আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষী এবং অন্তরঙ্গ বন্ধু আমাকে বললো, তুমি আজেবাজে লেখা বাদ দিয়ে একটা আত্মজীবনী লিখো। তার মতে আমার জীবনের ঘটনাবলী,আমার কর্ম অকর্ম এবং আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে মহাকাব্যের উপাদান নিহিত আছে। তাই নজুফজু কবি হওয়ার চাইতে এক হোমার হওয়ার চেষ্টা করা উচিৎ।
বেশ কদিন থেকে তার কথাটা আমার মাথায় ঘুরছিল। বলা যায় তার প্রস্তাবের প্রভাবে আমি বেশ কয় রাত আমার জীবনের ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবলাম।ভেবে ভেবে কয়টি বিষয় আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হল।
আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলেও অন্য সবার কাছে সে সব বিষয় যে নির্মল হাসির উপাদান ছাড়া আর কিছুই হবে না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কারণ সব মহৎ কর্ম যেমন সবাইকে দিয়ে হয় না তেমনি সব অপকর্মও সবাই করতে পারে না। আমার বিষয়টি মহৎ কর্ম না অপকর্ম সে বিষয়ে বিতর্ক চলতে পারে তবে আমার সিদ্ধান্তমতে তা খাঁটি অপকর্ম।
জীবনের অজস্র ঘটনা দুর্ঘটনার বিশাল সমুদ্র থেকে তুলে আনা ঘটনাটির বয়ান লিপিবদ্ধ করলেই বিষয়টি স্বচ্ছ জলের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
আমি সেই সময়ের কথা বলছি যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। স্কুল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। তখন তারুণ্যের হাওয়া আমাদের গায়ে লেগেছে। সবকিছুতেই থোড়াই কেয়ার একটা ভাব। সারাদিন দলবেঁধে কাজ অকাজে ব্যস্ত থাকা আর রাত হলে যা করা তার বর্ণনা না দেয়াই ভাল। তবে মাঝে মাঝে গভীর রাতে দূরে বা কাছে কোথাও কোন শব্দ হলে মিলিটারি মিলিটারি বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করা আমাদের অন্যতম কর্তব্য ছিল।
আশ্বিন মাসে হালকা কুয়াশা ভেজা স্বচ্ছ জোছনায় আমরা গ্রামের দক্ষিণ দিকে ব্রীজের উপর বসে পাঁচমিশালি ইচ্ছে সংগীত চর্চা করছি। তখনও রাত তেমন গভীর হয় নি। উত্তর দিক থেকে ঢোল, খোল হরতালের জোরালো শব্দ ভেসে আসছে।
আমরা সবকিছুতেই স্থির থাকতে পারি কিন্তু ঢোল খোল করতালের শব্দ শুনলে পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই আমাদের স্থির রাখতে পারে। অতএব শব্দ অনুসরণ করে আমাদের দুষ্ট কাফেলা উত্তর দিকে যেতে শুরু করল।
গ্রামের একেবারে উত্তরে বিহারি মুচিদের বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। সারিবদ্ধ বাড়িগুলো থেকে এ বাড়িটা বিচ্ছিন্ন। হয়তো জাত-পাতের কারণে নয় তো বা নিজেদের জমিজিরাত না থাকায় অন্যের দেয়া জমিতে বাস করতে হয় বলে। তবে জাতপাতের বিষয়টি ঠিক নাও হতে পারে। কেননা ছোটবেলা থেকেই তাদের দেখে আসছি সবার সাথে মিলেমিশেই সামাজিকতা রক্ষা করে চলছে।
অত্যন্ত পরিপাটি ঘরদোর। নিকোনো পরিচ্ছন্ন উঠানে চাঁদের ধবধবে জোছনা ঠিকরে পড়ছে। সেই জোছনায় ভিজে মুচিরা অবিরাম গেয়ে চলছে। তাদের গানের ভাষা না বুঝলেও সুরের মায়া এবং বাদ্যের ঝংকারে আমরা অজানা মোহের সাগরে যেন সাঁতার কাটছি।
শান্তির বিয়ে। শান্তি মুসাওয়া আর সামারুর বোন। ওদের বাবা ভুটিয়া। বিয়ের নিয়ম কানুন মত যা কিছু করার করছে।
আমাদের মত গ্রামের আরও অনেকে উঠানের নিকনো স্বচ্ছতায় পশ্চাদ্দেশ এলিয়ে দিয়ে সবাই গান বাজনা শুনছে। আবার কেউ কেউ পান চিবোচ্ছে। সবাই গানবাজনায় এখন মাতোয়ারা।
হঠাৎ আমাদের বন্ধু পেরু এসে আমার কানে কানে বলল, এদিকে আয়, দেখে যা ওগুলো কি।
আমি পেরুর সাথে বাইরে এলাম। পেরু সামারুর বাইরের ঘরের বারান্দার দিকে যেতে লাগল আমিও ওকে অনুসরণ করতে লাগলাম।
সামারুর ঘরের বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে সে আমাকে বলল, দেখ ওগুলো কি?
আমি পণেরো বিশটার মত মাটির হাঁড়ি দেখতে পেলাম।সারি সারি বসানো রয়েছে। মুখগুলো বাঁধা।
আমি পেরুকে বললাম, ওগুলো কি?
পেরু আসলে সবজানে। এই মুচিদের বাড়ির ইনালার সাথে সে ইস্কুলে পড়ে। মাঝে মাঝে ইস্কুলের টিফিন পিরিয়ডে ইনালাদের বাড়িতে এসে সে।খাওয়া-দাওয়াও করে।
গতবছর সুখচানের মেয়ের বিয়েতে শুয়োর মারা হয়েছিল।শুয়োরের কাঁচারক্তে চালভাজা ভিজিয়ে যে সুস্বাদু খাবার তৈরি হয়েছিল সেটা পেরু পরম তৃপ্তির সাথেই খেয়েছিল। আর এসব গল্প যখন সে আমাদের কাছে বলতো তখন সে এমন ভাব দেখাতো যেন শুয়োরের তাজা রক্ত তখনও তার গালে লেগে রয়েছে।
পেরু বলল, গাধা, ওগুলো মাল।
আমি বললাম, মাল আবার কি? কীসের মাল?
সে বলল, মাল মানে হাতে তৈরি মদ। মুচিরা ওগুলো পান করে। কোন অনুষ্ঠান হলে অতিথিদের জন্য বেশি করে তৈরি করে রাখে।
আমি বললাম, তো আমি এসব দেখে কী করব? আমি তো আর মদ খাই না।
সে ঝাঁঝালো গলায় বলল, খাস নাই তাতে কি এখন খাবি।
তুই এখানে দাঁড়া আমি সবাইকে ডেকে নিয়ে আসি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধুদের নিয়ে সে ফিরে এলো। মনে হয় বন্ধুদের সাথে এরই মাঝে সে পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলেছে। এসেই ঘপাঘপ প্রত্যেকেই একটি করে হাঁড়ি হাতে নিল এবং আমার হাতেও একটি ধরিয়ে দিল। আমি কিছুই বুঝতে পাচ্ছিলাম না। যা হোক
সেই মদের হাঁড়ি নিয়ে আমরা ইস্কুলের মাঠে আম গাছের নিচে গিয়ে বসলাম। এখন কীভাবে কোথায় এই মদ পান করা যাবে তাই নিয়ে আলোচনা চলল।
আমাদের যে বয়স সে বয়সে মদপানের অভিজ্ঞতা কারোরই ছিল না এবং সঙ্গত কারণেই থাকার কথাও নয়। কেননা, তখনও দেশের আনাচেকানাচে মদের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে নি। সামাজিক সমস্যা অপ্রকট থাকায় হতাশার পারদ নিম্নমুখী ছিল ফলে হতাশাকে বিস্মৃতির চাদরে ঢাকা দেয়ার জন্য মদ্যপানের রীতি তখনও চালু হয় নি। দেশে সবকিছুই অনুন্নয়ের জোয়ারে ভাসত তাই মদ্যপানও উন্নয়নের পথ পায় নি। আজ সমাজ আধুনিক হয়েছে। রমরমা উন্নয়নে মদ্যপানই বা পিছিয়ে থাকবে।কেন।
পেরু বলল, আমাদের খুব সাবধানে মদপান করতে হবে। কেননা, আমি যখন মুচিদের মদপান করতে দেখেছি তখন লক্ষ করেছি ওরা মদপানের পর আজগুবি সব কথাবার্তা বলে। মা বোন খেয়াল থাকে না। হাজার রকমের গালিগালাজে পরিবেশ দূষিত করে তুলে। তাই আমরা যদি উন্মুক্ত স্থানে মদ গিলে ফেলি এবং আমাদের যদি তেমন অবস্থা হয় তাহলে প্যাদানিতে পিঠের ছাল থাকবে না।
হবি পেরুর কথাটা সমর্থন করে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেলল। দেখা গেল সবাই হবিকে সমর্থন করল। কেবল আমার মনটাতেই বিষয়টি নিয়ে খচখচানি রয়ে গেল। কেননা, সারাদিন রাত যা ই করি না কেন তা বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে করি। ভোরে বাবা যখন ফজরের নামাজ পড়ার জন্য ডাক দেবেন তখন যদি সাড়া না পান তাহলে পশ্চাদ্দেশে বিরাশি সিক্কা পতিত হবে। তার উপর এ বয়সে মদ গিলেছি সেটা যখন জানতে পারবেন তখন জ্যান্ত থাকতেই কবরের আজাব শুরু হয়ে যাবে। তাই কুসঙ্গ সততার সাথে রক্ষা করে কীভাবে বিপদমুক্ত থাকা যায় মনে মনে সে ফিকির করতে লাগলাম।
হকমিয়া অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। ভাবটা এমন এই মুহূর্তে যদি তার উদরে মদের ধারা নিসৃত না হয় তাহলে নাড়িভুড়ি ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসবে। অথচ সে কোনদিন আঙুলের মাথায় তুলে মদ চেখেও দেখে নি। তার স্বাদের ঔৎসুক্যের পালে প্রবল বাতাস।
হবি আমাকে বলল, কি রে, কী করা যায় বল না। এত কায়দা কৌশল করে মালগুলো আনলাম। তা ছাড়া জীবনে সবকিছুরই কমবেশি অভিজ্ঞতা থাকা দরকার।
আমি বললাম, দেখ কামটা করতে হবে অতিগোপনে এবং নিঃশব্দে। কেননা, জানাজানি হলে মাইরের ঝড় তো আছেই মসজিদে এ নিয়ে বিচারও বসবে। তখন আর কেলেঙ্কারির শেষ থাকবে না।
সবাই আমার কথায় সায় দিল। আমার জন্য তাদের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। আমি সাম্রাজ্যবাদী কৌশলে ধীর ধীরে অগ্রসর হতে লাগলাম।
আমি হকমিয়াকে বললাম, এই হকমিয়া, তুই তো চুরি চামারিতে সিদ্ধহস্ত। তুই গিয়ে মাস্টারের গোয়ালঘর থেকে পাঁচ ছ গাছি দড়ি নিয়ে আয়।
সবাই বলল,দড়ি দিয়ে কী হবে?
আমি বললাম, কী হবে মানে? মদ গিয়ে যখন পিত্তি মধ্যে উথাল পাথাল করবে তখন তো সবাই মাতলামি শুরু করবে। তাই নিজেদের কন্ট্রোলে রাখার জন্য আখের থোবার সাথে দুহাত বেঁধে তারপর মদ গিলতে হবে।
পেরু বলল, দু হাত বাঁধলে মদ গিলবে কি করে?
আমি বললাম, চিন্তা নেই। আমি প্রত্যেকের মুখে ঢেলে দিব। তোরা ঢকঢক করে গিলে খাবি।
_ তুই খাবি না?
