সকালে ভার্সিটি গেলাম না, মাথায় তীব্রব্যথা।আজকাল রাতে ঘুমোতে পারছি না। বিছানায় যাওয়ার সাথে সাথে ঘুমে তলিয়ে যাওয়া আমিটা এখন বিছানায় এপাশওপাশ করি, ঘুম আসে না।
সকালের আলো ঘরে ঢুকছে। মাথাটা বড্ড ভার। পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হয়ে গেছে। বাসার বেন্টিলেটারে চড়ুই পাখির সংসার। শুয়ে শুয়ে তাদের দেখছি। খাবার আনছে, ঘরে ঢুকছে, আবার বের হচ্ছে, মনে হচ্ছে আজ তারা হয়ত ভীষণ খুশি। খুব দুষ্টুমিও করছে। আমার বিছানা ছেড়ে নামতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কাঁথাটা আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিলাম গায়ে।
চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি, আর ভাবছি -
প্রিয় মানুষটা মন থেকে উঠে গেলে তার প্রতি মনের সমস্ত ভালোবাসা কি হারিয়ে যায়, সেই ভালোবাসা মনের নির্জন সাগরে ক্রমেই অতলে তলিয়ে যায়, যে অতলের শেষ নেই যেখান থেকে ফিরে আসা যায় না, ভালোবাসা কি পারে সেখান থেকে ফিরে আসতে, একমুঠো আশার আলো নিয়ে আবারও ভালোবাসায় ভাসতে, আবারও আঁকড়ে ধরতে তাকে।
কী সব ভাবতে শুরু করলাম সকাল বেলা। নিজেই অবাক হয়ে কাঁথাটা সরিয়ে উঠে বসলাম বিছানায়। মাথাটা একটু হাল্কা লাগছে। বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছি। হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে উঠলাম। উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়ছে বড় বোনের নয় বছরের ছেলে জিতু।
কাগজের বোম বানানো শিখেছে সে। সেটাই প্রয়োগ করলো। আমার ভয় পেয়ে যাওয়া মুখটা তাকে ব্যাপক আনন্দ দিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সে এখনও হাসি থামাতে পারছে না।
কখন এলি তুই জিতু?
হাহাহা, ভয় পেয়েছো? হাহাহা, হাহাহা, আমি পা টিপে টিপে আসছি হাহাহা।
আমি তার মুখের দিক তাকিয়ে আছি। হাসির জন্যে কথা বলতে পারছে না সে। আমাকে বেকায়দায় ফেলতে পারলে খুব আনন্দ পায় সে।সবসময় মাথায় এগুলোই চলে তার। কিভাবে আমায় ভয় দেখাবে, বোকা বানাবে।
আমিও একটু ভয়েই থাকি। বিচ্ছুটা কখন ঘরে ঢোকে আমি বেশিরভাগ সময়েই টের পাই না।
এতো সকালে কি? হে? স্কুল নাই তোর?
আমি বিছানা থেকে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করলাম। সে বিছানায় রাজার মতো ভাব করে বসলো। - না, আজ স্কুল নাই। আমি আজ দাদাবাড়িতে চলে যাবো এখন।
-ও তাই, যা কিন্তু বদমাইশি করবি না। কদিন আগে গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলি। সবে ভালো হলি। ওর কাগজের রকেটটার দিক ইশারা করে বললাম-
আর এটা কি?
সে খুব আগ্রহ নিয়ে বললো- আসো তোমাকে শিখিয়ে দেই।
বলে সে কাগজের বোম বানানো দেখাতে লাগলো। আমি দেখলাম বানানো শেষে ফাটাতে নিলো। কিন্তু ফুটলো না। আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। সে একটু লজ্জা পেয়ে আবারও দিলো। হলো না। আমি আরও হাসছি।
বেচারা তিনচার বার ট্রাই করেও পারছিলো না।
আমারও হাসি থামছিলো না।
আমি ওর থেকে নিয়ে নিজে ফাটালাম। একবারেই ফাটলো। বেচারা আবারও হাতে নিলো।
কিন্তু কপাল খারাপ, ওর হাতে আর বোম ফাটলো না। আমি হাসতে হাসতে বললাম, যা এখন। তুই না বাড়িতে যাবি? যা ওঠ।
সে একটু মন খারাপ করে বললো-আমি বাড়ি থেকে এসে...
আমি বললাম-হে যা যা আগে ভালো করে শিখ।
যা ভাগ!
সে চলে গেলো। আমি ফ্রেশ হয়ে একমগ কফি বানিয়ে নিলাম। সকাল আটটা বেজে গেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি অনেকগুলো ম্যাসেজ বান্ধুবীদের। আজ কেমন যেনো বিষণ্নতা ঘিরে ধরেছে আমায়। নিজেকে পথহারা পথিক মনে হচ্ছে। ফোনটা রেখে দিয়ে কফিতে চুমুক দিলাম। গুনগুন করে গাইছি-
অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান
যেনো ভুলে যেও না
একি বন্ধনে বাঁধা দুজনে
এ বাঁধন খুলে যেও না...
