আপডেট : ২০ জানুয়ারী, ২০২৪ ১১:০১
ধারাবাহিক উপন্যাস (নবম পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
সোহাগির বাবা মায় মেলাদিন পরে পরে কয়ডা টেহা পাডাইতো হেই টেহা দিয়া নাতিনডারে পাইল্যা বড় করছিলাম। অভাগীর কফালে আর সুখ সইলো না। ঘরে তোর দাদাও নাই। অনেক আগে মইরা গেছে। আমার অইছে বড় জ্বালা। অনেকদিন অয় সোহাগির বাপ মায়ের কোনো খোঁজ খবর পাই না। তয় মাইনসের ধারে হুনছিলাম সাগরে নাহি ঘূন্যিঝড় উডছিল। মেলা পানি অইছিল। পরায় ২০ ফুডের লাহান। মানুষ গরু ছাগল আঁসমুরগী সব ভাসাইয়্যা লইয়্যা গেছিল। কেডা জানে হেরা দুইজন কই আছিল। আইজ পর্যন্ত হেগর কোনো খবর পাইলাম না। আমার মতন কফাল পোড়া মানুষ আরো এই দুইন্নাইত আছে তুইই ক' নাতীন? আমাগর বাড়ি আছিল সুসং পরগনার গারোপাহাড়ের কাছে সোমেশ্বরী গাঙের পাড়ে। উজান থেইক্কা পাহাড়ি ঢল নাইম্যা বাড়িডাও ভাইঙ্গা লইয়্যা গেল। তুই ক' বইন! এমন সুন্দর লকলইক্কা আতেপায়ে ডাঙ্গর নাতিনডা লইয়্যা আমি তহন কই যাই? বাড়ঘর নাই মাইনসের বাড়ির বারিন্দার কোনাকানায় থাহি। গেরামের বুড়া জোয়ান বেডাইনগুলি খালি উঁহিজুহি পারে। ডর লাগে না তুই ক'? এর লাইগ্যা ভাবলাম এহানে আর থাহন যাইব না। নাতিনডারে লইয়্যা তার বাপ মায়ের ধারে চইল্যা যামু। মেলা দিন আগে আমরার বাড়ির কাছের একটা লোক সোহাগির বাপের লগে এই জায়গায় থাকতো। এহন আর থাহে না। হের লগে যোগাযোগ কইরা ঠিহানা লইয়্যা এইহানে আইছলাম তার বাপ মার খুঁজে। তারা দুইজনডে না পাইয়া খুব অসুবিধাত পড়ছিলাম। বাদে এই বস্তির একজন দয়া কইরা আমাগরে এইহানে থাহার একটা ব্যবস্থা কইরা দেয়। হেইথেইক্কা আমরা নানি নাতীন এহানে থাহি। আমি কামকাইজ করবার পারি না। মাইনসের ধারে আত পাইত্যা যা পাইতাম তা দিয়া কোনো রহমে দুইবেলা চইল্যা যাইতো। এর মধ্যে আমি যহন অসুখে পইরা গেছি তহন তো আর খাওন দাওন চলে না। তহন আর কী করা, কোনো উপায় না দেইখ্যা নাতিনডা খুব সাহস কইরা এই বস্তির ছেমরিগর লগে পর্তিদিন সাগরের চরে চরে ঝিনুক টোহাইবার যাইতো। যা পাইতো দোহানে দোহানে বেইচ্ছা চাইল ডাইল কিইন্যা আনলে চুলায় আগুন জ্বলতো। নাতিনডা আমার দেখতে হুনতে মেলা সুন্দর আছিল। ঘরেত্থনে বাইর অইলেই মাইনসের নজর পরতো নাতিনডার উফরে। নাতিনডাও যেমুন কেমুন কেমুন করতো। আর করতোইনা ক্যান তুইই ক'? তার গায়েতো তহন ভরা যৈবন। গাঙে যেমুন জোয়ার আইলে জোয়ারের পানি টগবগ কইরা