দেশ বিদেশের কথা সাহিত্যে রেল ভ্রমণের বহু অভিজ্ঞতার কথা বিশ্ববিখ্যাত লেখকগণ নানা রঙে রাঙিয়ে বর্ণনা করেছেন। এমন কি ট্রেন ভ্রমণের বিষয়াদি নিয়ে চলচ্চিত্রও কম হয় নি। এ সব কিছুই পাঠকগণের অবিদিত নয়। তারপরও সময় বদলাচ্ছে। লোকজনের রুচিবোধ,মন মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে। ট্রেনের মানোন্নয়ন হয়েছে।যাত্রী সেবাতেও যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন অনুষঙ্গ। ট্রেন যাত্রার অভিজ্ঞতায়ও নতুন নতুন প্রসঙ্গ যুক্ত হচ্ছে।
সে সব অভিজ্ঞতা কোন কোনটা পাঠকদের সাথে শেয়ার করার মত আবার কোন কোনটি শেয়ার করার মত নয়। যেমন আমি একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখনও যমুনা সেতু হয় নি। উত্তর বঙ্গের ট্রেনগুলো ঢাকা থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত যেত। যাত্রী সাধারণ স্টীমারে পার হয়ে ওপারে ফুলছড়ি ঘাটে ট্রেনে উঠত। তো আমি ফুলছড়ি ঘাটে গিয়ে মাছের বিল স্টেশনে ট্রেনে উঠলাম।ভালই চলছিল কিন্তু ভরতখালী স্টেশন পেরিয়ে ব্রীজের উপর কয়েকটি কম্পার্টমেন্ট থাকতেই ট্রেনটি হুট করে থেমে গেল। আমি ব্রীজের উপর দাঁড়ানো বগিতে ছিলাম। কৌতূহল বশতঃ জানলা দিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই দেখলাম যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে নিচে লাফিয়ে পড়ছে। কে যে কার উপর পড়ছে তার কোন হিসেব নেই। লাফাচ্ছে তো লাফাচ্ছেই। ঘটনাটা কী তা বোঝা যাচ্ছিল না। আন্তঃনগর ট্রেন চালু হয় নি তখনও । ট্রেনের ভেতর দিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাবার উপায় ছিল না। সে কারণে সামনে বা পেছনে কী ঘটেছে সেটা অনুমান করা যাচ্ছিল না।
হুজুকে বাঙ্গাল বলে বহুল প্রচারিত একখানা প্রবাদ আছে। সেটা এখন আরেকবার প্রমাণ হল।আমার বগি যেহেতু রেল সেতুর উপর দাঁড়ানো তাই নদীর পানিতে ঝাঁপ দেয়ার ক্ষেত্রে দুর্বল চিত্তের যাত্রী যারা তারা ইতস্তত করছিল আর সবল চিত্তের অধিকারীগণ জীবনের মায়ায় নদীতে লাফ দিয়ে পড়ছিল।
আমারও জীবনের প্রতি অস্বাভাবিক মায়া ছিল কিন্তু মৃত্যুর চাইতে পৌষ মাসের পড়ন্ত বেলায় নদীর হিম শীতল জল আমার কাছে ভীতিকর মনে হচ্ছিল। জীবন মৃত্যুর মাঝে আমি তখন নেই।আমি আছি মৃত্যু আর শীতের মাঝামাঝি। ঠিক এই সময় বগিতে থাকা টিটি সাহেব যাত্রীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলছেন, আপনারা কেউ ঝাঁপ দেবেন না। সামনে দুটো বগি লাইনচ্যূত হয়েছে।কোন ভয়ের কারণ নেই। আমি যেহেতু জানলার কাছে, পাছে আমি লম্ফঝম্প শুরু করি এই আশঙ্কায় টিটি সাহেব আমার কাছে এসে বললেন, দেখুন, এটা স্টিল বডি গাড়ি। উল্টে গেলে গাড়ির ভেতরে হয়তো একটু ডালে চালে খিচুড়ি হবেন তবে মরার কোন সম্ভাবনা নেই। আর ঝাঁপ দিলে আঘাত পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। হয়তো নাক কাটা যাবে। নয়তো ঠোঁট, গাল, হাঁটু আর ভাগ্য বেশি খারাপ হলে জানটাও যেতে পারে। তিনি আমাকে বললেন, ঝাঁপ দেবেন না। আমি বললাম, কিছুতেই না। নদীর ঠাণ্ডা জলে চুবানি খেয়ে মরার চেয়ে ট্রেনে বসে মরা অনেক আরামের। টিটি সাহেব হা হা করে হাসলেন।
আমি গাড়ি থেকে নামতে পারছি না।কেননা,বগিটি রেলসেতুর উপরে। টিটি সাহেব সহ আমরা আটকে রইলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় কেটে গেল। এমন অবস্থায় এক যাত্রী টিটি সাহেবকে এসে বলল,সাহেব,আমার পেশাবে পেট ফেটে যাচ্ছে। টিটি সাহেব তাকে কামরার টয়লেটে নিয়ে গেলেন কিন্তু সেটার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেক ধাক্কাধাক্কি করা হল কিন্তু না দরজা খোলা গেল না।এদিকে বেচারার পেট ফাটে ফাটে অবস্থা। অগত্যা টিটি সাহেব বললেন, আপনি চুপিচুপি জানলা দিয়ে ছেড়ে দিন। ভাবলেশহীনভাবে বেচারা প্যান্টের চেইন খুলতে লাগল।
বদনসীব আমার। এত এত জানলা থাকতে বেচারা আমার জানলায় এসে দাঁড়াল। কোন প্রকার সংকোচ না করে সে তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আদিম শিশ্নখানি উঁচু করে ধরল। আমার কাছে মনে হল,গভীর নলকূপ দিয়ে ইরিগেশনের কাজ চলছে। এক সময় সে স্বর্গ সুখে উচ্চারণ করল,আহ্! কী আরাম! বলেই পকেট থেকে বিড়ি বের করে আমাকে বলল,ভাই দেশলাই আছে।আমি বললাম, অবশ্যই। আপনি বিড়িটা মুখে ধরেন আমি মুখাগ্নি করছি। বলেই আমি দেশলাইয়ের কাঠি খোঁচা দিয়ে তার মুখের বিড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলাম। সে বলল,আপনার দেশলাই কি আমি ফেরত দিতাম না? আমি বললাম, আরে না। যে ঐতিহাসিক কর্মটি আপনি বীরদর্পে অবলীলায় সম্পন্ন করলেন সেজন্য আপনাকে সম্মান না জানালে সেটা হত ঐতিহাসিক অকৃতজ্ঞতা। লোকটি না বুঝে এবং কম্পার্টমেন্টের সবাই বুঝে হো হো করে হেসে উঠল।
এবার স্বয়ং টিটি সাহেব সম্মুখ প্রকৃতির চাপ অনুভব করলেন। কাউকে না বলে, দু তিন জনকে সাথে নিয়ে গিয়ে টয়লেটের দরজা জোরছে ধাক্কা দিতে লাগলেন। না, খোলা গেল না। টিটি সাহেব বললেন,স্টিল বডি গাড়ি তো। ওখানে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলতেই ভেতর থেকে কে একজন হঠাৎ দরজা খুলে দিল। সবাই অবাক হয়ে দেখল একজন বেরিয়ে আসছে। টিটি সাহেব তাকে ধমক দিয়ে বললেন, এতক্ষণ তুমি টয়লেটে কি করছিলে। লোকটি বলল, আমি বসেছিলাম।
কেন বসেছিলে? লোকটি বললো, সবাই বলছিল গাড়ি উল্টে গেছে।তাই আমি ঘপ করে ওখানে ঢুকে যাই। তা ছাড়া আমার তো টিকিট নাই। তাই ওখানে নিরাপদে লুকিয়ে ছিলাম। রসিকতায় টিটি সাহেবও কম যান না। তিনি বললেন, মিয়া,তুমি যে এত দরকারি জায়গাটা বন্ধ করে রাখলে তখন তো পুরুষ মানুষ না হয়ে একজন মেয়েলোকেরও প্রকৃতি চড়া হতে পারত। ব্যপারটা কেমন হত ভেবে দেখেছ? যাক,তুমি যাচ্ছিলে কোথায়? লোকটি বলল, গাইবান্ধা।