-- আমি না হয় তোরা স্বাভাবিক হলে পরে খাবো। আরে একজনকে তো অন্তত পাহারাদার থাকতে হবে। বলা তো যায় না,কখন কি হয়।
সবাই বলল, হ্যা ঠিকই বলেছিস।
হকমিয়াকে দড়ি আনার জন্য পাঠানো হল।
পূর্বদিকে বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে আখ ক্ষেত। রাত বিরেতে মানুষজন এ দিকে তেমন আসে না। কেবল স্কুল সংলগ্ন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা দিয়ে কোন কোন রাতে কন্ট্রোলের
মাল নিয়ে দলবেঁধে গরুর গাড়ি যায়।গাড়ির কাঠের চাকার সম্মিলিত শব্দে আকাশ বাতাস কাঁপতে থাকে। আমরা ঠিক করলাম আখ ক্ষেতের অনেকটা ভিতরে গিয়ে মদ্যোৎসব শুরু করব।
এরই মাঝে হকমিয়া বেশ কিছু দড়ি নিয়ে ফিরে এসেছে।
আমরা চাঁদের জোছনা ভেঙে ভেঙে আখ ক্ষেতে ঢুকছি। ঢুকতে ঢুকতে অনেকটা ভিতরে চলে এসেছি।
এ জায়গাটা সবারই খুব পছন্দ হয়েছে। সবাই হাত থেকে
মদের ভাণ্ড নামিয়ে আমাকে বলল, নে এবার আমাদের সবার হাত একে একে বেঁধে ফেল।
আমি দড়ি হাতে নিয়ে প্রথমেই পেরুর দুহাত শক্ত করে বাঁধলাম। বেঁধে দড়িটা একটু লম্বা করে আখের থোবার সাথে গরুর মত বেঁধে ফেললাম।
পেরু আমাকে বলল, আমাদের নেশা ছুটে গেলে তুই আবার খুলে দিস। তখন আমরা সবাই মিলে তোকে পাহারা দিব। আমি সুবোধ ছেলের মত বললাম, আচ্ছা।
একে একে সবাইকে বাঁধলাম। হকমিয়া বলল, আমাদের আওয়াজ তো কেউ শুনতে পাবে না?
হবি ধমক দিয়ে বলে, আরে শালা! আশেপাশে কোন বাড়িঘর আছে? এতরাতে ভয়ে ভুত পর্যন্ত আসে না। তারপরও যদি আমাদের আওয়াজ কেউ শোনে ভুতের কেওয়াজ মনে করে এদিকে আর আসতে সাহস পাবে না।
মুন্তা একটু ভীতু মনের ছেলে। সে সবাইকে ফিসফিস করে কথা বলতে অনুরোধ করে। কেননা, তাদের এই কলরবে কেউ যদি আবার এসে পড়ে।
হাত বাঁধার পালা শেষ এবার গেলার পালা। আমি একটা হাড়ি টেনে নিয়ে মুখটা খুলতেই অসহ্য রকমের বিশ্রী গন্ধ আমার নাকের ভিতর দিয়ে নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গেল।
নাকটায় যথাসম্ভব শ্বাসরোধ করে রাখলাম। পেরুকে বললাম, এবার হা করত দেখি। পেরু বড় করে হা করল। আমি ওর মুখে খুব দ্রুত পাগলাপানি ঢেলে দিলাম।
হবি হেহেহেহে ইচ্চে রকমের একটা শব্দ করে সবটুকু গিলে ফেলল। তারপর একে একে হবি, হকমিয়া, মুন্তা,বুদু সবাইকে খাওয়ালাম। ওদের পানক্রিয়া শেষ।
আমি চারণক্ষেত্রে গরু ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত রাখালের মত কাছেই বসে পড়লাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পাগলাপানির ক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। ওদের শরীরে রক্ত নাচতে লাগল। মাতৃভাষা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পুরুষালি পৈতৃক ভাষায় ওদের কথা ফুটতে শুরু করেছে।
পেরু বলছে, এই শালার মুন্তার বাচ্চা। কী মজা তাই না রে?