এইদিক হেইদিক উছলাইয়্যা যায়! তার গায়েতো হেইরহম জোয়ার বইতাছিল। বয়সের কালে বেহেরই এমুন একটা সময় আইয়্যে বুঝছ না। কী সুন্দর টানা টানা চউখ। যেমুন আছমানের দুইডা তারা ফুইট্টা রইছে। কী সুন্দর লম্বা নাক দেইখ্যা মনে অয় রাখালের বাঁশি। আর মুখটার দিহে চাইলেরে বইন মনে অইতো যেমুন ভরা আছমানের পুন্যিমার চাঁন। চাইরদিহে আলোর বন্যা বইতাছে। যহন আইট্টা যাইতো মনে অইতো রূফের ঠেলায় আইল্যা ঢুইল্যা পরতাছে। তয় হের লাইগ্যা মাইনসে পাগল অইতো না ক্যান? তুই জানোছ বইন! আমার যহন হের লাহান বয়স আছিল তহন তোর দাদায় আমারে আড়াল থেইক্কা পলাইয়া পলাইয়া দেখতো। তোর দাদায় মনে করতো আমি কিছুই বুঝি না। আড়েঠারে আমি সব বুঝবার পাইতাম।একদিনতো তোর দাদায় আমার কাছে ধরা পইরাই গেল। তহন কী লজ্জা! লজ্জায় এহেবারে চোখমুখ লাল অইয়্যা গেছিল। আমার মনে অয় নাতিনডাও কেউরে ভালাবায়। আমি বুইঝাও না বুঝার ভান কইরা থাকতাম। কিছুই কইতাম না। আইচ্ছা তুইই ক' বইন কেউতো কেউরে ভালাবাইতেই পারে। তয় আমারে খুইল্যা কইলে কী এমুন অইতো?
হেইদিনও নাতিনডা সহালে নাস্তা খাইয়্যা পর্তিদিনের লাহান ঝিনুক টোহাইতে যায়। হারাদিন পার অইয়্যা রাইত অইলো,আর ফিরা আইলো না। তুই ক' আমি একটা অসুইখ্যা মানুষ কেমনে তারে খোঁজবার লাইগ্যা যাই? অপেক্ষা করন ছাড়া আমার কোনো পথ আছিলো না। লগের ছেমরিগুলিও কিছু কইতে পারে নাই। আর কেডা কার খোঁজ রাহে। বেহেইতো যারযার পেডের ধান্ধায় ব্যস্ত থাহে। দুইদিন অপেক্ষা কইরা আমার শরীলডা কিছু ভালা অইলে হের পরথেইক্কা আমি তারে খোঁজবার বাইর অইছি। অহন পর্যন্ত পর্তেকদিন আমি তারে খুইজ্জা বেড়াই। সহালে বাইর অইয়্যা বেলা ডুইব্বা গেলে বস্তিত ফিরা আহি। অনেকদিন অইয়্যা গেল,অহনও তারে খুইজ্জা পাইলাম না।
এসব কথা শুনে তুফানীর চোখ দুটি জলে ছলছল করছে। মনে মনে ভাবে আমি এক পোড়া কপালি আরেক পোড়া কপালির দুয়ারে আশ্রিত হলাম। তবুতো স্রষ্টার অশেষ কৃপায় মাথা গুঁজবার একটু ঠাঁই হলো। তার যেনো শুকরিয়ার শেষ নেই। তুফানী তখন খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে। Many Many Thanks My God. তুফানী মাথানিচু করে বুড়ির মুখের দিকে তাকাতেই তার মায়াবী দৃষ্টির তীর এসে তুফানীর হৃদয় স্পর্শ করে। ততক্ষণে তুফানী আর স্থির থাকতে পারে না। আবেগী কণ্ঠে ঠাম্মা বলে কুঁজো বুড়ির বুকে মাথা গুঁজে হারিয়ে যায় প্রশান্তির এক মহাসাগরে।
চলবে...