logo
আপডেট : ২৮ নভেম্বর, ২০২৩ ১০:১৯
আজকের গল্প
আব্বা
আবু সাঈদ

আব্বা

হেমন্তের শেষে ধান কাটা শেষ হওয়ার পর থেকেই খালি ধানক্ষেতগুলো ছেলে-মেয়েদের খেলার মাঠে পরিণত হয়ে উঠত। একদিন আব্বা বাড়ি নেই। খেলতে যাওয়ার এই তো সুযোগ। খেলতে পারি আর না পারি, মাঠে তো যাওয়া যাবে। আগের দিন আব্বা তাড়াতাড়ি দোকানে যাওয়ার কথা থাকলেও সন্ধ্যাবেলায় দোকানে গিয়েছিল। তাই শত ইচ্ছা থাকলেও খেলতে যাওয়া হয়নি।
পড়ালেখায় বিড়ালতপস্বী হলেও আত্মনিয়ন্ত্রণের তপস্যায় কোন ঘাটতি ছিল না আমার। আব্বা যে খেলাবিরোধী মানুষ, তা নয়। কিন্তু তার আশংকা যে, এই পল্লীগ্রামের অন্য দুষ্টু কিশোরদের সংস্পর্শে তার কৌতূহলী সন্তানটিও না আবার বখে যায়! 

ছোটবেলায় আব্বা ভালো ছাত্র ছিল। কিন্তু পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে পড়ালেখা চালিয়ে নিতে পারেনি। জলবসন্তের প্রকোপে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মারা যায় আমার দাদা আর ছোট চাচা। দাদি এবং আব্বার অবস্থাও ছিল বেশ খারাপ! সুস্থ ছিল কেবল বড় চাচা। সে যাত্রায় আব্বা এবং দাদি বেঁচে গেলেও বসন্তের আক্রমনের চিহ্ন তাদেরকে বহন করতে হয়েছে অনেক দিন। বড় চাচা বাবা-মায়ের বড় সন্তান হওয়ায় আদরটা একটু বেশিই পেয়েছিল। সবাই তাকে আদর করে খোকা বলে ডাকত। দাদার মৃত্যুর পর সংসারের অর্থনৈতিক অবস্থা যখন একেবারেই নাজুক, আব্বা তখন ভেবেছিল, টিকে থাকার জন্য একজনকে সংসারের হালটা ধরতে হবে। নিজের স্বপ্নের জলাঞ্জলি দিয়ে সে কঠিন দায়িত্ব আব্বা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বড় চাচাকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। এ দেশে বাবা-মায়েরা সন্তানের সক্ষমতা বিবেচনা না করেই নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের ভার অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয় সন্তানের ওপর। আমাদের ভাই-বোনদের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। আব্বা শুধু আমাদের সাধ্যের সবটা দিয়ে চেষ্টা করতে আমাদেরকে বাধ্য করত।
নিজের সক্ষমতা থাকার পরও পরিস্থিতির চাপে আব্বা পড়াশোনাটা চালিয়ে নিতে পারেনি। তাই তার ইচ্ছা- যে করেই হোক সন্তানদেরকে তার মানুষ করা চাই-ই চাই। তাই আব্বার কড়া শাসনের মধ্যে কেটেছে আমাদের শৈশব-কৈশোর।  আমাদের সেই নিয়ন্ত্রিত শৈশব-কৈশোরের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা ছিল আমাদের দাদি। 

একদিন আব্বার অনুপস্থিতিতে খেলতে গিয়েছিলাম। মজা করে খেলেও ছিলাম খুব। কিন্তু হঠাৎ হাতে ব্যথা পেয়ে 'রিটায়ার্ড হার্ট ' হয়ে বাড়ি ফিরে আসি। একে তো আব্বার চোখে ফাঁকি দিয়ে খেলতে যাওয়া, তার ওপর ব্যথা পেয়ে বাড়ি ফিরে আসা। তাই শরীরের দুঃখ শরীরেই চেপে রেখে সন্ধ্যাবেলা চুপচাপ পড়তে বসে ছিলাম। 

তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। তাই আমাদের জন্য নিয়ম এমন ছিল যে, গরমের সময় রাতের বেলা উঠানে মাদুর বিছিয়ে কুপি কিংবা হারিকেনের আলোয় পড়তে হতো আর শীতের সময় গরম কাপড় গায়ে দিয়ে বাড়ির একমাত্র টেবিলটাতে পড়তে হতো। হেমন্তের শেষে শীতের আগমনী বার্তায় সে রাতে পড়ালেখার আয়োজন করা হয়েছিল ঘরের মধ্যে স্থাপিত বাড়ির একমাত্র টেবিলটায়। ঘরের মধ্যে অবস্থান করায় সে সময় ধরা পড়ার আশঙ্কা কমই ছিল। কিন্তু হাতের ব্যথা আর সহ্য হচ্ছিল না। এদিকে হাতটা ফুলেও গিয়েছিল অনেক। ব্যথার কারণে পড়ায়  মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। আহত হাতটি ডান হাত হওয়ায় ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল অনেক বেশি। সময়ের সাথে সাথে হাতের ব্যথা বেড়েই চলছিল, সাথে সাথে বাড়ছিল আমার শিশুমনের ধরা পড়ার আশঙ্কা। সেই সন্ধ্যায় পড়া বাদ দিয়ে আমাকে ভাবতে হয়েছিল অনেক ভাবনা। 

