logo
আপডেট : ৬ জানুয়ারী, ২০২৪ ০৯:৩৫
আজকের গল্প
লাকড়িজ্বলা ভোর
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ

লাকড়িজ্বলা ভোর

মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ

ভাঁপাপিঠা নামছে একের পর এক। হাত ঘষে ঘষে গরম করে সৌখিন হন্টনবন্ধুরা টপাটপ পিঠা গিলছে। ভোরের ঠাণ্ডা অক্সিজেনের জন্যই ব্যাকুলতা সবারই । এতদিনের খেয়ে খেয়ে মেদ জমানো শরীর। এবার ডাক্তারের কড়া
সিগনাল-ওজন কমাতে হবে।
রেলস্টেশনের জবুথবু মানুষগুলো নড়াচড়া করছে সাবধানে। একটু ঠাণ্ডার কণাও যেন গায়ের কোথাও আঘাত করতে না পারে। কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে সবাই। ঘণ্টি পড়েছে। কুয়াশার ভাব নমুনা বেরসিক। সূর্যের স্বাধীনতা আজ খর্ব। সকালের ট্রেনটা এসে যাবে।
 
চুলোর পাড়ে সব ধরনের মানুষেরই ছোটোখাটো ভীড়। নিয়মিত, অনিয়মিত। বাচ্চারা আগবাড়িয়ে আসে। পরম আগ্রহের সাথে চুলোর আগুন, পিঠার ভাঁপ,কুণ্ডলী পাকানো ধুঁয়ার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। চুলোকে গালি দিয়ে ফুঁয়োতে ফুঁয়োতে চোখ লাল করে ফেলেছে প্রমিলা।
তার ওপর কাঠের বিরিঞ্চিতে বসে পা নাচানো একাব্বর মেম্বার বাকিতে পিঠা খাচ্ছে। ঢেঁকুর তুলতে তুলতে টিজ করে চলেছে-এই শীতে তর ভাবির শরীলে হাত দিলেই চিক্কুর মারে।...
প্রমিলা শোনে। নীরবে বাটিতে চালের গুড়ো,নাড়কেল,গুড় সাজায়। সব কিছুর দুর্মূল্যের সুবাদে পিঠার সাইজও ছোট হয়ে যাচ্ছে। একাব্বর আবারো টিজ করে-কী রে,সাইজ তো ছোট কইরা ফালাইছস।
 
প্রমিলার টাইম নাই সেসবের জবাব দিতে। খানের পোলার বাড়িতে ত্রিশজন এসেছেন চিটগঙ থেকে।দুর্গাপুরের বিজয়পুর, রাণী খং, চিনামাটির পাহাড়ে যাবেন। ষাটটা পিঠার অর্ডার  দিয়েছে গতরাতে।কিন্তু একহাতে তা হয়ে ওঠে না। ও বাড়ির সুরতি বেগম প্লাস্টিকের হটপট রেখে গেছে। জমেও তো না। একটা একটা করে নামে,আবার চারপাশের কাস্টমারের পেটেও চলে যায়। ঠাণ্ডা পানি গ্লাসে নিয়ে খেলো একাব্বর। কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্নের অবতারণা করে-কী রে,হাত চলে না ক্যান। একলা একলা পারবি?এই জইন্য কইছি একটা দুইটা সন্তানে কাম অয় না। ব্যবসা করলে লোকজন লাগে। কী যে করস তোরা, বুঝি না।
-আপনের খাওন শ্যাষ? তাইলে উঠেন। জায়গা ছাড়েন। ট্যাহাডা দেওনের নাম নাইগগা।...
পিঠা নিতে এসে সুরতি বেগম তিনশত টাকা গুণে গুণে রাখে। প্রমিলার হ্যাণ্ড ক্যাশ আরো লাগবে।বাড়িতে শাশুড়িমা। পিত্তথলির পাথর অপসারণ করাতে ক্লিনিকে ষাট হাজার টাকা লাগবে। 
স্বামীতো মাটির নীচে শুয়ে বেঁচেছে। চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ে। করোনা কাল তার পড়াশুনা খেয়েছে। টাচফোন কিনে দিতে পারেনি। তাই আপাতত দিলু ঘটকের বাড়িতে যাওয়া আসা।
একাব্বর টাচফোন দিতে চেয়েছিল। বিনিময়ে চেয়েছিল একটু উষ্ণতা।
গেলোবার বর্ষাকালে স্কুুলের বারান্দায় জহুরা চাচিরে সব্বনাশটা করনেই তো সমস্যাডা হৈছে।একাব্বরকে আর বিশ্বাস করন যায় না।
 
পিঠা নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল সুরতি বেগম। ওর চোখে জল দেখে প্রমিলার প্রশ্ন-কীরে, তর আবার চোকখে পানি ক্যান? সয় সহালে চোখ মুছ্ কৈতাছি।
সুরতীর বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে শোনা গেলো -আমার বাচ্চাডা একটা পিডা খাইতে চাইছিলো।হারামজাদী খানের বৌডা ছেড়ার গালে এমুন জুরে একটা চড় বসাইছে,ছেড়াডার কানের পর্দা মন অইলো ফাইটটা গেছে! কান দিয়া গলগলায়া রক্ত পড়তাছে!
-তাই নাহি! খান সাবের বৌডাতো ভা--রি বজ্জাত!
এবার সুরতীর চোখ,গালে যেন ঝরণার জল গড়াচ্ছে । ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললো।
বাড়তি দুটি পিঠা দিয়ে দিলো প্রমিলা  সুরতীর ছেলের জন্য পয়সা ছাড়াই।
একাব্বর অপ্রস্তুত হয়ে কড়াভাবে ধমকে ওঠে-সহাইল্লা বেলা কুরাইশশায় ধরছে। এতে চিক্কুর পারনের কী আছে? তা ছাড়া তোরা বেঈমান। ছোটলোক। খানের বৌ বিরাট দিলের মানুষ। এইরম একটা মানুষই দেহিনা।
 
উঠে যাচ্ছিল একাব্বর। প্রমিলার রূঢ় গলা শোনা গেলো-আইজকা বাকি বাট্টা না দিলে যাইতাম দিতাম না! একাব্বরের লুঙ্গীর কোঁচা খামচে ধরে প্রমিলা। 
-আহহারে,ছাড় দেহি। কী করস? আমিকি না  করছি, যে,ট্যাহা দিতাম না? আরেকবার সবডি এক্কেবারে দিমু।
-চুপ কইরা বহেন মেম্বর! ট্যাহাডা ফালান!
একাব্বরের মাফলার,চাদর সব খুলে নিয়েছে প্রমিলা। ওর ছোট ছেলেটা এতক্ষণ নীরব দর্শক ছিল। হাততালি দিতে দিতে লাফাচ্ছে। এবার এক ঝটকায় মেম্বারের কোলে উঠে পড়ে। চিৎকার দেয়-আমমো,আইজকা আটকাইছি মেম্বররে!
 
ফাঁক বুঝে কাকটা  নেমে এসেছে মাটিতে। চুলো পর্যন্ত যাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। তবুও ওটা এগুচ্ছে।