logo
আপডেট : ১৯ জানুয়ারী, ২০২৪ ১২:১১
ধারাবাহিক উপন‍্যাস ( অষ্টম পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন

গহীনে নীল

মাতব্বর নিরঞ্জন বাবুর গায়ে আঘাতের ক্ষতস্থান থেকে অবিরত রক্ত ঝরতে থাকে। লোকলজ্জার ভয়ে কোনো প্রকার চিৎকার চেঁচামেচি না করে ক্ষতস্থান চেপে ধরে চুপচাপ বেরিয়ে যায় চিকিৎসার জন্য। তুফানী পালিয়ে গিয়ে পাগলের মতো ছোটাছুটি করে। কিন্তু কী করবে কোথায় যাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। তার ভেতরে তখন চরম শঙ্কা কাজ করছে। যদি মাতব্বরের হাতে ধরা পড়ে তাহলে তাকে প্রাণে মেরে ফেলবে।
সারাদিন ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে সে একসময় সৈকত কিনারে নীরব নির্জন একটি স্থানে গিয়ে বসে। সূর্যটা তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। ক্ষুধার্ত পাখিরা দিনভর আহার অন্বেষণের ব্যস্ততা কাটিয়ে দল বেঁধে আপন ঠিকানায় ফিরে যাচ্ছে। তুফানীর ঠিকানা কোথায়? এই প্রশ্ন তুফানীকে দারুণভাবে আঁকড়ে ধরছে। কিন্তু কোনো উত্তর মিলছে না। চারদিকে আলোর পালাবদলে আঁধারের ঘনত্ব ক্রমশই বেড়ে চলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নীরব নিস্তব্ধ রাক্ষুসেপুরির আবির্ভাব ঘটে। 
হঠাৎ পেছন থেকে একটি আওয়াজ তুফানীর কানে ভেসে আসে । আড়চোখে একটু পেছনে দৃষ্টি মেলতেই একটি আবছা ছায়া তার নজর কাড়ে। তুফানী ভয়ে একেবারেই জড়োসড়ো হয়ে যায়। গায়ের লোমগুলো তখন ঝাঁকুনি দিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভয়ার্ত তুফানী তখন দৌড় দিবে নাকি চিৎকার দিবে বুদ্ধি পায় না। এবার যা কিছু ঘটুক শেষ রক্ষার জন্য মনের জোর খাটিয়ে সাহসের সঙ্গে পেছনে ফিরে তাকায় তুফানী। খেয়াল করে দেখে দৃশ্যমান ছায়াটি একজন মানুষের মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। ভাবে আজ বুঝি এখানেই জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। অবশেষে মিনিট খানেকের মধ্যে ছায়াটি তুফানীর সামনে চলে আসে। তুফানীর তখন সন্দেহ কেটে মনের ভয় পালায়। আসলে সেটি ছায়া নয় বয়স্ক একজন মহিলা। অতি বয়সের ভারে সে কুঁজো হয়ে পড়েছে।
কুঁজো বুড়িটা আগবাড়িয়ে তুফানীকে জিজ্ঞেস করে-তুমি কেলাগো মাইয়্যা। এহানে এলহা এলহা কিতা করো? 
-অপেক্ষা করি। 
কুঁজো বুড়ি আবার জিজ্ঞেস করে 
-কার লাইগ্যা অপেক্ষা করো? তুফানী উত্তর দেয় 
-আমার বাবার জন্য। 
-তোমার বাবা কই গেছে?কহন আইবো?
 তুফানী কেঁদে কেঁদে বলে 
-আমার বাবাকে সাগরের ঢেউ ভাসায়া নিয়ে গেছে। ঐ যে দেখা যায় ঢেউগুলো আসতেছে! সেই ঢেউয়ের সাথে আমার বাবা ফিরে আসবে। তার জন্য এখানে অপেক্ষা করি। 
