logo
আপডেট : ১৪ জানুয়ারী, ২০২৪ ১০:৩৭
ধারাবাহিক উপন‍্যাস-তৃতীয় পর্ব
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন

 গহীনে নীল

 
শিবানী তুফানীকে নিয়ে সকালের নাস্তা সেরেই বলে - চল তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। তুফানী কোনো অমত না করে দুজনে মিলে বাড়ির পথে হাঁটা ধরে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই প্রতিবেশী এক পিসি দৌড়ে এসে বলে- তুফানী তুই কোথায় ছিলিরে?
- কেনো পিসি কী হয়েছে! 
-এদিকে সর্বনাশ হয়ে গেছে।
 -কী সর্বনাশ হয়েছে পিসি? 
-আরে পাগলি, তোকে না পেয়ে তোর কাকাবাবু জ্ঞান হারিয়ে বারবার মূর্চ্ছা যাচ্ছে। এই অবস্থায় মাতব্বর নিরঞ্জন বাবু আজ সকালে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।  কথাটা শুনামাত্রই তুফানী বাকরুদ্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ে। মুহুর্তেই যেনো তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তুফানী কাল বিলম্ব না করে কাকাবাবু, কাকাবাবু চিৎকার করতে করতে হাসপাতালের দিকে ছোটে। হাসপাতালে গিয়ে দেখে তার কাকাবাবু চোখ মেলছে না। শুধু তুফানী তুফানী করে পাগলের মতো বিরবির করছে। তুফানী কাকা বাবুর মাথার কাছে বসে কাকাবাবু বলে কয়েকবার ডাক দিতেই হঠাৎ চোখ মেলে তাকায়। তুফানীকে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে
-অ মা তুই হডে গেইলি মা! অ্যাঁই তোরে তোয়াই ন' পাই। অ্যাঁই আর হ'নো সমত শোর ন'গৈজ্জুম। অ্যাঁই বউত দোষ গরি ফেলাইরে মা! এন্ডল্যে আর ন' গৈজ্জুম। তুই অ্যাঁরে হতা দে, অ্যাঁরে ফেলাই হ'নো মিক্কা আর ন'যাবি। তুফানী নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনবরত কাঁদছে আর বলছে 
-আমি আর তোমাকে ফেলে কোথাও যাবো না। আমি আর কোনদিন এমন কাজ করবো না। কাকাবাবু তুমি আমাকে মাফ করে দাও।
 
কাকা বাবুর শারীরিক সুস্থতা ফিরে এলে তাকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসে তুফানী। কথামতো পড়াশোনায় ব্যাপক মনোনিবেশ করে সে। সামনে তুফানীর পরীক্ষা। পরীক্ষায় অবশ্যই ভালোকিছু করতে হবে তাকে। এই প্রতিজ্ঞায় তুফানী এখন আর কোনো দুষ্টুমির ধারে কাছে যায় না। ভালোভাবে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। পরীক্ষারদিন তুফানী কাকা বাবুর পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং ভালোভাবে পরীক্ষা দেয়। কিছুদিন পর পরীক্ষার ফলাফল বের হলে জানতে পারে তুফানী পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেছে। তুফানীর মুখ থেকে ফলাফলের খবর শুনতে পেয়ে হারাধন খুশিতে আত্মহারা হয়ে কেঁদে ফেলে। তুফানীকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদে আর বলে- আজিয়া তোর মা বাপ থাইলি হ'তো খুশি অইতু। তুফানী কাকা বাবুকে জিজ্ঞেস করে-আমার মা বাবা কোথায়? 
কাকাবাবুর আদরে মানুষ হওয়া তুফানী কোনদিনও তার বাবা মায়ের জিজ্ঞেস করেনি এবং প্রয়োজনও বোধ করেনি। আজ হঠাৎ বলে ফেলেছে-আমি বাবা মায়ের কাছে যাবো। তুফানীর কাকাবাবু এ কথা বলে চিন্তায় পড়ে যায়। এখন তুফানীকে কীভাবে বলবে তার বাবা মা দুনিয়াতে বেঁচে নেই! কিন্তু তুফানী তার কথায় অনড়। কাকাবাবু ভাবছে এখন সত্যিটা বলে দিলে যদি আবারও কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে? তাই ভয়ে কথাটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করে তুফানীর কাকাবাবু।
 
তুফানীর কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে ভর্তি হতে পারছে না। কারণ তুফানীর কাকাবাবু অত্যন্ত গরীব। দিন আনে দিন খায়। সৈকত বীচের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই তার কাকাবাবু হারাধনের বাড়ি। সে পেশায় একজন জেলে। প্রতিদিন মাছ ধরে যা পায় তাই দিয়ে সংসার চালায়। কোথায় পাবে সে এতো টাকা। মেয়েটা এস এস সি তে ভালো রেজাল্ট করেছে, যে করেই হউক তাকে ভালো একটা কলেজে ভর্তি করাতে হবে। নইলে যে তুফানীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে। তুফানীকে নিয়ে হারাধনের অনেক স্বপ্ন। সে লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ হবে। যদিও তুফানী হারাধনের পালিত মেয়ে। রাস্তা দিয়ে যখন হেঁটে যাবে তখন একজন আরেকজনকে আঙুল ইশারায় দেখাবে ঐ যে হারাধনের মেয়েটা যাচ্ছে। মেয়েটা কত ভালো। হারাধন তখন দূর থেকে বসে বসে সুখের ঢেঁকুর তুলে নিজেকে তৃপ্ত করবে। হারাধনের মনের গহীনে যখন এইসব ভাবনার পাখা মেলে তখন অজান্তেই হারিয়ে যায় কোনো এক স্বপ্নের মহারাজ্যে। আসলে কী হারাধনের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত হবে? এই সংশয়টা তার ভেতরকে অবিরাম ক্ষত করে চলে।
 
চলবে...