আমাদের প্রত্যেকটি কর্মসূচি সফল হচ্ছে। কারণ সুযোগ পেলেই মানুষ আসছে। আমরা তো জনগণকেই সম্পৃক্ত করতে চেয়েছিলাম। তাই এটি ঠিক যে কঠিন অবস্থা চলছে, কিন্তু আন্দোলনও চলছে। যখন যা দরকার হবে বা জনগণ চাইবে দল তাই ঘোষণা করবে,” বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন।
তবে দলের একটি অংশ চাইছে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করুক দল। কিন্তু এ নিয়ে দলের নেতাদের মধ্যে বিরোধ আছে । কারণ অনেকে আবার মনে করেন অসহযোগ আন্দোলনের মতো কর্মসূচি দেয়ার সময় এখনো আসেনি।
দলের আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলছেন, দলের কর্মসূচিগুলো ভেতরে -বাইরে সবার সঙ্গে আলোচনা করেই চূড়ান্ত করা হয় এবং লিয়াঁজো কমিটি আবার এসব কর্মসূচি নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্য দলগুলোর সাথে আলোচনা করে। এরপর দল একটি কর্মসূচি ঘোষণা করে।
“এটি আমাদের সাংগঠনিক প্রক্রিয়া। এখন চলমান আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণেও একই পদ্ধতিতে সবার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিবে হাইকমান্ড। তবে সময়ের প্রেক্ষাপটে যে কর্মসূচির দরকার হবে এবং জনগণ যে কর্মসূচিতে অংশ নিবে সেটিই দেয়া হবে,” বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন।