তিন বছরের ছেলে ইয়াছিন রহমানকে নিয়ে তার মা নাদিরা আক্তার (৩২) ট্রেনে করে যাচ্ছিলেন। আজ মঙ্গলবার ভােরে রাজধানীর তেজগাঁও রেল স্টেশনে ট্রেনটি পৌছার আগেই দুস্কৃতিকারীরা আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই আগুনে পোড়ে অঙ্গার মা ও ছেলে।
খবর শুনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে যান ইয়াছিনের বাবা মিজানুর রহমান। স্ত্রী নাদিরা আক্তার ও ছেলের অঙ্গার দেহের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন মিজানুর রহমান। সারি করে রাখা লাশের চার লাশের মধ্যে দুই লাশই মিজানুরের আপন জনের।
আজ মঙ্গলবার ভোরে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল হক জানান, তিনি যে বগিতে ছিলেন, সেই বগিতেই আগুনের সূত্রপাত হয়। বিমানবন্দর স্টেশন পার হয়ে বনানীর কাছাকাছি আসার পর ওই বগিতে আগুন লাগে। তখন রেলের নিরাপত্তাকর্মীদের পোশাক পরা কয়েকজন অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র নিয়ে যায়।কিছুক্ষণ পরই অন্য বগিতে আগুন লেগে যায়। ১০ সেকেন্ডের ভেতরে চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। তখন ট্রেন অনেক গতিতে চলছিল। দরজা খুলে গেটের কাছে দাঁড়াই। তখনো ধোঁয়ার কারণে নিশ্বাস নিতে পারিনি।’ পরে ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে আহত হন বলে জানান নুরুল হক।
নিহত নাদিরার স্বামী মিজানুর তেজগাঁও এলাকায় হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন পশ্চিম তেজতুরী বাজার এলাকায়। বড় ছেলে রিয়াদ হাসান ফাহিম স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ৩ ডিসেম্বর দুই সন্তান নিয়ে তাঁর স্ত্রী নাদিরা আক্তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় যান। সেখান থেকেই মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে করে ঢাকায় ফিরছিলেন তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান। নাদিরার কলেজপড়ুয়া ছোট ভাই হাবিবুর রহমানও সঙ্গে ছিলেন। ট্রেনে আগুন লাগার পর ফাহিমকে নিয়ে হাবিবুর ট্রেন থেকে নেমে যান। তবে নাদিরা ও ইয়াছিন আটকা পড়ে।
লাশের পাশে দাঁড়িয়ে মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাইছি। কিন্তু পারছি না। কী অপরাধে আমার সব শেষ হয়ে গেল জানি না। আমি কারও কাছে বিচার চাইব না। এখন একটাই চাওয়া, আমার স্ত্রী-সন্তানকে যেন আর কাটাছেঁড়া করা না হয়। শুধু অক্ষত লাশ ফেরত চাই।’
গতকাল সোমবার রাতে স্ত্রী নাদিরার সঙ্গে কথা হয়েছিল মিজানুরের। বলেন, ‘রাতে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে ওঠার পর নাদিরার সঙ্গে কথা হয়েছিল। আজ ভোর পাঁচটার দিকে নাদিরার ভাই হাবিবুর ফোন করে আগুন লাগার খবর দেন। বাসা থেকে দ্রুত তেজগাঁও রেলস্টেশনে পৌঁছাই। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন চারটি লাশ নামায়, দেখি আমার স্ত্রী-সন্তান পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে।’
তেজগাঁও বিভাগ ও রেলওয়ে পুলিশের কর্মকর্তাদের ধারণা, দুর্বৃত্তরা যাত্রীবেশে ট্রেনে উঠে আগুন দিয়েছে। অগ্নিসংযোগকারীরা হয়তো আগুন দিয়ে বিমানবন্দর স্টেশনেই নেমে গেছে। ওই এলাকার ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ওই ট্রেনের সব যাত্রীর তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
রেলওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক দিদার আহম্মদ তেজগাঁও রেলস্টেশন পরিদর্শনে এসে বলেন, কারা আগুন দিয়েছে, সেটি উদ্ঘাটনে রেলওয়ে পুলিশ এরই মধ্য তদন্ত শুরু করেছে। পুলিশের অন্যান্য ইউনিটও কাজ করছে। শিগগিরই এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন ও জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।