আপডেট : ১৩ জানুয়ারী, ২০২৪ ১০:২২
আজকের গল্প
কপট জ্ঞান ও একটি বিবাহ
তফিল উদ্দিন মণ্ডল
তফিল উদ্দিন মণ্ডল
বিয়ের লগ্নটা ছিল রাত ১১:৩১:৩০ সেকেন্ড । আমার বন্ধুর পিসির বিয়ে। কদিন থেকেই সে আমাকে গুণ টানার মত টেনেই চলেছে। আমি শুভ্রকে বললাম-বন্ধু,পিসির বিয়ের সকল যোগাড় যন্তরের সাথে আমি থাকবো কিন্তু বিয়ের লগ্নে আমি থাকবো না।
শুভ্র বলল-কেন? তোকে তো থাকতেই হবে।
আমি বললাম-শোন! আমার রাশিটা হচ্ছে বিবাহ বিভ্রাট রাশি। এই রাশি বৈগুণ্য নিয়ে আমি যত বিয়েতেই উপস্থিত থেকেছি তুমুল হট্টগোল ছাড়া বিয়ে শেষ হয় নি। তাই এখন আমাদের সমাজে কেউ আর আমাকে বিয়ের বরযাত্রী হওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করে না।
শুভ্র হাসতে হাসতে বলল- ইউনিভার্সিটিতে পড়িস তবু সংস্কারমুক্ত হতে পারলি না। আর রাশি বৈগুণ্য হয়তো মুসলমানদের বিয়েতে বিভ্রাট সৃষ্টি করেছে কিন্তু হিন্দুর বিয়েতে বৈগুণ্য খুব একটা বিগড়াবে বলে মনে হয় না।
আমি বললাম- না রে বন্ধু,তবু একবার ভেবে দেখ। পাছে একটা কেলেঙ্কারি না হয়ে যায়।
আমাকে সে বলে কী, আরে শালা, তাহলে তো তোর বিয়েই করা হবে না। রাশি বৈগুণ্য তো তোর শেরওয়ানির নিচে বসে থাকবে। তখন কী হবে বল তো।
শুভ্র মন্দ বলে নি। আমার বিয়েতে রাশি বৈগুণ্যের কুপ্রভাবে এক বিয়ে দুই রাতে দুবার করতে হয়েছে। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। সে প্রসঙ্গ কাব্যে কুলোবে না বিংশতি পর্বের মহাকাব্যে রচিত হওয়া সম্ভব।
পিসির বিয়ের রাতে শুভ্র আমাকে কানে বড়শি লাগিয়ে টেনে নিয়ে গেল। বরপক্ষ এসেছে।সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে। চারিদিক দেখে আমার মনে আশার আলো ঝিলিক দিচ্ছে। এই বুঝি আমার বিবাহ বিভ্রাটের কলঙ্ক ঘুচলো।
কিন্তু বিভ্রাট বৈগুণ্য যে কোথায় সংগোপনে লুকিয়ে থাকে আর কখন যে অতর্কিতে বেরিয়ে পড়ে সেটা মালুম করা পণ্ডিতের পক্ষেও অসম্ভব। আমরা বসে বসে খুচরো আলাপ করছিলাম। বিয়ের লগ্ন পিলপিল করে এগিয়ে আসছিলো। আমি টিকিধারী পুরোহিতকে দেখে মৃণালকে বললাম- মৃণাল, আমার তো মনে হয় এ বামুন সংস্কৃতে খুব একটা পারদর্শী নয়।
মৃণাল বলল-কী করে বুঝলি?
বললাম-দেখিস না তার কাছে পাঁজিপুথির বস্তা। সর্বনাশ, বিয়ের আচার এবং মন্ত্রে যদি সামান্য ত্রুটিও ঘটে তাহলে তো সেটা বিয়ে হবে না।
মৃণাল বলল- ঠিকই তো? এখন কী করা যায় বলতো। আর হ্যা,এটা শুভ্রকে বলা যাবে না। এমনিতে ওর অনেক কাজ তার উপর একথা শুনলে ভাবনায় পড়ে যাবে। তারচেয়ে ভাল হয় চল আমরা পুরোহিতের বিদ্যাটা একটু পরখ করে আসি।
মৃণাল বলল-তুই কি করে পরখ করবি? তুই কি সংস্কৃত জানিস।
বললাম- আরে হাদারাম, পরখ করতে বিদ্যের দরকার নেই। কৌশল জানলেই হল।
আমরা দুবন্ধুতে উঠে পুরোহিতের কাছে গিয়ে লম্বা প্রণাম করে করজোড়ে বললাম- কত্তা, আপনার সাথে দুটো দরকারি কথা বলার ছিলো । আপনি যদি একটু আড়ালে আসেন।
আমরা পুকুর ধারে ঘাসের উপর বসে পড়লাম।
মৃণাল পুরোহিত মশাইকে বললো-কত্তা মশাই, আপনি কি সংস্কৃত মন্ত্রের মানে বুঝেন?
