logo
আপডেট : ৬ জানুয়ারী, ২০২৪ ০৯:২৯
ধারাবাহিক উপন্যাস -০১ পর্ব
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন

গহীনে নীল

বেলায়েত হোসেন

শরতের জোছনাগলা রাত। ঘন সবুজের ফাঁকে ফাঁকে আলোর নাচানাচি। অবারিত জোছনার সাগরে নিমজ্জিত তুফানীর উড়ুউড়ু মন। ষোড়শী তুফানী আনমনে নদীর পাড়ে বসে আছে একা। হৃদয় জুড়ে তার কিসের যেনো হাহাকার। মনের অজান্তে বারবার হাতের কাছে পাওয়া ঢিল ছুঁড়ে মারে নদীর জলে। সৃষ্টি হয় রাশিরাশি ঢেউ। আধভাঙা ঢেউয়ের জলকণায় জোছনার স্ফুলিঙ্গরাশি আশার দীপালি সাজায়। অসংখ্য স্বপ্ন বর্ণিল সাজে তরী ভিড়ায় তুফানীর চঞ্চলা মনের কল্পনার ঘাটে। আকাশ মেতে ওঠে মেঘ জোছনার আলিঙ্গনে। তুফানীর হৃদয় ক্রমশই বিলীন হতে থাকে আধো মেঘ আধো জোছনার লুকোচুরির অন্তরালে। কখন যে ভোরের কচি রোদ তুফানীর কুসুম কপোলে দোল খায় তুফানী তা টের পায় না।
 
দশম ক্লাসে পড়ুয়া তুফানী যেনো এক চঞ্চলা হরিণী। কোনো কাজে তার স্থিরতা নেই। কোথাও তার মন বসে না। পাঠক্রমেও তার অস্থিরতা। ক্লাসের মাঝে দুষ্টুমির ঝড় তুলে বেড়ায়। সে যেনো এক মানুষরূপী তুফান। পাড়া-পড়শীরাও তার দুষ্টুমির ধকল থেকে ছাড় পায় না। 
স্কুল ছুটি শেষে সারাবেলা এ পাড়া থেকে ও পাড়ার সমস্ত এলাকা ঘুরে বেড়ায়। আবার ইচ্ছে হলে এ গাছ ও গাছ বেয়ে বেড়ানোও বাদ যায় না।
পিতৃমাতৃ হারা তুফানী জন্মলগ্ন থেকেই এক কাকা বাবুর আদরে বড় হয়ে ওঠে। পাড়াপড়শীরাও তাকে অনাদরে রাখেনি। কারণ তার জীবন ইতিহাস সকলের জানা। তাই সকলের চোখে তুফনীর জীবনটা পৃথিবীর নির্মম এক দৃষ্টান্তের সাক্ষী। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণ কেউ করেনি। কিন্তু প্রতিনিয়ত স্কুলের পথে ক্লাসের কিছু দুষ্টু ছেলে তাকে উত্যক্ত করার লক্ষ্যে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তুফানী সেই সব নীরবে হজম করে কৌশলে এড়িয়ে চলে। কাউকে কোনো প্রত‍্যুত্তর করে না। সে জানে তার কাকাবাবু নেহায়াতই গরীব লোক। প্রতিবাদ করার মতো তাদের তেমন শক্তি সাহস নেই।
 
পুরো স্কুলপাড়ায় তুফানী ছিলো অত্যন্ত রূপের অধিকারী। তার রূপের মোহনায় নজর ডুবিয়ে দূর থেকে জল গিলেনি এমন জনের দেখা খুবই বিরল। সামনে তুফানীর পরীক্ষা। পড়াশোনায় তার কোনো মনোযোগই নেই। সারাদিন শুধু এটা সেটা করে বেড়ায়। তুফানীকে নিয়ে তার কাকা বাবুর অনেক বড় স্বপ্ন। পড়াশোনা করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তুফানীর সারাদিনের দুষ্টুমির ফর্দ দেখে কাকা বাবুর মন খুবই খারাপ হয়। তাই রাগের বশে একদিন পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে তুফানীর উপর। ছোটকাল থেকে এতো বড় হয়েছে কখনো কাকা বাবু তাকে রাগ করে কথা বলেনি। 
হঠাৎ কাকা বাবুর চোখেমুখে রাগের ছায়া দেখে তুফানী মন খারাপ করে তার বান্ধবী শিবানীর বাসায় চলে যায়। শিবানী অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে। পড়াশোনায়ও বেশ মেধাবী। স্কুলের সব স্যার ম্যাডাম তাকে খুব স্নেহ করে থাকেন। ক্লাসে প্রতিবারই পরীক্ষায় তুফানী শিবানীর মধ্যে চলে প্রতিযোগিতা। একজন প্রথম হলে অপরজন অবশ্যই দ্বিতীয়। বরাবরই এভাবে তাদের পড়াশোনার মান নির্ণয় হয়ে আসছে। স্কুলে তারা দু'জন দু'জনের খুব কাছের বন্ধু। তুফানী প্রায় সময়ই শিবানীর সাথে তাদের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতো। তবে শিবানীকে ছাড়া কখনো কোনোদিন একা যেতো না। আজকে হঠাৎ তুফানীকে তার বাসায় একা আসতে দেখে শিবানী চমকে ওঠে। চোখেমুখে কেমন যেনো মলিনতার ছাপ। অত্যন্ত চতুর শিবানী বুঝে ফেলে বাসায় তার কাকা বাবুর সাথে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। নয়তো বলা কওয়া নেই হুট করে এভাবে না জানিয়ে চলে আসার কথা নয়। তাই কোনো প্রশ্ন না করে তুফনীকে নিয়ে ঘরে যায়। তুফানীকে বুঝতে দেয় না শিবানী তার সমস্যার কথা বুঝে ফেলেছে। এদিকে শিবানীও যেনো বুঝতে না পারে সেই ভাব করে তুফানী বলতে থাকে- এ দিক দিয়ে যাচ্ছিলামতো? তাই তোকে না জানিয়ে সারপ্রাইজ দিতে এলাম। কি বলিস ভালো করিনি? তুফানী যে এখানেও মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে সেটিও শিবানীর বুঝতে বাকি থাকে না। কারণ দুজনের বাড়িই বিপরীত পথে। পাশেই শিবানীর মা কাজ করছিলো। হঠাৎ কথাটা কানে বাজতেই রুম থেকে বেরুতে বেরুতে বলছে-হ্যাঁ মা! অবশ্যই ভালো করেছো। তুমিতো অনেকদিন হলো এখন আর আমাদের বাসায় আসো না। তো কেমন আছো বলো। প্রত‍্যুত্তরে তুফানী আমতা আমতা করে বলে- জ্বী আন্টি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন! -আমিও ভালো আছি মা। তোমরা বসে গল্প করো আমি তোমাদের খাবারের ব্যবস্থা করি। আর হ্যাঁ, এসেছো যখন অবশ্যই আজ আমাদের বাসায় থেকে যেতে হবে। তুফানী খুশিতে মনে মনে ভাবে এ যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। এ কথায় ক্ষাণিকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে তুফানী। 
 
চলবে...