ঠিক আছে তোমার ভাড়া ঢাকা থেকেই আদায় করা উচিৎ। যেহেতু জনস্বার্থ বিবেচনা করে টয়লেটের দরজাটা খুলেছ তাই ফুলছড়ি থেকে গাইবান্ধা পর্যন্ত ভাড়া পরিশোধ কর। লোকটি থ মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল, আমি একটু টয়লেটে যাব। টিটি সাহেব বললেন, তা আর হবে না।একবার গিয়েই যে কেরামতি দেখিয়েছ এবার গিয়ে নিশ্চয়ই ফের বন্ধ করার ফন্দি আঁটছো।
ইতোমধ্যে রিলিফ ট্রেন এসে গেছে। আসলে রেলে বিচিত্র রকমের মানুষ চলাফেরা করে। তাদের নানা আকৃতি,নানা প্রকৃতি,নানা রকম ব্যবহার।
ঢাকা থেকে দ্রুতযান ট্রেনটি যখন গফরগাঁও স্টেশনে এসে থামল তখন এক দশাসই চেহারার ভদ্রলোক উঠলেন। দরজার কাছেই দু সীটের উপর এক ভদ্রলোক বসা ছিলেন। যাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনজন বসে আছেন কেবল মাথাই একটা। বিশাল আকারের উদর। ডানাগুলো মধ্য বয়সী কলাগাছের মত। যে ভদ্রলোক উঠলেন তিনিও মাশাল্লাহ সীটে বসা ভদ্রলোকের চেয়ে বেশি সই কম নয়। তো এক সিটে দোহারা চেহারার একজনকে বসা দেখে বললেন, ভাই, এ সিটে কোন লোক আছে? বসা ভদ্রলোক বললেন, না
-তাহলে একটু চাপেন।
বসা ভদ্রলোক শার্ট উপরে তুলে পেট বুলাতে বুলাতে বললেন, ও আপনি বসবেন? জায়গা থাকলে বসেন।
-- আপনি একটু চাপেন।
আরে ভাই,আমি তো চাপতেই চাই। আমার পেট তো চাপে না।
- পেটের কি দোষ। আগে জিহ্বা শাসন করেন। মনে হয় পারলে তো দুনিয়াটাই এক চুমুকে খেয়ে ফেলেন।
-আর আপনি বুঝি দুনিয়া আখেরাত দুটোই খান। কথায় কয় না? এক পেন্দি আর এক পেন্দিরে কয়,পেন্দি সরে বস্ তোর পেন্দ দেখা যায়।
-তাদের দুজনের আলাপে যাত্রীরা মজা পায়। কেউ একজন বলে,রেল কোম্পানি বড় অবিবেচক। এমন দোহারা আদম সন্তানদের জন্য স্পেশাল সিটের ব্যবস্থা করলেই পারত। রেল ভ্রমণের আনন্দ বেদনা বয়স এবং লিঙ্গভেদে ভিন্নতর হয়।
আমি যখন ঢাকা ইউভার্সিটিতে পড়ি তখন আমার বন্ধু মিরু ডাক্তার হলে আমার সাথে থেকে হোমিও মেডিক্যাল কলেজে পড়ে। একবার হল থেকে রাতের খাবার খেয়ে কমলাপুর স্টেশনে এসে এইট ডাউন ধরলাম বাড়ি যাবার উদ্দেশ্যে। প্রচণ্ড ভীড়।টিকিট কাটিনি মূলত স্বভাব দোষে। আর অজুহাত দাঁড় করেছি যদি সিট না পাই। অবশ্য এটা অসভ্যের আত্মপক্ষ সমর্থন করার কুযুক্তি। সেটাও বয়স দোষেই। সে রাতে হয়তো কোন টিটি সাহেবের বিশেষ কোন আমন্ত্রণে সবাই চলে গিয়েছিলেন তাই বিনা টিকিটের যাত্রীদের জন্য ছিল সেটা শুভরাত্রি।
সারা রাস্তা নির্বিবাদে এসে ধরা খেলাম জামালপুর টাউন জংশনে।গাড়ি থামার সাথে সাথে আমরা প্ল্যাটফর্মে নামতেই দরজার দুইপাশে টিটি আর রেলপুলিশ। মিরুর হাতটা ধরে পাশে টেনে নিয়ে বললেন,টিকিট দিন। আমিও মিরুর পাশেই দাঁড়ালাম। যাত্রীদের মধ্যে যাদের টিকিট নেই তাদের একখানে দাঁড় করাচ্ছেন। আমার কাছে ব্যপারটা উৎসবের মত মনে হচ্ছিল। আজই জীবনে প্রথম বিনা টিকিটের জন্য ধরা খেলাম।জীবনে এ দিনটার গুরুত্বই আলাদা।
তখনও আমাদের সামনে অনেক অভিজ্ঞতার পুকুর সাঁতরানো বাকি। আমাদের দেশের রেল ব্যবস্থাপনার যে ভয়াবহ দুর্নীতি তখন পর্যন্ত এর বিন্দু বিসর্গও জানতাম না। প্রথমে উকিলের মত ক্রস করতে লাগলেন টিটি সাহেব। বললেন, টিকিট কাটেন নাই কেন?
আমি বললাম, টাকা নাই তাই টিকিট কাটি নি।
টিটি বললেন, তাহলে ঢাকা থেকে ভাড়া পরিশোধ করে টিকিট কেটে নিন।
মিরু বলল,টাকা থাকলে তো সেখানেই টিকিট কাটতাম। টিটি সাহেব বললেন, আপনাদের দুজনের ভাড়া বায়াত্তুর টাকা। তারপর কানে কানে বললেন,বিশ টাকা দেন গেইট পার করে দিই।
মিরু বলল,আমাদের কাছে এক কাণা কড়িও নেই।
-আপনারা করেন কি?
আমি ভাবলাম যদি বলি ছাত্র তাহলে ইউনিভার্সিটির সম্মান হানি হবে। বললাম, আমরা রাজমিস্ত্রীর কাজ করি। টিটি বললেন,তাহলে কোন টাকা পয়সা নেই?
আমরা এক বাক্যে বলি,না।
পুলিশ ডেকে বললেন, এদের নিয়ে যাও।
এবার পুলিশ বলে, চলেন
আমরাও বলি চলেন।
আপনাদের নামে তো মামলা হবে
মিরু বলে,ভালই।জেল হবে কতদিনেআনুমানিক?
কেন?
কয়দিন জেল খেটে দেখতাম জেলে কেমন খাবার দাবার দেয়। আমাদের স্টেশনের একটি কামড়ায় গরুর খোয়াড়ের মত একটা ঘেরাওয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। সুপ্রশস্ত একটা বেঞ্চি। দু বন্ধুতে আরাম করে বসে স্টার চুরুটে আগুন ধরালাম।টানে টানে সুখ টান। গোল্লায় যাক দুনিয়া।
আমাদের এমন নির্বিকার সুখ দেখে রেল সিপাই বলল,আপনাদের বাড়ি যাওয়ার চিন্তা নাই। আপনারা বললেন, পকেটে পয়সা নেই তো এত সিগারেট যে টানছেন পয়সা কোত্থেকে আসে?
আমি বললাম, অজগরের আহার আল্লায় যোগায়।
পুলিশ বেটা আমাদের কাছাকাছি এসে কণ্ঠ নিচু করে বলল, আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট দিতে পারবেন?
মিরু এক প্যাকেট সিগারেট বের করে বলল, দুইটা কম আছে চলবে?
সে হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটি নিয়ে বলল, আপনারা চলে যান। আমি বললাম, সে কী কথা? আমাদের না জেলে যেতে হবে? পুলিশ হেসে বলে,কার দায় পড়ছে গাঁটের টাকা খরচ করে মামলা করতে যাবে। আপনারা চলে যান ভাই। অগত্য আর কী করা। এমনই মূল্যহীন ক্রিমিনাল আমরা জেলে যাবার মত একটা মামলাও আমাদের ভাগ্যে জুটল না। আপনারা যারা আমার গল্পটি শোনছেন তারা যদি অভয় দেন তাহলে রেল ভ্রমণের মহাসাংঘাতিক অভিজ্ঞতাটি আপনাদের সাথে শেয়ার করতে পারি। একথাটি এজন্যই বলছি যে ঘটনাটি শুনলে আমার সচ্চরিত্র সম্পর্কে আপনাদের ধারণায় ময়লা জমতে পারে। অবশ্য সচ্চরিত্র হওয়ার মত উন্নত চরিত্রবান মানুষ আমি নই। হ্যা তাহলে শুনুন।
লোকাল ট্রেন সম্পর্কে কমবেশি ধারণা সবারই আছে।বিশেষ করে গত শতাব্দীর আশি নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত। লুকাল ট্রেনের যাত্রীদের ভীড় ইংরেজ ঐতিহাসিকগণের ব্ল্যাকহোল হত্যাকাণ্ডের কাহিনিকেও হার মানায়।
আমার সহকর্মী কবি আতাউর রহমান সাহেবের বাড়ি জামালপুর জেলার নুরুন্দি স্টেশন সংলগ্ন গোপালপুর গ্রামে। আমি বাড়ি থেকে ফেরার পথে একবার তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করি।
পরদিন আতাউর সাহেব আমাকে নুরুন্দি রেল স্টেশনে লুকাল ট্রেনে উঠিয়ে দিতে আমার সাথে স্টেশনে এলেন। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল।আমরা এক রকম ভিজেই স্টেশনে পৌঁছলাম। তখনও ট্রেনের খবর হয় নি। কখন খবর হবে সে খবরও কেউ বলতেও পাচ্ছে না। অতএব অপেক্ষা। অপেক্ষা মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ।এদিকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মুষলধারায় রূপ নিচ্ছে। প্রায় পৌণে একঘণ্টা পর ট্রেনের খবর হল। ততক্ষণে যাত্রীর সংখ্যা পিঁপড়ের জাঙালকেও ছাড়িয়ে গেছে।
জামালপুর থেকে ময়মনসিংহ জংশন পর্যন্ত স্টেশনের সংখ্যা চিরুনির দাঁড়ার মত ঘন। তার উপর লোকাল ট্রেনের গদাই লস্করি চাল চলন।
এবার ট্রেন এসে থামল। পাঁচ টাকা দিয়ে ময়মনসিংহ জংশন পর্যন্ত সেকেন্ড ক্লাস টিকিট কেটেছি। আতাউর সাহেব আর আমি বৃষ্টিতে ভিজে সেকেন্ড ক্লাস কামরার দরজায় গিজগিজে ভীড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। মানুষ উঠছে তো উঠছেই।অনেক কষ্টে হালকা পাতলা ব্যাগটি যে এতক্ষণ ছাতা হিসেবে মাথায় চড়ে ছিল সেটা মাথায় নিয়েই কোনভাবে কামরায় ঢুকলাম। ভেতরে সাপের মুখ ঢুকানোর মত জায়গা নেই। ট্রেনের ছাদ চুয়ে বৃষ্টির পানি পড়ছে। ভ্যাপসা গরমে জীবন যায় যায় অবস্থা। ট্রেন ছাড়ার পর আমার শরীরের সাথে চিড়েচ্যাপটা হয়ে পেছনে যে দাঁড়িয়েছিল সে প্রায় বিশ পঁচিশ বয়সী এক মেয়ে। পেছন থেকে তার চাপ থেকে বোঝা যাচ্ছিল সে স্বাস্থ্যবতী। কেননা তার নরম শরীর আমার পিঠে সেঁদিয়ে যাচ্ছিল। আর গরমে অতিষ্ঠ হয়ে মেয়েটি আমাকে পেছন থেকে জোরেশোরে ঠেলছিল এবং বলছিল, ঠেলা দেন না। জোরে ঠেলা দেন। আমি সামনে যে ঠেলা দিব সে যো নেই। আমার মনে হচ্ছিল মানুষের ভীড়ে আমি শূন্যে ঝুলে আছি। আমি মেয়েটির অনবরত ঠেলাকাব্য শুনে বিরক্ত হচ্ছিলাম।অতিষ্ঠ হয়ে শরীরের সকল শক্তি দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। তারপর মেয়েটির মুখোমুখি হয়ে ঠেলতে শুরু করলাম।আমি জানি যে কর্মটি করছি তা অনৈতিক তবু রাগ বলে কথা। যদিও সে রাগের গভীরে অসমর্থিত অনুরাগের ছোঁয়া যে ছিল না তা নয়। মেয়েটি চেঁচিয়ে বলছে,আরে! আমাকে ঠেলছেন কেন? আপনি তো আচ্ছা লোক দেখছি!
আমি বললাম, আপনিই তো এতক্ষণ ধরে ঠেলতে বলছেন। তাই তো ঠেলছি। তো বিরক্ত হচ্ছেন কেন। আপনি তো অনেকক্ষণ ধরে আমাকে পেছন থেকে ঠেলেছেন।তাই বলে আপনি আমাকে ঠেলবেন? আমার আর কিছু বলতে হল না।বয়াতী যেমন গান তুলে দেয় আর দোহাররা সমস্বরে সে গান নিজেদের কণ্ঠে তুলে নেয় তেমনি ট্রেনে আমার বয়সী যাত্রীরা বলতে লাগল মারেন ঠেলা।হেইয়ো। ইতরের স্যাঙাতের অভাব হয় না। ট্রেনের ইতর যাত্রীদের কাছেও আমি মুখার্জি,ব্যনার্জীর মত ঠেলার্জি হয়ে উঠলাম।