ছত্রপতি জীবনে প্রথম চেম্বারে রোগী দেখা শুরুর ছয় মাস যেতে না যেতেই, যে তিনটি প্রধান কারণে 'ডাক্তার খারাপ' তার একটি ক্রম সাজায়। প্রথমতঃ ডাক্তার যদি স্লিপ দেবার সাথে সাথে সিরিয়াল ভঙ্গ না করে। দ্বিতীয়তঃ ডাক্তারকে ভিআইপি বাড়ীতে কল দেবার সাথে সাথে যদি চেম্বারের রোগী ফেলে রেখে দৌড় না দেয়। তৃতীয়তঃ রোগী দেখার পর যদি ভিজিট দিতে হয়।
চেম্বারে সকল রোগী না দেখে কলে বেরিয়ে যাবার সময় মানুষের যে করুণ আকুতি ও মিনতি, তা ভিআইপির দেখার সময় নেই। ভাবখানা এমন যে, 'ব্যাটা ডাক্তারি পরে করিস্, আগে আমার বাড়ীতে চল্...'। ভিআইপিদের কলে ভিজিট পাবার প্রশ্নই ওঠে না।
গত সপ্তাহে ছত্রপতি তার বাবাকে নিয়ে একজন কর্কটব্যাধি বিশেষজ্ঞের চেম্বারে গিয়ে দেখতে পায়,
উনার ভিজিট নতুন-পুরাতন প্রতিবার ১০০ টাকা, কলে গেলে প্রথম কিলোমিটার ৫০০ টাকা, তারপর কিলোমিটার প্রতি ৫০ টাকা। তখন ২০০ টাকা মণ ধানের দাম, ছত্রপতির ভিজিট ২০ টাকা। সেই হিসেবে কলে গেলে প্রথম কিলোমিটার ১০০ টাকা এবং পরের প্রতি কিলোমিটার ২ টাকা। মনে মনে নিজের এমন একটি কলে যাবার ফিস নির্ধারণের রেফারেন্স পেয়ে যায় ছত্রপতি।
সেদিন চেম্বারে মাত্রই বসেছে, এমন সময় কলিমউদ্দি চেয়ারম্যান এসে সহকারী সুরুজ মিয়াকে সরিয়ে দরজা ধাক্কা মেরে চেম্বারে ঢুকে,
: ডাক্তর সা'ব, কলে যাওন লাগবো। এহুনি যাইতে অইবো, শ্বশুড়বেডা খেছতাছে!
: রোগী তো মাত্র কয়েকজন, দেখে শেষ করে যাই?
: ডাক্তার সাইব, দেশে কিন্তু ডাক্তর আরো আছে! আর আমার শ্বশুড় কিন্তু একবারই মরবো। ছেলেরে রাইখ্যা গেলাম।
চেয়ারম্যান সা'ব জ্বলন্ত সিগারেটে জোরে একটা টান দিয়ে চেম্বার ত্যাগ করলেন। যে ছেলেটিকে চেয়ারম্যান সা'ব রেখে গেছেন তার নাম ফারুক, ক্লাস টেনে পড়ে, তার নানা অসুস্থ, খিঁচুনী হচ্ছে। ডাক্তারকে কলে নেবার জন্য অধিকাংশ ভিআইপিরাই যেন মিথ্যার আশ্রয় নেন। যেমন রোগীর খিচুঁনি হচ্ছে, নাড়ী পাওয়া যাচ্ছে না, যায় যায় অবস্থা ইত্যাদি। যেন সিরিয়াস বুঝাতে অপ্রয়োজনীয় মিথ্যাটুকু বলতেই হবে। তা না হলে ডাক্তার যেন খিচুঁনীর মর্ম বুঝবে না!
বৃদ্ধ বয়সে খিঁচুনীর ডিফারেনসিয়াল ডায়াগনসিস অনেক দীর্ঘ। ফারুকের নানার বাড়ী হালুয়াঘাটের আমতৈল গ্রামে, ফুলপুর থেকে সাড়ে ষোল কিলোমিটার। কর্কট বিশেষজ্ঞের হিসেব মত ছত্রপতির ফিস হয় একশত একত্রিশ টাকা। চেম্বারের রোগী ফেলে রেখে বের হয়ে যায় ছত্রপতি। ঘাড়ের উপর তলোয়ার ধরে রাখলে কি মন্ত্রপাঠ করা যায়? একাশি টাকার পেট্রোল ভরে ফারুককে পিছনে বসিয়ে রওয়ানা দিলো ছত্রপতি। ফারুকের সাথে পড়াশুনা বিষয়ক কথা বলে অনেক হালকা হলো সে। ফারুক বিজ্ঞানের ছাত্র, আর্কিমিডিসের একটি সূত্র ছত্রপতি জিজ্ঞেস করলে সে ভুল-ভাল বলে দেয়। ছত্রপতি ভেরিগুড বললে ফারুক বলে উঠে : ভুল কইসি তো স্যার! ভেরিগুড কইলেন যে! আপনের বোধহয় মনে নাই! ছত্রপতির জীবনে পড়াশুনা বিষয়ক এমন লজ্জা আগে পায় নি। সে ফারুকের উত্তর বলার মাঝে সূক্ষ্ম একটি ভুলকে ওভার লুক করে ধন্যবাদ দিয়ে ফেলেছে। ভেবেছে, কী দরকার চলার পথে মাস্টারি করার! এখনতো সে নিজেই ফারুকের কাছে ধরা খেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত পাঁচটি লেটারকে মনে মনে ব্যঙ্গ করতে লাগলো। ফারুককে এখন যদি বলে, সে সদর উত্তর মহকুমায় এসএসসি তে সর্বোচ্চ নম্বরধারী ছাত্র, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে মুখে না বলুক মনে মনে সে প্রশ্ন তুলবেই, আর্কিমিডিসের সূত্র যে জানেনা! কী খেয়ে, কী ভাবে ডাক্তারি চান্স পেলো... ইত্যাদি কথা ফারুকের মন থেকে ছত্রপতি অনুবাদ করতে লাগলো। হঠাৎ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিলো।
: তোমার নানার বাড়ীর রাস্তা কেমন? বাড়ী পর্যন্ত বাইক যাবে?
: অল্প একটু হেঁটে যেতে অইবো। খালের এইপারে গাড়ী রাইখ্যা যাইতে অইবো।
ছত্রপতির মেজাজ বিগড়ে গেলো।
: আগে বলো নাই কেন? বাইক আনার প্রশ্নই ছিলো না। রিক্সায় আসতাম।
: রিসকায় আইলেও তো খালের এপারেই নামতে হতো।
ফারুককে এখন তার বিশিষ্ট বিটকেল মনে হলো। আজ যে কপালে দুর্গতি আছে ছত্রপতি বুঝতে পারে।
: খালের পাড়ে বাইক রেখে গেলে কোন সমস্যা হবে না তো?
: কী সমস্যা?
: এই যেমন দুষ্ট ছেলেরা যদি বাইকের মিরর্ মুচড়িয়ে দেয়! চাকার হাওয়া যদি ছেড়ে দেয়!
: মামুরা বৌলচিরা দিয়া মাথাটা ছিংগুইট্টালাইবো।
অর্থাৎ তলোয়ার জাতীয় অস্ত্র দিয়ে দুষ্টছেলেদের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। সুতরাং বাইকের নিরাপত্তা নিয়ে না ভাবাই ভালো। জুতো হাতে কর্দমাক্ত রাস্তা পেরিয়ে তারা যখন খালপাড়ে এলো তখন দুপুরের খাবার সময়। ছত্রপতি ওখানে দোকান থেকে পাউরুটি কিনে ফারুককে অফার করলে সে খাবে না বললো। চারটি চাম্পা কলা সহযোগে পাউরুটি শেষ করে দোকানদারের কাছ থেকে জানতে পারলো অকুস্থলে হেঁটে যেতে ঘণ্টাখানেক লাগবে। ফারুকদের মামুর বাড়ীর কাছে আরো একটি একবাঁশের সাঁকো আছে। রাগে দাঁত কড় মড় করে ছত্রপতি অগত্যা ফারুকের কাছে আত্মসমর্পণই শ্রেয় মনে করলো।
কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে ছত্রপতি যখন ফারুকের নানার উঠোনে আসলো, তার বড় মামা জিজ্ঞেস করলেন,
: সাথে উনি কে রে ফারুক?
: ডাক্তার ছত্রপতি।
: রোগী কেডা?
যার অসুখ তার ছেলের মুখে এমন কথা শুনে রাগে ছত্রর চুল সব কদম ফুলের মতো দাঁড়িয়ে গেলো।
ফারুকের বড় মামু বাড়ীর ভিতরে যাবার নির্দেশ দিয়ে তিনি গ্রামের হাটে রওয়ানা হলেন। বাড়ীর ভিতরে উঠোনে যেতেই ফারুকের আরেক মামু আদাব দিয়ে চেয়ার দিলেন বসতে। নিজে ছত্রপতির হাত থেকে ব্যাগটি নিয়ে পাশে একটি টেবিলে রেখে তার আম্মার উদ্দেশ্যে জোরে ডাক দিয়ে বললেন,
: আম্মাজান, আব্বা কই?
দরজা বন্ধ একটি ছনের ঘরের ভিতর থেকে উত্তর এলো,
: তাইন একটু ঘরের ভিত্রে বাইরে গেছুইন। ডাকতর সাবেরে ক' মোফাজ্জলরে দেখতে থাউক।
এতোক্ষণে বুঝতে পারে ছত্রপতি, রোগী একজন নয়, আরো আছে। মোফাজ্জল, মানে চেয়ারম্যানের শ্যালক, আরেক রোগী। একজন ডাক্তারকে মিথ্যা বলে বা চালাকি করে চেম্বার থেকে দশ কিলোমিটার দূরে সহজেই কলে আনা যায়। ডাক্তারি মানেই শতভাগ যেন বিনামূল্যের মানবিক বিষয়। অমুক ডাক্তার মানবিক, তমুক ডাক্তার মানবিক, তমুক উকিলসাব মানবিক এসব কথা শুনলে ছত্রপতির হাসি পায়। মানবিক গুণ ধারণ করা ছাড়া মানুষ কীভাবে প্রথমত মানুষ হয়? মানবিক হৃদয় সর্বদা সময়ের অমানবিকতার কারণে বিপন্ন থাকে।
মোফাজ্জলকে পরীক্ষা করে ছত্রপতি এ্যকিউট লিভার ফেইলুর ডায়াগনোসিস করে এবং দ্রুত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে রেফার করে। যদি ডাক্তার বাড়ীতে না আসতো, মোফাজ্জলকে ডাক্তার দেখানোই বোধ হয় হতো না। বিগত একমাসে 'মাইট্টা জন্ডিসের' জন্য মাত্র দুইদিন জালাল কবিরাজের উতার পড়া পান করেছে সে। রেফার, লিভার ফেইলুর, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইত্যাদি শব্দগুলোর সম্ভাব্য মাহাত্ম্য বুঝানোর পরেও মোফাজ্জলের বৌ তার ছোট মেয়ে মরিয়মের পেটটা একটু দেখে দিতে বলে।
ডাক্তারের উপস্থিতির খবর আশেপাশের বাড়ীতে ছড়িয়ে পড়ে। ছত্রপতি অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে এক এক করে মরিয়ম, ফিরোজা, বাবলু, রুকি, টেপি, আব্দুল্লাহ্, সুজন, সাবানা, রোজিনা,পল্টন, শহিদ ও একজন নবজাতককেও দেখলো। উদরে তার ক্ষুধার সর্বভূক অনল স্বয়ং উদরকে যেন চিবিয়ে খাচ্ছে।
এতোক্ষণে দরোজা ভেজানো ঘরে ডাক্তারের ডাক পড়লো। মুরুব্বী হয়তো এতোক্ষণে অভ্যন্তরীণ বাহ্য ক্রিয়া শেষ করেছেন।
: আসসালামু আলাইকুম ডাক্তর সাব। ছত্রপতি ঘরে ঢুকা মাত্রই মুরুব্বী বলতে শুরু করেন : কী খাইবাইন ডাক্তর্সাব? কই রে নূরেছা, নাস্তা দে! আমার জন্যই জামাই কল দিছিলো আফনেরে। প্রেসারটা হাফ-ডাউন করে। কই রে ফারুক? নানা ভাই কই গেলি?
পথ প্রদর্শক ফারুককে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। তার নানী জানালেন, ফারুক মামুর বাড়ীতে দুইদিন থাকবে। নূরেছা প্রায় গোটা দশটা সাগর কলার ছোলা ছাড়িয়ে প্রকাণ্ড একটা থালায় পরিবেশন করে নিয়ে এসেছে। মুরুব্বীর প্রেসার মাপতে মাপতে চৌকির নীচে ছত্রপতির চোখ যায়। ঘরের বাতাসে সঞ্চরণশীল হয়তো কোন ঘ্রাণ
অবচেতন মনে তার দৃষ্টিকে ওদিকে তাকাতে প্রেরণা দিয়েছে। থালায় শোভিত নূরেছার দিগম্বর কলাগুলোরই একটি যেন হাফ বালতি পানিতে আধেক ডুবে আধেক ভেসে ছত্রপতির ক্ষুধার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। সাগর কলা ও তৎসদৃশ বস্তুটি মিলে ঘরময় যে এসেন্সটিকে প্রকট করেছে, কবি হলে ছত্রপতি প্রেসক্রিপশন করার পরিবর্তে সেইক্ষণ কবিতা লিখতে বসে যেত। অনেক কষ্টে ছত্রপতি আপন উদরের ক্ষুধাকে মনে মনে শাসন করে নিবৃত্ত করলো। মুরুব্বী জানালেন ছত্রপতির উপযুক্ত ফিস তার জামাই চেম্বারে আজই পাঠিয়ে দিবেন।
যদি ফিসটি পাঠাতেন, অষ্টম আশ্চর্য হতো বিষয়টি। একা একা হেঁটে খাল পেরিয়ে যখন বাইকে চেপে বসলো ছত্রপতি, তৎক্ষণাৎ ফারুকের কার্যবিধি হাড়ে হাড়ে টের পেলো । দুটি চাকারই হাওয়া নেই, লুকিং গ্লাসটাও মুচড়িয়ে ভেঙে দিয়ে গেছে। সন্ধ্যা সমাগত, ছত্রপতির ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে হলো কিন্তু সমবেত লোকজনের প্রদর্শিত সমবেদনার জন্য তা আর সম্ভব হলো না।
পাশেই বাড়ী, খালেক নামে একজন রিক্সাওয়ালাকে খবর দিয়ে আনানো হলো। দশ টাকার পথ পঞ্চাশ টাকায় রফা হলো। এক কিলোমিটার দূরে একটি বাজারে চাকায় হাওয়া করার ব্যবস্থা আছে। রিক্সায় তুলে দেবার সময় মোটর সাইকেলটির সাথে একজন রসিকতা করতে ছাড়লো না : গেরামে আইছস একটু আরাম কইরা রিসকা দিয়া যা!
চাকা হাওয়া করা হলে বাইকে স্টার্ট দেয় ছত্রপতি। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে, কর্দমাক্ত রাস্তায় সন্তর্পণে চলতে লাগলো সে। কল্পনার পাঠশালায় ঢুকে যায় ছত্রপতি। হাতে একটি সন্ধিবেত নিয়ে সে মাস্টার মশাই সাজে। কলিম চেয়ারম্যান তার ছেলে ফারুককে নিয়ে আসে ইংরেজী গ্রামার শিখার জন্য। ঘরের এক কোণে একটি ভাঙা চেয়ারে চেয়ারম্যান সাহেব বসেই ঘুমিয়ে পড়েন। দুরন্ত ও অমনযোগী ফারুককে সে পড়াশুনা ধরতে থাকে। প্রশ্ন করে : বলতো বাবা ফারুক, ডাক্তারকে কল দাও, ইংরেজীতে ট্রান্সলেশন্ কী হবে!
: খুবই সোজা স্যার, কল দ্য ডক্টর।
ছত্রপতি প্রায় চিৎকার করে বলে ওঠে : একটা থাপ্পড় দিবো। কল ইন্ এ্যা হবে.. গাধা কোথাকার...
থাপ্পরের শব্দে চমকে গিয়ে চেয়ার ভেঙে কলিমউদ্দি চেয়ারম্যান মাটিতে পড়ে যায়। এক পথচারী বলে উঠে : কারে থাপড়াইতাছুইন ডাক্তার্সাইব ?