logo
আপডেট : ৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১১:০৫
বিবিসি বাংলার বিশ্লেষণ
তবুও কেন বিএনপি হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে?
নিজস্ব প্রতিবেদক

তবুও কেন বিএনপি হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে?


নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দশম বারের মতো ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিরোধী দল বিএনপি।

বুধবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত এই অবরোধ কর্মসূচি চলবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সারাদেশে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আসছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। ২৮শে অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত দলটি নয় দফায় অবরোধ ও হরতালের মতো কর্মসূচি পালন করেছে।

কিন্তু দফায় দফায় ঘোষিত এই কর্মসূচির শুরুর দিকে যতটা কার্যকরভাবে পালিত হতে দেখা যাচ্ছিলো, শেষ দু’দফায় তেমনটা দেখা যায়নি। কিন্তু তারপরও এই কর্মসূচি কেন চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি?- এমন প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে।
গত ২৮শে অক্টোবরের পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট দশবার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। তাদের এই কর্মসূচির প্রথমদিকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে যান চলাচল কম দেখা যাচ্ছিলো। তখন দূরপাল্লার বাস যেমন বন্ধ ছিল, তেমন দোকান-পাটও কম খোলা হচ্ছিলো।

কিন্তু শেষ কয়েক দফায়, বিশেষ করে গত মধ্য নভেম্বরের পর থেকেই ঢাকা ও ঢাকার বাইরের হরতাল-অবরোধের প্রভাব কমে আসতে থাকে।

এমনকি সোমবার যখন নবম দফায় বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি চলছে, তখনও সারাদেশে মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক দেখা যাচ্ছে।

সন্ধ্যার পর দু-একটি যানবাহনে আগুন লাগার খবর শোনা গেলেও অবরোধ উপেক্ষা করেই সোমবার স্বাভাবিকভাবেই দূরপাল্লার যান চলাচল করতে দেখা গেছে। এছাড়া দোকান-পাট-শপিংমলও স্বাভাবিক দিনের মতই খোলা রয়েছে।

তবে বিএনপি অবশ্য মনে করছে, তাদের ঘোষিত হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি সারাদেশে সফলভাবেই পালিত হচ্ছে।

দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “র‍্যাব-পুলিশকে ব্যবহার করে সরকার আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছে এবং সারা দেশে আমাদের কর্মীদের বাড়িঘরে হামলা চালানো হচ্ছে।''

''কিন্তু এই পরিস্থিতির মধ্যেও আমাদের নেতা-কর্মীরা যেভাবে মাঠে থেকে আমাদের কর্মসূচি সফল করছেন, সেটিই আমাদের শক্তির জায়গা। নেতাকর্মীদের এই শ্রম এবং ত্যাগ বৃথা যাবে না,” তিনি বলেন।
মাঠে নেই নেতা-কর্মীরা
মাঠে থেকে নেতা-কর্মীরা সক্রিয়ভাবে কর্মসূচি পালন করছে বলে মিস্টার রিজভীর পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও বাস্তবে তাদের উপস্থিতি খুব একটা দেখা যায়নি।

বরং গ্রেফতার এড়াতে বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে। ফলে হরতাল-অবরোধ এখন অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

এ বিষয়ে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যেই আমরা হরতাল-অবরোধে ডাক দিয়েছি।''

''আমাদের এসব কর্মসূচির অন্যতম উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে জানানো এবং এটা বোঝানো যে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিকল্প নেই। এই বার্তাটা আমরা গণমানুষের কাছে সফলভাবে পৌঁছে দিতে পারছি বলেই মনে করি,” তিনি বলেন।

এদিকে, এক মাসের বেশি সময় ধরে একই কর্মসূচি দেওয়াকে বিএনপির নের্তৃত্বের দুর্বলতা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গত ২৮শে অক্টোবরের পর বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন। দলটির গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ নেতাই এখন জেলে। ফলে বিএনপির মধ্যে এক ধরনের নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। শীর্ষ নেতারা বাইরে থাকলে হয়তো সবাই মিলে নতুন কর্মসূচি ঠিক করতে পারতো।”

টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি বিএনপির জন্য নতুন কিছু নয়। এর আগেও দলটি একটানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। তবে সেটি এখন থেকে আট বছরেরও বেশি সময় আগে।

২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করার পর ২০১৫ সালে ওই নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে টানা নয় মাস হরতাল-অবরোধ পালন করেছিল দলটি৷

ঐ হরতাল-অবরোধ এক পর্যায়ে সহিংসতায় রূপ নেয়। একের পর এক বাসে আগুন ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের মতো ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হলে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

তখনও একটানা হরতাল-অবরোধ চলতে থাকার এক পর্যায়ে কর্মসূচিগুলো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।

ফলে এক পর্যায়ে সেই কর্মসূচি স্থগিত করে দেয় দলটি।
বিএনপি বিকল্প কিছু ভাবছে?
গত ২৮শে অক্টোবরের পর থেকেই দু-একদিনের বিরতি দিয়ে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি।

শুরুদিকে হরতাল-অবরোধ পালনের সময় সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া সহ দেশের বেশকিছু জায়গায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া কয়েক শ গাড়িতেও আগুন দেওয়া হয়েছে।

এসব ঘটনায় পাঁচ শতাধিক মামলায় ১৮ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতারের দাবি করেছে বিএনপি। এছাড়া গ্রেফতার এড়াতে দলটির নেতাকর্মীদের অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফলে নেতাকর্মীকে কমই মাঠে দেখা যাচ্ছে।

এই বাস্তবতায় হরতাল-অবরোধ ছাড়া নতুন কোন কর্মসূচি ঘোষণার কথা ভাবছে বিএনপি?

“সময়ের প্রয়োজনেই নতুন নতুন কর্মসূচি নির্ধারণ করে বিএনপি। শীর্ষনেতারা আলোচনা করেই এগুলো ঠিক করেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানুষের ভোটের অধিকার আদায়ে হরতাল-অবরোধকেই যুৎসই বিবেচনা করা হয়েছে।'' -বিবিসি বাংলাকে বলেন বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল।

''সাধারণ মানুষও আমাদের সমর্থন দিচ্ছে। তারপরও যদি নতুন কর্মসূচি নেয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়, শীর্ষনেতারা অবশ্যই সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবেন,” তিনি বলেন।

এদিকে, নতুন কর্মসূচি ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নতুন কর্মসূচির কী হবে, সেটি শীর্ষনেতারা আলোচনা করে নির্ধারণ করবেন। কিন্তু নতুন কর্মসূচির ঘোষণা না আসা পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাওয়া হবে বলেই আমি মনে করি।”

তফসিল ঘোষণার আগ থেকেই বিএনপির মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে নতুন কর্মসূচির বিষয়টি বেশ আলোচনায় ছিল। তখন শোনা যাচ্ছিলো, তফসিল ঘোষণার পর দলটি নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দিবে।

কিন্তু তফসিলের পর বিএনপি আগের মতই হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যায়। আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা না দেওয়ায় কেউ কেউ ভাবছিলেন যে, দলটি হয়তো নির্বাচনে যাবে। কিন্তু গত ৩০শে নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমার সময় শেষ হওয়ায় সে আশাও এখন আর নেই।

এ অবস্থায় নতুন কোন দিক নির্দেশনা না পেলে দলটির নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “শুরুর দিকে বিএনপি নেতা-কর্মীদেরকে আমরা বেশ সক্রিয়ভাবেই আন্দোলন করতে দেখেছি। কিন্তু গত একমাসে দৃশ্যপটে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তাদের নেতারা জেলে, কর্মীরাও অনেকে ঘরে থাকতে পারছেন না।''

''এছাড়া সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে সরকারের ওপর বিদেশি যে চাপ দেখা যাচ্ছিলো, সেটিও এখন খুব একটা দৃশ্যমান নয়। ফলে নতুন দিক নির্দেশনা না পেলে বিএনপিকর্মীদের মধ্যে হতাশা কাজ করতেই পারে,” বলছেন ড. নাসরিন।

অন্যদিকে, বর্তমান বাস্তবতায় হরতাল-অবরোধের মত কর্মসূচি দিয়ে দাবি আদায় করা বিএনপি’র জন্য কঠিন হবে বলে মনে করছেন আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, “এক সময় হরতাল-অবরোধের কার্যকারিতা ছিল। কিন্তু এখন দাবি আদায়ের অস্ত্র হিসেবে এগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। এখন যে অবস্থা তাতে দিনের পর দিন মানুষ এটি সমর্থন করবে না। কাজেই তাদের উচিৎ বিকল্প কর্মসূচির সন্ধান করা।”

বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতা কারাগারে, কর্মীদের বড় একটি অংশ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এর মধ্যে দলের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এক ডজনেরও বেশি নেতা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। সব মিলিয়ে দলটি বেশ চাপে আছে বলেও মনে করেন মিস্টার আহমেদ।

“বিরোধী দল এদেশে বরাবরই চাপে থেকেছে। সরকার সেই চেষ্টাই করে। বিএনপিও এখন চাপে আছে। তারা অনেক দিন থেকেই নতুন কর্মসূচি দেয়ার কথা বলে আসছে, কিন্তু তেমন কিছু দিতে দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় দাবি আদায় করা তাদের পক্ষ নি:সন্দেহেই কঠিন হবে,” বলছেন মহিউদ্দিন আহমেদ।