একটা ছকে দুটো সারি । বায়ে মেয়েদের ডানে ছেলেদের । ক্রমানুসারে অপহৃত মেয়েদের নামগুলো- মনিরা - জোৎস্না - কুসুম - শেফালী... আর পাচারকারী ছেলেদের কুরবান- খোদাবক্স- এলাহী- কেরামত...। তালিকাটি পড়তে পড়তে একরকম মুখস্থ হয়ে গেছে মিলুর । মিলু একা একা ওদের সাথে কথা বলে প্রতিটি নাম নিয়ে মনের ভিতরে এক ধরনের খেলায় মেতে ওঠে।
মিলু একটি ভলান্টারি সংস্থায় চাকরি করে । চাকরিতে শুধু দায়িত্ব পালন নয় পাশাপাশি কাজ করতে গিয়ে এক ধরনের রোমান্স বোধ করে সে । ছেলে-মেয়ে পরস্পর হাত ধরাধরি করে কাজ ওরা । ওদের নিজস্ব আইডোলজি কাজে লাগিয়ে সমাজ বদলের নিরবচ্ছিন্ন স্বপ্ন দেখে এবং দেখায় । সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে ওরা মেতে উঠেছে হিউম্যানিস্ট মুভমেন্টে ।ওদের স্বপ্নের ফোয়ারা মাটি থেকে আকাশে আকাশ থেকে মাটিতে আপ ডাউন করে। প্রকৃতির শোভাময় আবহে গোয়েন্দাগিরির কাজটা এবার সে নিজেই বেছে নিয়েছে।
পাহাড়ের টিলা-টালা ,খানা-খন্দ , ঝোপঝাড়ের ভেতর বিচরণ করা , ছোটখাটো গর্ত লাফ দিয়ে পার হওয়া , ঢাল বেয়ে উপরে ওঠা নিচে নামা এসব সে নিজস্ব কৌশলে রপ্ত করে নিয়েছে । এছাড়াও জব কানেকশনে যেকোনো পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার ব্যাপারেও নিলুর দক্ষতা অসাধারণ । সহসা তার এমনও মনে হয় পিঠে দুটো পাখা থাকলে সে উড়ে উড়ে চলতে পারতো ।
বরাবরের মতোই পায়ে হালকা কেডস গায়ে ফুলহাতা গেঞ্জি গলায় ক্যামেরা হাতে বাইনোকুলার আর মনে ফৌজি ভাব নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে । চষে বেড়ায় পাহাড়ি আনাচ-কানাচ । পাহাড়ের ধার ঘেঁষে বন্য নদ-নদীর পার , নানা অচেনা গাছ- গাছালি দেখে তার কখনো মনে হয় ঠিক এই জায়গাটাতে তার আগে কেউ আসেনি সেই প্রথম । দুর্গম এই জায়গাটিও যেন তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । মিলূ ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে । পাখ-পাখালির সাথে দু'চারটা কথোপকথনও হয় । পকেটে আত্মরক্ষার জন্য একটা পিস্তল আছে বটে কিন্তু এখন পর্যন্ত ওটা ব্যাবহারের কোন প্রয়োজন হয় নাই । সামান্য পা মচকানো বা পোকার আক্রমণ ছাড়া বড় কোনো বিপত্তিও ঘটে নাই । টানা ছ'মাস খেটেখুটে নক্সা আঁকা স্থানটাতে পৌঁছাতে পেরেছে মিলু । নিজেকে হিরো হিরো লাগছে । মনের আনন্দে সুবিধা মতো একটি জায়গায় বসে বাইনোকুলারটা তুলে ধরে চোখের সামনে।পাহাড়ের খাড়া সুঁচালো ধার নিচে সুড়ঙ্গ পথ ।পথের মুখে কৃত্রিম ঝোপঝাড় । মিলুর হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যায় । এই সেই পথ যার জন্য হন্যে হয়ে ফিরছে তাদের পুরো টীম ।
বাইনোকুলারটা ছেড়ে ক্যামেরা উঁচিয়ে ধরে
মিলু । কম্পিত হাতে দ্রুত ক্লিক ক্লিক করতে থাকে । সাফল্যের চরম মুহুর্ত বুঝি হাতে এসে ধরা দিয়েছে । কিন্তু না । মিলু আনন্দের আতিশয্যে বুঝতেই পারেনি একটা ছায়া তাকে অনুসরণ করছে । যখন বুঝতে পারে তখন আর নিজেকে রক্ষা করার সুযোগ নেই । সে দেখতে পাচ্ছে ছায়ামূর্তিটা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে কিন্তু নিজেকে সামলাতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সেই গভীর খাদে । ক্যামেরার শক্ত ধারটা বসে যায় মিলুর পাঁজরে । চোখের সামনে নেমে আসে নিকষকালো আঁধার । জ্ঞান হারাতে হারাতে মিলু টের পায় কয়েকটি হাত দ্রুত গতিতে তার শরীর সার্চ করছে । কিছু মানুষের পায়ের ছুটোছুটি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে মিলু ।
অস্পষ্ট একটা কোলাহলের ভেতর চৈতন্য ফিরে আসে মিলুর । কারা যেন ব্রিফ করছে - মেয়েটির নাম রুমেলা । পেসেন্টের ভ্রমণসঙ্গী । ঘটনাটি সেই আমাদের ইনফর্ম করে । ...অন্য একটি কন্ঠ - আমাদের ভলান্টারি অর্গানাইজেশন 'কুমির' ... আরো একটি কন্ঠ এসে আগের জনকে চাপা দেয় - সুড়ঙ্গের ভেতর এদের আস্তানা ... ফাইলপত্র সব সিজ করা হয়েছে । মিলু বুঝতে পারে বিভিন্ন সংস্থা মিডিয়া এসে জড়ো হয়েছে । সকাল - দুপুর- সন্ধ্যা - সকাল ... মানুষের ভিড় । মানুষ আসছে ... আসছে দলে দলে আসছে ক্যামেরা , মাউথপিস ।
ঘুম ভাঙার পর মিলু দেখতে পায় তার পাশে অতন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে । এই সেই কথিত রুমেলা ! মিলু তাকে চেনার চেষ্টা করে । মেয়েটিও তাকে চোখ খুলতে দেখে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে । সে মিলুর আরও কাছে এসে দাঁড়ায় ।
যুবতী একটি মেয়ে । চোখের পাতায় সহজাত ঘোর । মসৃণ চিবুক । ঠোঁটে জড়ানো গভীর টান । শরীরের স্ফীতিগুলো স্পষ্ট যদিও বুকের উপর ওড়নার অতিরিক্ত ভাঁজ টানা । সবকিছু ছাপিয়ে বেরিয়ে এসেছে তার প্রখর রূপলাবন্য কিন্তু কে এই মেয়েটি ! মিলু ওকে চেনে না অথচ ওরা নির্দ্বিধায় বলে দিয়েছে - পেসেন্টের সফরসঙ্গী ! এলোমেলো ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে মিলু ।
জ্ঞান ফেরার পর থেকেই মিলুর বুকের ভেতর একটা নিঃস্বতা গুমড়ে গুমড়ে ঘূর্ণি তুলছে । তার এতো দিনের সব কষ্টের অর্জন ওরা লুটে নিয়েছে তার উপর এখন নির্ঝঞ্ঝাট বেঁচে থাকাও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
সেই অচেনা মেয়েটি আবার কাছে এসে দাঁড়ায় । বার দুই চেষ্টা করেও ঠোঁট খুলতে পারে না মিলু । চোখের সামনে ভেসে ওঠে গত ছ' মাসের অপহৃত মেয়েদের তালিকাটি । মনিরা- জ্যোৎস্না - কুসুম - শেফালী ...এই মেয়েটি কী ওদেরই একজন ? প্রশ্নটি তীব্র শক্তি নিয়ে ঠোঁটের উপর আছড়ে পড়ে কিন্তু শব্দ হয়ে ওঠে না । এর মাঝে ডাক্তার এসে জানিয়ে গেছেন - সে এখন আশঙ্কা মুক্ত । যাবার সময় ডাক্তার মেয়েটিকে বলে গেছেন - খেয়াল রাখবেন ।
মিলুর চোখে হাজারো প্রশ্ন । মেয়েটি তার এটেনডেন্ট ! নিশ্চয়ই কোন প্রফেশনাল নার্স নয় । মেয়েটির চোখের কালো সুষমা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে । এসে মিলুর ঠিক মুখের উপর উবু হয়ে পড়ে । ত্রস্ত হাতটি ওঠে আসে মিলুর মাথায় - মাথার চুলে ডুবে যায় ওর হাতের পাঁচটি আঙুল । মিলূ জোর শক্তি খাটায় । তীর্যক দৃষ্টি রাখে মেয়েটির চোখের ভেতর - না ওখানে ভয়ের কিছু নেই বরং নির্ভরতা আছে । চোখ বুজে মেয়েটির ফুসফুসের আওয়াজ শুনে মিলু ।
মেয়েটির পাঁচ আঙুলের ছোঁয়ায় মিলুর আপাদমস্তক জুড়িয়ে যায় । বিরবির করে মিলু - না , মেয়েটা কোন নষ্ট মেয়ে না , নিশ্চই না । নষ্ট মেয়েরা লোকালয়ে চোরাপথে আয়ের ধান্ধা করে । সে কারো আটপৌরে বধূ না । আটপৌরে কোন বধূ এমন শিকড়হীন নিঃস্বতা নিয়ে অচেনা কোন মুমূর্ষুর পাশে উদ্বেগ নিয়ে বসে থাকে না । কোনো বদ্ধযুবকের কষ্ট লাঘবের জন্য তার চুলের গভীরে বিলি কাটে না দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে না ।
মিলু ঘুম জড়ানো চোখের পাতা খোলার চেষ্টা করে । হ্যাঁ , এইতো ঠিক তার চোখের উপর চোখ রেখে মিটিমিটি হাসছে মেয়েটি । অথচ মেয়েটি তার কোন আত্মীয় না বোন না চেনাজানা মেয়েবন্ধুদের কেউ না । ওর চুলে শরীরে কোন পারফিউমের গন্ধ নেই । নিশ্চয়ই মেয়েটি ঘরছাড়া - স্বপ্নহারা - পিতামাতা- ভাইবোন- আত্মীয়স্বজনহীন নিঃস্ব একা ভাসমান কেউ ।
মিলু নড়াচড়া করতে শুরু করে গলার আওয়াজ কিছুটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে । ওর কিছু কথা এখন মেয়েটি বুঝতে পারছে । মিলু বলছে - তুমি নিশ্চয়ই ওই মনিরা- জ্যোৎস্না- কুসুম - শেফালীদের কেউ । মেয়েটা এই প্রথম কথা বললো - আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন - সব
বলবো । মিলু উত্তেজিত হয়ে ওঠে - সেদিনের সেই দুর্ঘটনার সাথে নিশ্চয়ই তোমার সম্পর্ক আছে । মিলু সমস্ত শক্তি দিয়ে নড়ে ওঠে । নাকের উপর চাপানো অক্সিজেনের মাস্কটা খুলে যায় । কম্পিউটারের মনিটরে ইসিজি সো করছে । মিলুর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে । মেয়েটি ডাক্তার ডাক্তার বলে চিৎকার করতে থাকে । কিছু পায়ের ছুটোছুটি , বুকের উপর পুনঃপুন চাপ অনুভব করতে করতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে মিলু ।
কয়েকদিন পর শয্যা ছেড়ে উঠে বসে মিলু । মেয়েটি সাবধানী দৃষ্টি নিয়ে চারপাশে তাকায় , না আশপাশে কেউ নেই । মেয়েটি মিলুর পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে । মিলূ কিছুটা বিব্রতবোধ করে । মেয়েটি রহস্যময় কন্ঠে বলে - ভয় নেই আমি আছি আপনার পাশে । মিলুর চোখে সেই পুরোনো প্রশ্ন যার সুরাহা এখনো হয়নি ।
মেয়েটি তার জামার ভেতর থেকে বের করে আনে লেমিনেটেড একটা কার্ড । তুলে ধরে মিলুর চোখের সামনে । মিলুর মুখটা হা হয়ে যায় বড় হতে থাকে চোখের পুতুলি । কয়েকটা মুহুর্ত কেটে যায় নিঃশব্দে ।
মিলু কাঁপা কন্ঠে বলে ওঠে - পু - লি - শ !
নো নাউ আই এম রুমেলা - মেয়েটির ক্ষিপ্র কন্ঠ ।
মিলুর মনে প্রশান্তি নেমে আসে , মুখেও তার উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে পড়েছে ।
জড়াতাহীন কন্ঠে মিলুর উচ্চারণ - ইয়েস - রুমেলা ।
বাকী আলাপন পরস্পর হাসিতে ।