পুরোহিত বলল- কী বলছো এসব! মানে বুঝি না, মানে?
আমি বললাম-তাহলে এটার মানে করে দেন তো।
-বলো দেখি! তাচ্ছিল্যের সাথে পুরোহিত বললো ।
এখানে পাদটীকায় কিছু তথ্য প্রকাশ করার বাধ্যবাধকতা আছে। আমি যখন দশম শ্রেণিতে সংস্কৃতের ক্লাশ করতাম তখন সংস্কৃত প্রবেশিকা বইতে একটি গল্প ছিল। গল্পটি হল বায়স্যকৃষ্ণসর্পরাজপুত্রাদিকথা। ক্লাসে ব্যাকরণ আলোচনায় পণ্ডিত মহাশয় প্রশ্ন করলে আমি হা করে চেয়ে থাকতাম। বুঝতাম না কিছুই। ভাব দেখাতাম জানি সবই কিন্তু বলবো না। তাতে পুষ্টিদায়ক বেত্রাঘাতে পৃষ্ঠদেশ অলংকৃত হতো । পণ্ডিত মহাশয় বদনমণ্ডল ত্রিভুজাকৃতি করে যথাসম্ভব করালদংষ্ট্রারেখা প্রদর্শনপূর্বক বলতেন- কী ভেবেছিলে? বাংলা শব্দের শেষে হস্ যুক্ত ম আর অং বং চং লাগালেই সংস্কৃত হয়ে যায়?
পণ্ডিত মহাশয়ের সেই বক্রোক্তিতে আমি উপকৃত হয়েছিলাম। সেই থেকে আমি বাংলা ইংরেজি শব্দের সাথে অং বং চং লাগিয়ে সংস্কৃত এবং আন্ এন্ উন্ লাগিয়ে আরবি বানিয়ে ফেলতাম। সে বিদ্যে আজ কাজে লাগানোর উপযুক্ত সময় বলে মনে হল।
আমি বললাম-বলুন তো হোয়াটং মেরিজং। হোয়াটং আচারানি মন্ত্রং মেরিজঃ পিরিয়ডং?
পুরোহিত মশায় অনুস্বর বিসর্গ শুনে ভেবে বসলেন-এই সেরেছে। বাঘের উপর টাগ বুঝি বসলো?
পুরোহিত কোন রকম বাগাড়ম্বর না করে সহজ স্বীকারুক্তি ব্যক্ত করল। বলল-দেখো বাবা, পৌরহিত্য আমার চৌদ্দ পুরুষের পেশা। বাংলা অক্ষরে সংস্কৃত বানান করে পড়তে পারি তবে দেবনাগরিতে পারি না।
মৃণাল বলল-বিয়ের সময় মন্ত্রপাঠে সমস্যা হলে কিন্তু আপনি বিপদে পড়বেন। কেউ যদি মানে জানতে চায়?
আমি বললাম-বলুন তো বিয়ের এই মন্ত্রটা জানেন কি না। যদিদং তমুকং তব তদিদং অমুকং মম
খানাং দানাং দানম্ দক্ষিণাং প্রতিদানংসমঃ
মন্ত্র শোনে পুরোহিত বললো-বাবা তোমরা না ধরলে আর ভুলটা ধরবে কে?
মৃণাল বলল-আমরা মনে করেন ভুল ধরলাম না। তাতে আমাদের লাভ কী?
আমি ভাবলাম লগ্ন এগিয়ে আসছে। পুরোহিতের ডাক পড়ে যাবে। পাছে ঘটনা তিন কান হলে আমার বিবাহবিভ্রাট রাশি বৈগুণ্য আবার লোকসমাজে নতুন করে প্রমাণিত হবে।
মৃণালকে বললাম-ছেড়ে দে। আচ্ছা আপনি যান।
মৃণাল পুরোহিতকে বললো-যান তবে আমাদের কিছু হাতঝাড়া দিয়ে যাবেন।
বিয়ে শেষে পুরোহিত মশাই হাতঝাড়তে এসেছিলো। আমরা তাকে হাত ঝাড়তে দেই নি।
তখন কেবলই স্যারের কথা মনে পড়ছিলো। স্যার ক্লাসে বলতেন-তোরা যত বেশি মূর্খ হবি আমি তত বেশি জ্ঞানী হব। কেননা,মূর্খদের কাছে জ্ঞানী হতে খুব বেশি বিদ্যের প্রয়োজন হয় না।