প্রথমত, আব্বার চোখে ফাঁকি দিয়ে খেলতে গিয়েছিলাম। এই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের প্রথম ধাপেই তা বের হয়ে আসবে। তারপর আব্বা নিশ্চয়ই রাগ করবে। আবার খেলতে গিয়ে ব্যথা পাওয়াটা আমার দ্বিতীয় অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হবে। ব্যথা পাওয়ায় যেহেতু একবেলার পড়ালেখা নষ্ট হয়েছে, তাই এটি হবে আব্বার কাছে আমার তৃতীয় অপরাধ। যদি পরবর্তী সময়ে সে ব্যথার জন্য আরও কয়েকবেলা পড়া নষ্ট হয়, তাহলে অপরাধের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। 

দ্বিতীয়ত,খাবার যেহেতু ডান হাত দিয়েই খেতে হবে, তাই খাওয়ার সময় আম্মার কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা ছিল। আম্মার কাছে ধরা পড়লে আম্মা মন খারাপ করবে। সেই রাতের বেলা আমার জন্য ওষুধ আনানোর বিড়ম্বনায় পড়তে হবে তাকে। আব্বা বিষয়টা জেনে গেলে আম্মাকে এর জন্য কারণ দর্শাতে হবে। এই সময় আম্মার মুখটা যে কতটা মলিন হবে, তা ভেবেই চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। 

তৃতীয়ত, আমার দাদি যদি টের পায় যে খেলার সময় কেউ আমাকে ব্যথা দিয়েছে, তাহলে আমার সে খেলার সাথী এবং তার পরিবারে সে রাতের ঘুম হারাম হবে। উপরন্তু, আমার দাদির অনড় অবস্থানের কারণে সে বেচারার বাবা-মার অনিচ্ছা সত্বেও তাকে বেদম প্রহার করার সমূহ আশঙ্কা আছে। এই তিন রকমের চিন্তায় আমার ব্যথা গৌণ বিষয় হয়ে ওঠেছিল। আমার তিন নম্বর আশঙ্কাই সত্যি হয়েছিল,  এবং বেদমভাবেই সত্যি হয়েছিল। 

আমার বড় ভাই-বোনদের ব্যবহার করা হারিকেনটা পুরাতন হয়ে যাওয়ায় সেটা আর ব্যবহার উপযোগী ছিল না। তাই কুপির আলোতেই পড়ালেখার বন্দোবস্ত হয়েছিল সে রাতে। মুশকিল ছিল এই যে, কুপিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ তেল থাকার পরও তা বারবার নিভে যাচ্চিল। তাই আমাকেও উঠানের রান্নাঘর থেকে বারবার আগুন আনতে হচ্ছিল কুপির জীবনপ্রবাহ টিকিয়ে রাখার জন্য। 
হেমন্তের শীতের আমেজে নিজেকে উষ্ণ রাখার জন্য আমার দাদি চুলার পাশে পিড়িতে বসে আগুন তাপাচ্ছিল। আম্মা রান্নার কাজে ব্যস্ত হওয়ায় দাদিই পাটকাঠি দিয়ে আমার কুপিতে আগুন দিচ্ছিল। প্রথমবার আগুন নেওয়ার সময় দৈবক্রমে বেঁচে গেলেও দ্বিতীয়বার আর আহত হাতটাকে আমার দাদির তীক্ষ্ণ দৃষ্টির কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পারলাম না। তারপর সে রাতে যা ঘটেছিলি, এমন ঘটনা দেখেই হয়তো সমাজে "লংকা কাণ্ড" বাগধারাটির প্রচলন হয়েছিল। 

প্রথমবার যখন আগুন নিতে গিয়েছিলাম, তখন দাদি আম্মার সাথে কী বিষয়ে যেন কথা বলছিল।  তাই আমার হাতের দিকে তার নজর পড়েনি। দ্বিতীয়বার আগুন দেওয়ার সময় দাদির অন্যকোনো ব্যস্ততা ছিল না। তাই পরিপূর্ণ মনোযোগের সাথে দাদি আমার কুপিতে আগুন দিতে সচেষ্ট হলেন। আমার দুর্ভাগ্যের শুরু এখানেই। কুপিতে আগুন দেওয়ার সময় পাটকাঠির আগুনের আলোতে আমার হাতটা দাদির চোখে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়। প্রথমেই যত ঘরোয়া চিকিৎসা আছে, তার ব্যবস্থা করার জন্য দাদি অস্থির হয়ে গেল। যথাসম্ভব চিকিৎসার বন্দোবস্তও করা হলো। কিন্তু চিকিৎসা চলাকালীনই আমাকে আমার দাদির তদন্তের সম্মুখীন হতে হলো। শত চেষ্টা করেও সত্য লুকাতে ব্যর্থ হলাম! দাদির ভালোবাসার তীব্রতার অভ্যুত্থানে প্রকম্পিত হলো চারপাশ। সে রাতে খেলার সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে আমাকে আঘাতকারী সে ছেলেটি ও তার বাবা-মায়ের প্রতি প্রবল প্রতাপে আছড়ে পড়েছিল আমার দাদির তীব্র মাত্রার নাতিস্নেহ! 

শুরুটায় দাদির অতিতৎপরতায় আম্মার প্রতিক্রিয়া অবলোকনের অবকাশ আমি পাইনি। কিন্তু নাতিস্নেহে পাগল দাদির পাগলামি থামানোর সময় আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় আম্মাকে হঠাৎ সক্রিয় হতে দেখি। আম্মা দাদিকে বারবার এটাই বোঝাতে চেয়েছিল যে, যা ঘটেছে, তা অসচেতনভাবেই ঘটেছে। তাই এসব নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করা ঠিক না। কিন্তু দাদির গর্জনের কাছে আম্মার মৃদু আহবান পাত্তা পায় কী করে! বিশেষত, যখন বাড়ির সব মানুষ মিলেও দাদিকে থামাতে পারেনি! দাদির এলাহী কাণ্ডে সে সময় সংকোচবোধ করলেও সারাজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দাদির মতো ভালো কেউ বাসেনি আমাকে। তার আবেগের ঝড় থেমে গেলেও সে রাতে আমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে পারছিলাম না। যদিও পরম মমতায় সে আমাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছিল। কারণ আব্বা তখনও দোকান থেকে বাড়ি ফিরেনি। 

অপ্রত্যাশিত অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো আব্বার বাড়ি ফেরার মাধ্যমে। বাড়ি ফেরার পথে ঘটনা সম্পূর্ণটাই তার জানা হয়ে গেছে। সে যে সব জেনে গেছে এখানেই ভয়। বাড়ি ফিরেই আব্বার হুংকার শুরু হয়ে গেল। আব্বা তার বাবাগিরি দেখাচ্ছে, দাদি দেখাচ্ছে দাদিগিরি। আব্বা আমাকে একটা বকা দেয়, তো দাদি আব্বাকে দশটা বকা দেয়। আব্বা যখন দেখল যে, তার মায়ের কাছে নিজের বাবাগিরি ছুটে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে, তখন সে রণে ভঙ্গ দিল। আম্মা চিরকালই ছিল  আমাদের জন্য কাস্টিং ভোটের মতো। আব্বার কড়া শাসনের হাত থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে আমার একমাত্র রক্ষাকবচ ছিল দাদির স্নেহমাখা প্রশ্রয়। 

শৈশবের পুরোটা এবং কৈশোরের বেশিরভাগ সময় আব্বার প্রত্যক্ষ শাসনে থাকার পর মাধ্যমিক পাস করে পড়ালেখা করার জন্য শহরে চলে আসি। আব্বা সাথে না থাকলেও আব্বার শাসন-বারণগুলো কেন যেন আমার পিছু ছাড়ত না, যদিও বাড়ির বাইরে চলে আসার পর কখনোই আব্বা আর প্রত্যক্ষভাবে শাসন করেনি। তারপর কেটে যায় বহু বছর।  
কিন্তু আমি শৈশব থেকে শুরু করে যৌবনের বেশ বড় একটা সময় পর্যন্ত আব্বার কঠিন মূর্তি ছাড়া নরম রূপ দেখিনি।  ভাবতাম বড় হয়ে আমি আব্বার চেয়ে ভালো বাবা হবো। কেটে গেল আরও অনেক বছর। আমার বিয়ে হলো, সংসার হলো, সংসারে সন্তান এলো। মাত্র চার বছরের পিতৃত্বের অভিজ্ঞতা থেকে আত্মমূল্যায়ন করতে গেলে নিঃসংশয়ে বলতে পারি যে, আমার আব্বা আমার চেয়ে ভালো বাবা। যদিও প্রতিটি বাবাই চান তার সন্তান তাকে অতিক্রম করে যাক, কিন্তু কোনো সন্তানই আসলে বাবাকে অতিক্রম করতে পারে না। বাবারা সবসময়ই অনতিক্রম্য।