কুঁজো বুড়ির ততক্ষণে তুফানীর মনের ভাবটা বুঝে নিতে কষ্ট হয়নি। বুড়ি মনে মনে বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে-আমিওতো প্রতিদিন একজনকে খুঁজতে আসি এখানে। তুফানী তখন বুড়িকে জিজ্ঞেস করে 
-কিছু বলছেন?
- না না কিচ্ছু না। তুমি কই থাহো কই যাইবা? 
তুফানী কতক্ষণ চুপ করে থেকে বলে
- আমারতো যাওয়ার জায়গা নেই। 
-আমার লগে যাইবা? কই যাবো? ঐ যে দূরে বাত্বি জ্বালাইন্যা বস্তিডা দেহা যায়! আমি ঐ বস্তিডায় থাহি। আমার কেউ নাই। তয় আমার এককান নাতীন আছিলো, ঠিক তোমার লাহান। সে ও আইজ নাই। 
তুফানী বুড়িকে বলে ওঠে- আজ থেকে আমিও না হয় তোমার নাতিন।
- হ' তুই ত আমার নাতিনের লাহানই। আইজ থেইক্কা তুই-ই আমার নাতিন। তয় এককান কথা, আমি আমার নাতিনডারে তুই কইরা ডাকছি। এহন থেইক্কা তুই কইয়্যাই ডাকমু।
- আচ্ছা ঠিক আছে। 
তুফানী বুড়িকে ঠাম্মা সম্মোধন করে। তুফানী বুড়িকে জিজ্ঞেস করে
- কই গেছে তোমার নাতিন? 
বুড়ির কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর মুখে বলে
-হেইডা মেলা দুঃখের কথা। তুই আমার লগে ল' সব খুইল্যা কমু।
তুফানী মনে মনে ভাবে যার কেউ নেই নিশ্চয় তার স্রষ্টা আছে। হয়তো স্রষ্টা আজ আশীর্বাদ ক্রমে ঠাম্মাকে আমার জন্য পাঠিয়েছেন। তাই ঠাম্মার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে তার হাত ধরে বস্তির দিকে এগুতে থাকে এবং ঠাম্মার মুখে নাতিনের গল্প শুনতে মনোনিবেশ করে। ঠাম্মা বলতে শুরু করে
- কী কমু দুঃখের কথা। তয় মন দিয়া হুন। আমার নাতিনের নাম আছিলো সোহাগি। তার মা বাবা দুইজনেই দুইজনরে ভালা পাইতো। হের লাইগ্যা পছন্দ কইরা নিজেরাই বিয়া কইরা সংসার পাতছিল। তাগরে তার বাবার পরিবার মাইন্যা নেয় নাই। হেরা কামকাইজ কইরা মেলা কষ্টে সংসার চালাইতো। গেরামের মাইনষে তাগরে ভালা চোহে দেখতো না। মাইনষে কথায় কথায় খালি খুডা দিতো। হেইগুলি সহ্য কইরাই চলতাছিল। দুই বছর এক লগে সংসার করার বাদে তাগর কোলে আমার এই ফুটফইট্টা নাতিনডা আইলো। আমরাতো হগ্গলে মেলা খুশি। সোহাগ কইরা বেহে মিল্লা নাতিনডার নাম থুইছিল সোহাগি। আমার নাতিনডা মেলা সুন্দর আছিলো। এহেবারে তর লাহান দেখতে।
এই কথা শুনে তুফানী মনে মনে ভাবে আমি এক পোড়াকপালি তার আবার সুন্দর।  তুফানী আবারও ঠাম্মার কথায় মন দেয়।
- সোহাগির বাবা মা মাইনসের খুডার জ্বালায় ঠিক মতো কামে কাইজে যাইতে পারতো না। হের লাইগ্যা সংসারের আয়-রোজগারও কম।  নাতিনের দুধের পিছে মেলা টেহা লাগে। কইত্থনে এতো টেহা পাইবো। হরা দুইজনে মিল্লা বুদ্ধি পরামর্শ কইরা নাতিনডারে আমার লগে থুইয়্যা বেশি টেহা কামাই করবার লাইগ্যা বাড়ি ছাইড়া পার্বত্য জেলার চাকমা এলাকায় চইল্যা যায়। হেশে খবর পাইলাম ঐহানে থাকবার না পাইয়্যা সাগরের পাড়ের কোন্ একটা বস্তিতে আশ্রয় নিয়া থাকতো।
 
চলবে...