
আজ বাইশ ডিসেম্বর, আমার জন্মদিন। সকাল থেকে মনটা খুব খারাপ বিভিন্ন কারণে। আসলে শৈশব জীবনে নিজের জন্মদিনের যে আনন্দ থাকে ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে সেই রঙিন আনন্দগুলো রঙহীন হয়ে যায়। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। জীবনযুদ্ধে চলমান একজন সৈনিকের সব ইচ্ছে সব সময় পূর্ণ হয় না। আমার ভাইয়ের একমাত্র মেয়ের বয়স এগারো- নাম অন্তি। দুই দিন আগে বোনের নয় বছরের মেয়ে মায়া এসেছে মামা বাড়ি বেড়াতে। দুজন মিলে আমার মাকে চেপে ধরেছে আমার জন্মদিন উপলক্ষে বিরিয়ানি খাবে। মা বললেন- গতকাল বিরিয়ানি রান্না করছিতো, আজকে আবার কেন?
মায়া চিৎকার দিয়ে বলল- তোমার মেয়ের জন্মদিন আর তুমিই ভুলে গেছো? অন্তি বলল -দাদু এই মেয়ে কি তুমি ডাউনলোড দিয়ে নিয়ে এসেছো ? মায়া বলল- মনে হয় নানার মোবাইল থেকে খালামনিকে নানা ডাউনলোড দিয়েছিল তাই নানু ভুলে গেছে যে আজকে খালামনির জন্মদিন। অন্তি সাথে সাথে বলল -দাদার মোবাইল থেকেই ফুফিকে ডাউনলোড দেওয়া হয়েছে আর সেজন্যই ফুফি দেখতে দাদার মতো হয়েছে। মায়া জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা অন্তি আপু,নানার কোন মোবাইল থেকে খালামনিকে ডাউনলোড দেওয়া হয়েছে? নানার তো দুটো মোবাইল।
-অন্তি, মনে হয় বাটন মোবাইল থেকে । দেখিস না দাদা বাটন মোবাইলটা কম ব্যবহার করে।
-মায়া,এবার বুঝতে পারছি নানাও কেন খালামনির জন্মদিনের কথা ভুলে গেছে। নানা তো সব সময় স্মার্ট মোবাইলটা ব্যবহার করে,বাটনটা কম ব্যবহার করে। সেজন্যই তো বাটন মোবাইলে থাকা খালামনির জন্ম তারিখের কথা সবাই ভুলে গেছে।
আমি ওদের কথা শুনে হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝতে পারছি না।
মা বললেন -কিরে তদের এই কথা কে বলছে যে মানুষের বাচ্চা ডাউনলোড হয়ে পৃথিবীতে আসে? অন্তি সাথে সাথে বলল -কেন তুমি দেখো না আমাদের স্কুলের সব পড়া আমাদের স্যার মোবাইল থেকে ডাউনলোড দিয়ে পড়তে বলেন। তাছাড়া আম্মুও তো মোবাইল থেকে ডাউনলোড দিয়ে বিভিন্ন রেসিপি দেখে রান্না করে। শুধু কি তাই আব্বুর সকল কাজ ঐ মোবাইলের মাধ্যমে করেন,দাদাও সব কাজ ল্যাপটপ নিয়ে করেন, আম্মুও তাই করেন। তাছাড়া ঐ দিন খালামনি আব্বুকে বললেন- দুলাভাই এখন তো সময় হয়েছে, আপনার মেয়ের বয়স এগারো,এবার তো আর একটা বাচ্চা ডাউনলোট দিয়ে নেন। এতেই বুঝা যাচ্ছে সবাই কে সবার আব্বু আম্মু মোবাইল থেকে ডাউনলোড দিয়ে পৃথিবীতে নিয়ে আসছে। এই বাচ্চাদের কথা শুনে আমার মন খারাপ তো হাওয়ায় উড়ে গেলো আর হাসতে হাসতে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা আমাকে একটা ধমক দিয়ে বললেন -আর কত কি শুনবো, দুই দিন পর দেখা যাবে সত্যি সত্যি বাচ্চা মোবাইল ল্যাপটপ থেকে ডাউনলোড দিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আমি বললাম- মা, তুমি দুই দিন পরের কথা কেনো বলছো বর্তমানে এর কার্যক্রম শুরু হয়ে গিয়েছে। মা-বাবা ছাড়াই জন্ম নিবে মানব শিশু তাও আবার সবার পছন্দ মতো বাচ্চার চুল, লম্বা, বুদ্ধি সবকিছু ঠিক করে নিতে পারবে। এতে করে নিজের পছন্দ মতো বাচ্চা পেয়ে যাচ্ছে মা-বাবা। আর এই প্রযুক্তির জন্য মা-বাবার দরকার হয় না-কম্পিউটারের মাধ্যমে মাতৃগর্ভের মতো করে ১০ মাস ১০ দিনে পরিপূর্ণ হচ্ছে একটা মানবশিশু। আমার কথা শুনে মা আকাশ থেকে পড়লেন, বললেন- এই মোবাইল কম্পিউটার পৃথিবীর সাথে সাথে পৃথিবীর মানুষের মায়া মমতাও সব ধ্বংস করে দিচ্ছে। আরে একটা মা যখন ১০ মাস ১০ দিন তার গর্ভে তার সন্তানকে ধারণ করে তখন ঐ সন্তান আর মায়ের মাঝে যে আবেগ অনূভুতি কাজ করে তা কি ঐ কম্পিউটারে জন্ম নেওয়া সন্তানের মাঝে আর মায়ের মাঝে থাকবে ? কখনো না, কিভাবে থাকবে বলো? আমাকে প্রশ্ন করে মা চলে গেলেন ফ্রিজ থেকে গোসত বাহির করার জন্য আর আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। সত্যি তো উন্নত প্রযুক্তির জন্য মানুষের মাঝে মানুষের দূরত্ব সৃষ্টির সাথে সাথে মায়া মমতাগুলোও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কেমন হবে তবে আমাদের আগামীর পৃথিবী? সেখানে মায়া মমতা, ভালোবাসা বলে কি কোন শব্দ থাকবে নাকি এই শব্দগুলোও বিলীন হয়ে যাবে? ভাবনায় তলিয়ে যাই আমি।