-উপমা? উপমা? মায়ের ডাক ভেসে আসছে। সাড়া দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মা ডাকতে ডাকতে রুমে এসে হাজির।
-কিরে তোকে কখন থেকে ডাকছি।
-কি বলবে বলো মা।
-তোর মামার শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। আমার এদিকে প্রচুর কাজ। তুই ক'টা দিন মামার কাছে থেকে আয়। তোর মামা ফোন করেছিলো। তোকে দেখতে চেয়েছে।
-আচ্ছা।
-তাহলে খেয়ে নে। খেয়ে বেরিয়ে পর। ট্রেন ধরতে হবে।
মামা আমার বরাবরের প্রিয় মানুষ। আমি একমাত্র মামার কথাই বিনাবাক্যে মেনে চলি। মামা ছাড়া কেউ আমার কোনও বিষয়ে মত বদলাতে পারে না।
দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম। মামার শরীর খারাপ টারাপ কিচ্ছু না। উনি দিব্বি আছেন।
আমি ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই খাবারের জন্যে ডেকে নিতে এলো বারো বছরের মামাতো ভাই অপু।
-আপু আপু! আমি গ্রামের সবচাইতে বুদ্ধিমান ছেলে।
আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম-বাহ তাই নাকি। তা কিভাবে বুঝলি?
-কাব্য ভাই বলেছে। আমি বিকেলে যখন ওর কাছে পড়তে যাই, আমি সব পড়া পারি।
ও তাই? এটা তো খুবই ভালো। তোর কাব্য ভাই এখনও পড়ায় তোদের?
-হে, তোমার কথা জিগ্যেস করে প্রায়ই। তুমি আবার কবে আসবে।
-আজ তোদের পড়া নেই?
-না আজ তো শুক্রবার। আজকে কাব্য ভাই পড়ায় না।
ওর সাথে কথা বলতে বলতে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলাম। মামা বলে উঠলো -আয় আয়, বেশ শুকিয়ে গেছিস। খাওয়াদাওয়া কি ছেড়ে দিয়েছিস নাকি!
আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম, মামা! তুমি তো দিব্যি আছো,মিথ্যে বললে কেনো?
মামা আমার প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে বললো- তোর মতো পাগলের সাথে পাগলামি না করলে টিকা যাবে?
মিথ্যা না বললে, হাজারটা বাহানা করে মানা করে দিতি। এতো অলস তুই বলার বাইরে। নিজের ছোট্ট খোপরি ঘর থেকে বের হতেই চাস না।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। মামার সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
বিকেলে নদীর পাড়ে বড় নিম গাছটার নিচে বসে আছি।
প্রচণ্ড বাতাসে ভালোই লাগছে। মামার এখানে এই একটা জায়গায়ই আমার খুব প্রিয়। নীরব,নিস্তব্ধ পরিবেশ৷
হঠাৎ পেছন থেকে কারোর পায়ের আওয়াজ আসলো,ঘুরে তাকিয়ে দেখি, কাব্য আসছেন এদিকেই।
-আসসালামু আলাইকুম। নম্রভাবে আমাকে সালাম দিয়ে পাশে বসলেন।
আমি সালামের জবাব দিলাম। কাব্য এই গ্রামেই থাকেন। ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছেন ঢাকা শহরে। তবে এখন পাশের শহরে অনার্স করছেন আর বাড়িতেই থাকেন। গ্রামের ছোট বাচ্চাদের বিকেলবেলা এই নিমগাছের নিচে বসে পড়ান। এখানেই পরিচয় হয়েছিলো দুজনের।
-তা দীর্ঘ চারমাস পর দেখা আপনার সাথে, কাব্য নদীর দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে। বললাম- কেমন আছেন?
-এইতো আছি। এ মাসেই দেশের বাইরে চলে যাচ্ছি।
-ও, আপনার নাকি দেশের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না।
- হে আপনাকে তো বলেছিলাম, আমি চাই বাবা-মায়ের সাথে থাকতে। কিন্তু ওরাই চায় আমি যেনো বাইরে যাই। নিজের ভবিষ্যৎ বানাই।
- উম তাহলে তাই করেন।
-আপনি কোনটা বলেন?
-আমি কেনো বলতে যাবো? আমার কি!
- হে সেটাই তো। আপনার কি? আমি আপনার কে? আমি থাকি বা যাই তাতে আপনার কি? আপনার কিছুই আসে যায় না!! বলে রাগে গটগট করে চলে গেলেন।
আমি একটু অবাক হয়ে উনার চলে যাওয়া দেখে আবার নদীর ঢেউ দেখতে শুরু করলাম নির্লিপ্তভাবে। কিছুক্ষণ পর উনি ফিরে এলেন। পাশে বসতে বসতে বললেন-সরি।
আমি কিছু বললাম না। দুজনই নদীর পানির দিকে তাকিয়ে আছি। নীরবতা ভেঙে কাব্য বললেন
-উপমা, আমাকে কখনও মনে পড়বে না আপনার?
-পড়বে।
-তখন কি করবেন?
-প্রার্থনা।
-কি প্রার্থনা?
উদাস চোখে বললাম-
-পরের জন্মে যেনো মুসলিম বানিয়ে পাঠায় ভগবান।
সূর্য নদীর বুকে ডুবে যাচ্ছে। উঠে দাঁড়ালাম আমি।কাব্যর চোখ দুটো চিকচিক করছে, এই বুঝি টুপ করে পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে! আমি দেখতে চাই না। নীরবে চলে এলাম।