গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় সুরেশ নন্দির বাড়ি । মাঠ ভরা ফসলের জমি আর বাড়ি ঘেরা জঙ্গল। তার ফাঁকে ফাঁকে আম,কাঁঠাল, লিচু, জাম্বুরাসহ নানান জাতের ফল গাছ। এই ফলের স্বাদ গ্রামের ছোট বড় সকলের জানা থাকলেও গাছের পাতাটা পর্যন্ত কেউ ধরার সাহস করে না। কারণ তার শকুনের দৃষ্টি। কাউকে আঙ্গিনায় দেখা মাত্রই চিল্লাচিল্লিতে গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়। তাই মানসম্মানের ভয়ে সকলেই লোভকে সামাল দেয়। এই সমস্ত মৌসুমী ফল সে মাথায় করে দুই মাইল হেঁটে বাজারে নিয়ে তিলতিল যাচাইয়ে বিক্রি করার পর ভাংতি টাকাগুলো বড় নোটে পরিণত করে বাড়ি ফিরে। তার টাকার বড়ই মায়া,টাকাই একমাত্র সুখের অবতার। টাকা ব্যয়ে ভাল খাবারেও তার বদ হজম হয়। ক্ষুধার্ত আত্মা বুকে কিটকিট করলেও নিজ গাছের একটি ফল কখনো মুখে লাগায় না। সবসময় জামা কাঁধে জুতা হাতে তীক্ষ্ণ নজরে পথ চলা তার অভ্যাস। সুরেশ বললে খুব বেশি লোকে চেনে না,তবে সুরেশ কৃপণ নামে দারুণ পরিচিতি। সংসারে ছেলে নাতি নাতনি সবাই থাকলেও তিনি কাউকেই বিশ্বাস করেন না। তাই সঞ্চিত টাকা খুব গোপনেই রাখেন। বাড়িতে টয়লেট ব্যবস্থা না থাকায় অসুখ বিসুখ লেগেই থাকে। ডাক্তারের বারবার পরামর্শ, উন্মুক্ত স্হানে মলত্যাগ না করতে, পাকা টয়লেট বানাতে। কিন্তু কৃপণ দুরন্ত লোক। তিনি মনে মনে ভাবেন, তার জমানো টাকায় ডাক্তারের কুদৃষ্টি পড়েছে। আরে সুরেশ এত বোকা না, এই কাজ সে আরাম আয়েশে আশি বছর ধরে ঝোপঝাড়ের আঁড়ালেই চালিয়ে আসছে। সারাজীবন খেটে, লক্ষ মাইল হেঁটে,পেটে শুটকি মাছের আড়ৎ বানিয়ে এই টাকা জমাতে হয়েছে। ব্যাটা ডাক্তার কী সাংঘাতিক চক্রান্তের মানুষরে বাবা। নিজের প্রতিবেশী হয়েও এমন বাজে পরামর্শ দিয়ে, আমাকে সর্বশান্ত করার কত প্রচেষ্টা তার। আরে,সুরেশ এসব ফালতু কাজে নোট ভাঙ্গায় না।
সে অনেক যৌতুকে নাতিকে বিয়ে করায়। কৌশলে চাপ প্রয়োগে অনেক রকম গহনায় কনেকে সাজিয়ে নেয়। সে জানে সোনার গহনা নানা বিপদের কারণ হয়। বাড়িতে ডাকাত পড়ে, চুরি হয়, প্রাণ যায়। এসব বলে কয়ে সমস্ত গহনা বিক্রি করায়। ছেলে নাতি প্রতিবাদ করতে গেলে তার ধমক বড়ই কড়া। কেউ কথার অবাধ্য হলে জমি সম্পত্তি সবকিছু থেকেই বঞ্চিত করবে। তাই, নীরবে মেনে নেয় তারা।
কৃপণের অত্যাচারে ছেলে,নাতি অতিষ্ঠ। কিছুতেই বাড়ির পরিবেশ বদলাতে পারছে না। তাই বাবা ছেলে যুক্তি করে,কৃপণকে নাতনি জামাই বাড়ি বেড়াতে যেতে রাজি করে। খুব বেশি দূর নয়, কুড়ি মাইলের পথ। ছেলে এবং নাতি বারবার রিকশায় যেতে অনুরোধ করে। কিন্তু সে টাকার কথা ভেবে হেঁটেই রওনা দেয়। আবার যাবার সময় নিজের তেল চিটচিটে বালিশটাও সাথে নেয়। বারণ করলে সাফ উত্তর, নিজের বালিশ ছাড়া তার মোটেও ঘুম হয় না। পথে যেতে যেতে অনেক রিকশাওয়ালা প্রশ্ন করে কোথায় যাবেন, রিকশা লাগবে কি না। সে ক্ষুব্ধ বিরক্তি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাগে বিড় বিড় করে, এই সামান্য কুড়ি মাইল পথের জন্য আবার রিকশা নেব, টাকায় সুরেশকে কামরাচ্ছে, যত সব ফাজলামু!
প্রচণ্ড রোদ মাথায় করে সুরেশ কৃপণ পথ চলে। তার মাথার তেলতেলে ছাদ বেয়ে ঘাম ঝরে। রোদজ্বলা পিঠের চামড়া চিকচিক করছে। হঠাৎই পেটে চিন চিনে ব্যথা আরম্ভ হয়। ক্রমেই ভোট ভাট শব্দে নাভি কামড়ে মলত্যাগের বেগ হতে থাকে। অস্থিরতার দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকায়, ঝোঁপঝাড়ের আড়াল খোঁজে। সময়ের ব্যবধানে পেট যেন আরও গরম হয়ে গড়গড় ডাকে ঘনঘন মোচড় দেয়। চোখে ঝাপসা দেখে। অস্থিরতায় ভাবে আজ লজ্জা তাকে ডুবিয়েই ছাড়বে। এমন সময় একটা রিকশা দেখে লম্বা পায়ে এগিয়ে যায়। ভাড়া শুনেই বুকে ধক্ করে উঠে। এটুকু রাস্তার জন্যই একশ,বাবারে কি সাংঘাতিক ডাকাতি! পরক্ষণেই ভাবে এখন কথা বাড়ানোর সময় না। ঘাড় বাঁকিয়ে বলে খুব তাড়াতাড়ি যেতে হবে কিন্তু,কোন বাহানা চলবে না,এই বলে উঠে পড়ে। রিকশা চলতে থাকে। ততক্ষণে উতলা পেট কঠিন বিপদ সংকেত জানাতে থাকে। কোন চাপাচাপিতেই আর মানছে না। দাঁতেদাঁত কামড়ে জড়োসড়ো কৃপণ ঘামছে আর ভাবছে, আজ ছেলে নাতির কথাটা শুনলেই এমন বিপদ হত না। হায়রে এখন যে কাপড়ের সাথে রিকশাটাও নষ্ট হবে। এমন সময় একটি জঙ্গল দেখা মাত্রই লাফ দিয়ে নেমে বালিশ সহ দৌঁড় দেয়। পালিয়ে যাচ্ছে ভেবে পেছনে পেছনে রিকশাওয়ালও দৌঁড়ায় । কৃপণ জঙ্গলে গিয়েই বসে পড়ে। রিকশাওয়ালা কাছাকাছি হয়ে নাক চেপে লজ্জায় মুখ লুকায়।
কৃপণ এবার শান্তির নিঃশ্বাস নিয়ে হাসি মুখে রিকশার কাছে আসে। জানতে চায় ভাড়া কত । ভাড়া নিয়ে শুরু হয় দুজনের কথা কাটাকাটি যুদ্ধ। কৃপণ দাঁত কিড়মিড় করে বলে, তখন ছিল আমার ভীষণ বিপদের সময়, তাইতো যাচাই করতে পারিনি। তুমি জানো না আঘায় বাঘা মানে না। এখন আস্তে ধীরে বলো আসলে ভাড়া কত? তর্কে বিতর্কে রিকশাওয়ালা কিছুতেই পেরে উঠে না। হার মেনে যাবার বেলায় শুধু বলে যায়, হায়রে জীবনে কত রকম মানুষ দেখলাম,এমন আজব বুড়া খাটাস কখনো দেখিনি।
ক'দিন পর সুরেশ কৃপণ বাড়ি ফিরে। আঙিনায় পা রেখেই গাছে গাছে চোখ ফিরায়। আক্ষেপ করে বলে, ইশ্ কয়দিনে কি ক্ষতিটাই না হল রে! দুষ্ট ইতর বাদুড়গুলিও দেখছি আমার সব খবর রাখে। সুযোগ পেয়ে খুব মজা করেই নেচেনেচে খেয়েছে। প্রতিদিন যদি বিক্রি করে দিত তাহলে কি এমন সর্বনাশ হত! কি অলস সাংঘাতিক অমানুষ এরা, বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে যায়। চারিপাশ এমন সাফ সাফ লাগছে কেন তার। এত সুন্দর ঝোঁপঝাড়গুলো গেল কোথায়? ঘরের পেছনের দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠে। ইট বালির স্তুপ, পাকা টয়লেট, টিউবওয়েল এসব এই বাড়িতে কেন! তাহলে বেটা ডাক্তার কি সুযোগ পেয়ে আমার মাথায় কুড়াল মারল! নিমিষেই তার মগজে আগুন লেগে যায়। পাগলের মত চিৎকার করে, আমার কি সর্বনাশ করল রে! সুরেশের ছেলে নাতি হয়েও কি এরা ডাক্তারের পরিকল্পিত চক্রান্ত বুঝল না! আমার কষ্টের টাকা এভাবেই জলে ভাসিয়ে দিল...! এ কাজ অবশ্যই অসভ্য নির্বোধ পিশাচ নাতিটার। আরে এখন আমি ঠিকই বুঝতে পারছি,এজন্যই সেখানে আমাকে মিথ্যে ছলনার আদর যত্ন মায়ায় আটকে রেখেছিলি। আপন মানুষের কি নিষ্ঠুর কাজ। ডাক্তারের মত এরাও যে আমার ভয়ানক শত্রু হয়েছে। তার বুকে লেপ্টে যাওয়া কষ্ট ব্যক্ত করার ভাষা পায় না। অগ্নিদগ্ধ শরীরে লম্বা পা ফেলে ঘরে যায়। দেখতে পায় ধানের গোলা শূন্য। সাথে সাথে মাটির নিচে গোপনে রাখা টাকার বাণ্ডিল খোঁজে। কিন্তু সেখানে নাই। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে ছেলে এবং নাতিকে ডাকে। রক্তচোখে জানতে চায় টাকার বড় বাণ্ডিল কোথায়? এখানেই তো মাটির নিচে যত্নে রেখেছিলাম। তিন প্রজন্মের গহনা বিক্রির সমস্ত টাকা এই বাণ্ডিলেই ছিল। সবাই একসাথে পাগল হয়ে মাটি খুঁড়তে থাকে। দেখতে পায় ইঁদুরের অসংখ্য গর্ত। একটু গভীরে যেতেই লক্ষ্য করে দুষ্টু ইঁদুর সমস্ত টাকা কুচিকুচি কেটে নরম তোষক বানিয়ে,তার ফুটফুটে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। কৃপণ উন্মাদ হয়। বিলাপ করে বলতে থাকে তিন প্রজন্মের যৌতুকের গহনা বিক্রির সমস্ত টাকা। কত বুদ্ধি করে আদায় করতে হয়েছিল। শয়তান নিষ্ঠুর ইঁদুর কি সর্বনাশ করল আমার!এই পাকা টয়লেট আর টিউবওয়েল আমার সব ধ্বংসের মূল। আমাকে সর্বশান্ত করে দিলরে...!! বুক চাপরাতে চাপরাতে ধপাস্ করে বিছানায় পড়ে যায়।
চারিপাশে অশুভ অন্ধকার। ছেলে নাতি ক্ষিপ্ত হয়ে জানতে চায় বাকি টাকা কোথায়? তার উত্তর ঐ টাকা নিয়ে কারো চিন্তা করতে হবে না। সে টাকা যত্নেই আছে। হঠাৎ মনে পড়ে জমির দলিলের কথা। খুব কষ্টে উঠে সুটকেস খুলতেই দেখতে পায় উঁইপোকারা মরমর চরচর শব্দে যেন গান করছে। তার সমস্ত শরীরের রক্ত জমাট বাঁধতে চায়। মাথা ঝিম ধরে স্মৃতি এলোমেলো হয়, হৃদপিণ্ডের চাপ বাড়তে থাকে,পাগলের মতো শুধু বালিশ নাড়ে। মল ত্যাগের বেগ হলেও টয়লেট দেখা মাত্রই থেমে যাচ্ছে। পেট ফুলতে থাকে, নিঃশ্বাস ঘন হয়। শুস্ক চোখে ফল গাছের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ঠোঁট নাড়ে। লম্বা লম্বা শ্বাসের ফাঁকে শব্দ করে কি যেন বলার চেষ্টা করেও বলতে পারে না। একটু পরেই কোন সাড়া নেই! তবু গাছ থেকে দৃষ্টি সরে না। কিছুক্ষণ নিথর নিশ্চুপ দেখে নাতি গায়ে হাত রাখে। বুঝে ফেলে আর নেই, তাই চিৎকার দেয়। কান্না চিৎকারে প্রতিবেশীসহ গ্রামের সকলেই আসতে থাকে। টাকার কথা মনে হতেই মাথার নিচে সহ বিছানার সবখানেই অনুসন্ধান চালিয়ে পায় না। তাহলে দাদু যে বলতেন, টাকার কথা তার মাথায় আছে, সেগুলোও কি ইঁদুরেই শেষ করেছে। এক সময় বালিশে হাত দেয়। লোহার মত শক্ত ওজন মনে হয়। বাইরে এনে দেখে চেইনে আটকানো। চেইন খুলতেই নজরে আসে সারা জীবনের সঞ্চিত টাকা। বছরের পর বছর মাথার তেল পানিতে ভিজে উপরের দিকের কিছু ছাড়া বাকি সব গুড়ের মণ্ড। এগুলো যে টাকা তা কোনভাবেই চেনার উপায় নেই। এখন লাশ দেখার চেয়ে বালিশেই ভিড়। ছেলে নাতি সহ সকলে দুঃখ প্রলাপে মাথায় হাত। টাকা যে সরকারের সম্পদ। পুলিশে জানলেই ঝামেলায় প্যাঁচাবে, ঘা বাড়বে। তাই যত দ্রুত সম্ভব আড়াল করতে হবে। এর নিরাপদ সমাধান একটাই,লাশের সাথে বালিশও চিতায় দিয়ে দেয়া। সীমাহীন কষ্ট বুকে বেঁধে ছেলে নাতিসহ সকলে আঁধারেই কৃপণের শেষকৃত্য সমাপ্ত করে। সেই থেকে সবার মুখে মুখে আজও ভেসে বেড়ায়,
কৃপণ কৃপণতা করে, টাকা সঞ্চয়ে বালিশ ভরে,
সারাক্ষণ কষ্ট করে, বড় নোট রাখে ধরে।
আত্মাকে দিয়ে কষ্ট, দেহটাকে করে নষ্ট,
বুকে ক্ষত করে সৃষ্ট, শেষে হয় মতি ভ্রষ্ট।
কিছু খায় ইঁদুরে কিছু খায় বাদুরে,
কিছু কিছু রেখে যায় নর্দমা ভেতরে।
যেতে হয় একদিন সবকিছুই ছাড়ি,
এতটুকুই সুখ দেয় কৃপণের কড়ি।