আপডেট : ১৬ জানুয়ারী, ২০২৪ ১০:৪৪
ধারাবাহিক উপন্যাস (পঞ্চম পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
বেলায়েত হোসেন
অনেকদিন হলো মাতব্বরের টাকা পরিশোধ করতে পারেনি হারাধন। যে কারণে হারাধনকে প্রায়ই তাগিদ দিয়ে যায় মাতব্বর। হারাধন টাকার কোনো ব্যবস্থা করতে না পেরে বারবার সময় প্রার্থনা করে। কিন্তু মাতব্বর তাকে আর সময় দিতে নারাজ। তবু শেষ সুযোগ হিসাবে হারাধনকে একটা সময় বেঁধে দিয়ে বলে- বিগত দিনে গৃহীত টাকায় সুদ এবং আসল মিলে যে পরিমাণ টাকা হয়েছে,তাতে বন্ধক রাখা বাড়িভিটার দাম ছাড়িয়ে গেছে। তাই একসাথে সর্বসাকুল্য পরিশোধ করতে না পারলে বাড়িভিটা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
মাতব্বরের কথা শুনে হারাধনের মাথায় হাত। এখন কী করবে সে ভেবে পায় না। টাকার চিন্তায় সারাদিন পাগলের মতো ঘুরে বেড়ায়। এরই মধ্যে আবার তুফানীর ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষার সময় হয়ে গেছে। ফরম ফিলাপ করতে হবে। ফরম ফিলাপের টাকার জন্য তুফানী তার কাকাবাবুকে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছে অবিরত। সবমিলিয়ে হারাধনের চারদিকে নেমে আসে অক্টোপাস অন্ধকার। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে সে। নীরব জলে বালিশ ভিজে সারারাত। ঘুমহারা চোখের পাতায় স্বপ্ন ভাঙার ঢেউগুলো আছড়ে পড়তে থাকে একের পর এক। অসুস্থ হয়ে হারাধন তখন একেবারেই বিছানায় শয্যাশায়ী।
হারাধনের শারীরিক অবস্থা ক্রমাগতভাবে খারাপের দিকেই যাচ্ছে। কোনো উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় তুফানীর মনোবল ভেঙে চুরমার। তুফানী কাকা বাবুর মাথার পাশে বসে মাথায় হাত বোলায় আর অঝোরে কাঁদে। হঠাৎ কান্নার কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে হারাধনের মুখমণ্ডলের উপর পড়ে। হারাধন চেয়ে দেখে তুফানীর চোখ থেকে অবিরত জল গড়িয়ে পড়ছে। হারাধন তুফানীকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে অ মা তুই হাঁন্দর ক্যা? অ্যাঁই তোর চোখ'র জল দেইন্নপারি। এই কথা বলছে আর তার মুখমণ্ডলে পড়া জল দুই হাতে নিয়ে তার সারা গায়ে মাখছে।
এমনটি দেখে তুফানী কাকা বাবুকে জিজ্ঞেস করে- তুমি এসব কী করতেছো। কাকাবাবু বলে ওঠে-তোর চোখ'র জল অ্যাঁই মাড়িত পরিবাল্লাই ন'দিয়ুম। তোর চোখ'র পানির বউত দাম। তোর চোখ'র মইধ্য অ্যাঁর স্বপ্নঅক্কল বাঁচি রইয়েদ্যে। এইল্লা স্বপ্ন অ্যাঁই হ'নোদিন চোখ'র পানিত ভাসি যাইত ন'দিয়ুম।
এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা যখন চলছে, তখন বাইরে থেকে বাতাসে ভেসে আসা একটি আওয়াজ তুফানীর কানে বেজে ওঠে-হারাধন বাড়িতে আছোস! ও হারাধন..তোকে বেঁধে দেওয়া সময়টুকুও আজ শেষ। হয় আমার টাকা দে নয়তো বাড়িভিটা ছেড়ে দে। কারণ তোকে দেওয়া টাকায় সুদে-আসলে যে পরিমাণ টাকা হয়েছে তাতে তোর বাড়ির দামের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে গেছে। তবু তুই আমার নিজের মানুষ হিসাবে বাড়তি টাকা মাফ করে দিলাম।
তুই এবার বাড়িটা ছেড়ে আমায় খালাস কর। কথাগুলো এক নিমিষে বলে ফেলে মাতব্বর নিরঞ্জন বাবু। এসব শুনে তুফানী ভাবে কর্তাবাবু আজ কাকা বাবুর সাথে এমন কর্কশ ভাষায় কথা বলছে ক্যান? কাকাবাবু এমন কী করেছে। প্রচণ্ড ঝড়ের পরে মুহুর্তেই যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলো সবকিছু।
তুফানীর হাতের উপর কাকা বাবুর হাত। আস্তে আস্তে তার হাতের উপর থেকে হাতটি সরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তুফানী। এসে দেখে মাতব্বর নিরঞ্জন বাবু এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে। তুফানী নতশিরে হাতজোড় করে মাতব্বরকে নমস্কার জানায়। কূ-নজরি দুষ্টু মাতব্বর তুফানীর রূপ দেখে লালসার ঢুক গিলে বলে-আরে তুফানী তুমি তো বেশ সুন্দর? অনেক বড় হয়ে গেছো দেখছি! নাদুসনুদুসও বটে। মাতব্বরের কথা শুনে তুফানী রীতিমতো হতবাক।
- কী যে বলেন কর্তাবাবু। আপনি এলাকার মাতব্বর, একজন সন্মানি মানুষ। আপনার মুখে এসব কথা মানায় না
-বাহ্ ভালোইতো উপদেশমূলক জ্ঞান বাক্য জানো দেখছি।
তুফানী কথা না বাড়িয়ে ভেতরে ভেতরে রাগে ফুলছে আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলে মাটি খুঁড়ছে। তুফানীর অবস্থান দেখে চতুর মাতব্বর বুঝে নেয় তার ভেতরের অবস্থা। তাই মুহুর্তেই কথার মারপ্যাচ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে
- হারাধন কোথায়?
-কাকাবাবু অসুস্থ।
-ঠিক আছে আজ আসি, আমি আবার আসবো। তুফানী মাতব্বরের কথায় খুবই চিন্তিত। কারণ তার চোখেমুখে যে খারাপ চিত্রটি ফোটে উঠতে দেখেছে তুফানী সেটি নিশ্চিত আগামীর বিপদ সংকেতেরই চিহ্ন।
তুফানী ঘরে ফিরে কাকাবাবুর কাছে জানতে চায় -নিরঞ্জন বাবু তোমার নিকট কিসের টাকা পায়? আর বাড়িভিটা ছাইড়া দিতে বলে ক্যান? আমারে খুইলা কও। আমার মা বাবা কই সবই আজ বলতে হবে। হারাধন তুফানীর জিজ্ঞাসার চাপে পড়ে বলে
- অ মা আজিয়া অ্যাঁই তোয়ারে বেগ্গিন খুলি বলি দিয়ুম। হ'নো কিছু আর ন' লুকায়ের। অ্যাঁর যে সময় শেষ অই গিয়ে গৈ।
চলবে...