হকমিয়া জড়ানো কণ্ঠে বলছে, মজা মানে, মনটায় কইতাছে আরো খাই।
হবি পা দিয়ে ওর লুঙ্গিটা খুলে ফেলেছে। সে তার উন্মুক্ত শিশ্নের দিকে ইঙ্গিত করে হক মিয়াকে বলছে, এইখান থেকে খা।
অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের কণ্ঠে সঙ্গীতের খবিশ দেবী এসে ভর করল। এত গান যে ওরা গাইতে পারে তা ওরা নিজেরাও জানত না। হবি গাইছে প্রাণপতি গো আমি তোমায় নিয়ে বনে আসিলাম।
হকমিয়া ধমক দিয়ে বলছে, এই শালা, তোরে কোন পুঙ্গিরপুতে কইছে ভাটিয়ালি গাইতে? আল্লাহ নামের গজল গাইতে পারস না। বলেই সে গাইতে শুরু করল, শোনো তাজেল গো, মন না জেনে প্রেমে মইজো না।
বুদু হকমিয়ার পাছায় শক্ত করে লাথি দেয়। শালা, তোর বাপ দাদা চৌদ্দগোষ্ঠী কখনো গান করছে রে? চিৎকার করে সে গাইতে লাগল। বাঁধন ছিড়ে যেও না আমার দাইমা দাই মা গো।
তারপর ওদের সম্মিলিত উচ্ছৃঙ্খল সংগীতে রাতের প্রাণ মুহুর্মুহু কেঁপে উঠতে লাগলো। কেউ গাইছে
লাল ছেরির চুক্কা বুনি কাপড় দিলে ঢাকে না, চেঙরা বন্ধুর বালিশ লাগে না। কেউ বা শরীরের সকল শক্তি গলায় নিয়ে এসে গাইছে, ছেরি তেল কালা দেখতে ভালা আয়না লাগায় চক্ষেতে। তাদের খিস্তি খেউর এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে, পৃথিবীর সকল তরুণীর সাথে আদিম ক্রিয়ায় মিলিত হওয়ার লালিত সুপ্ত বাসনা গানে গানে বেরিয়ে আসতে লাগল।
আমি হঠাৎ লক্ষ করলাম কারা যেন এদিকে আসছে। আমি খানিকটা দূরে গিয়ে আখের থোবার আড়ালে চুপটি করে বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। দেখলাম ছ সাত জন রাইফেল কাঁধে টর্স মারতে মারতে নবীন মদ্যপায়ীদের কাছে চলে এলো। একটু সময় ওরা দাঁড়িয়ে তারছেড়া মদ্যপদের পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। তারা ঘটনাটা ঠিক কি তা বুঝে উঠতে পাচ্ছিল না।
একজন তাদের ধমক দিয়ে বলল, এই শালারা, তোদের এভাবে বেঁধে রেখেছে কে? তোরা এত রাতে এখানে কি করছিস?
কারো কথা শোনার মত প্রকৃতিস্থ ওরা ছিল না। পেরু টলতে টলতে বলল, এই মাগীর ভাই সুমুন্দিরা আবার কোত্থেকে আইলো রে। তা বাবা, গলাটা শুকাইয়া কাঠ হইছে একটু ঢাইল্লে দেও না?
হাত বাঁধা অবস্থাতেই ওদের বেধড়ক পেটাতে লাগলো।
আমি যতদূর বুঝতে পারলাম ওরা মুক্তিফৌজের লোক। তারা কখনো সদর রাস্তা দিয়ে হাঁটত না। আখক্ষেত পাটক্ষেতের আইল বাতর দিয়ে সন্তর্পণে চলাচল করত। বোধকরি দক্ষিণের আইল দিয়ে হেঁটে যেতেই নবীন সুরাপায়ীদের কলরব শুনে এদিকে চলে এসেছে।
ওরা যতই পেটায় এদের খিস্তিখেউড় আরও গতি পায়। মাইরের কোন প্রতিক্রিয়া এদের হয় না। কেবল, হকমিয়াকে একবার বলতে শুনেছি, তোরা কি শালা বিয়ে করা বউ পাইছস। এভাবে পিটাইতাছস কেন?
মুক্তিফৌজরা বুঝতে পেরেছিল এরা মা বাবার বখে যাওয়া ছেলে। তাই যাচ্ছে তাই রকমে পালিশ করে তারা পশ্চিম দিকে চলে এলো।
এদিকে সুরারপায়ীরা সুরার মোহনীয় সুরে দিশেহারা। তার উপর বিরাশি সিক্কার বেদম আছর। নেশায়, কষ্টে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে সবাই সংজ্ঞাহীন।
আমি আস্তে আস্তে ওদের কাছে এসে হাতের বাঁধনগুলো খুলে দিলাম। তারপর ওদের রেখেই বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। আঙিনায় পা রাখতেই ফজরের আজান পড়ে গেল।
বাবার ডাক শুনতে পেলাম, তোরা উঠে নামাজে আয়।
আমার প্রতি সুরাপায়ী বন্ধুদের তীব্রক্ষোভ থাকলেও গোপনীয়তা ফাঁস হবার ভয়ে ওরা কাউকে কিছু বলে নি। আমিও আমার নিরাপত্তার জন্য এ সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছিলাম।