logo
আপডেট : ২১ জানুয়ারী, ২০২৪ ০৬:৩৩
ধারাবাহিক উপন‍্যাস ( দশম পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন

গহীনে নীল

 
কুঁজোবুড়িও তখন আবেগে আপ্লুত হয়ে তুফানীকে জড়িয়ে নেয় মায়ার আঁচলে। হৃদয় নিঙড়ানো ভালোবাসায় আবদ্ধ করে সোহাগি শূন্যতার হাহাকারে। পথহারা পাখি যেমন এক চিলতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান পেলে শান্তিবিলাসে নিমগ্ন হয়! ঠিক তেমনি কুঁজোবুড়ির মায়ার আঁচলে আবদ্ধ হয়ে নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেলে তুফানী। গল্পের রেশ শেষ হতে না হতেই দু'জন বস্তির ভেতরে প্রবেশ করে। তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। দু'জনই খুব ক্লান্ত। কুঁজোবুড়ি ভাবে, এখন তুফানীকে কী খাওয়াবে। ঘরেতো কোনো খাবারদাবারের ব্যবস্থা নাই। সেটি তুফানীকে বুঝতে না দিয়ে কুঁজোবুড়ি একটু চতুরতার আশ্রয় নিয়ে বলে-তোর চোহেমুহে দেকতাছি মেলা ঘুম পাইছে। তুই একটা কাম কর, আতপাও ধুইয়্যা বাদে বিছনাত হুইত্তা আগে একটু ঘুমাইয়্যা নে। শরীলডা পাতলা অইবো। তুফানীও ঠাম্মার কথায় আর বিলম্ব না করে ঘুমিয়ে পড়ে। তুফানীর সাথে সাথে কুঁজোবুড়িও ঘুমে বিভোর হয়। রাতের অবসান ঘটে তাদের এক ঘুমে। 
প্রভাতী কিরণ আঁধার সরিয়ে আলো ছড়াতে ব্যস্ত। সবুজের পাতা চুঁয়ে ঝরা শিশিরের টপটপ মিষ্টি আওয়াজে ভোরের নীরবতা কাটে। সোনালী আলোর রশ্মিগুলো তখন বেড়ার ফাঁক দিয়ে তুফানীর চাঁদবদনী নরম ওষ্ঠ দুটি ছুঁয়ে দেয়। ঘুম-ভাঙা পাখিদের কলরবে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। অন্নের সন্ধানে বেরিয়ে যায় ঝাঁকে ঝাঁকে। কিন্তু তুফানীদের উনুনে আগুন জ্বলেনি এখনো। বস্তিতে ফিরে রাতেও কিছু খায়নি তারা। 
কুঁজোবুড়ি চিন্তায় নিমগ্ন কী রান্না করবে। এখনো তুফানীর ঘুম ভাঙেনি। এই ফাঁকে কুঁজোবুড়ি পাশের ঘর থেকে কিছু চাল-ডাল এনে উনুনে চড়ায়। রান্না শেষে তুফানীকে ঘুম থেকে তুলে দু'জনে মিলে এক সাথে আহারে বসে। আহারের শেষ প্রান্তে এসে তুফানী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চায় কুঁজোবুড়ি। 
কুঁজোবুড়ি তুফানী সম্পর্কে জানতে চাওয়ার কালে তুফানী একটু ইতস্ততবোধ করে। আহারের শেষ লোকমাটি তখন তুফানীর গলায় আটকে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে এক গ্লাস জল গিলে কিছুটা স্বাভাবিক হয়। একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তার জীবন গল্পের উন্মেষ ঘটায়। তার দুচোখ বেয়ে তখন অবিরত জলের ধারা নামে। বলার ফাঁকে ফাঁকে গায়ে জড়ানো ওড়নার সাহায্যে বার-বার চোখের জল মোছে। তবু যেনো থামে না তার চোখের জল। জন্মের পর থেকে তুফানী তার বাবা মাকে দেখেনি। সর্বকালের নির্মম এক প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের মধ্য দিয়ে তার পৃথিবীর আলো দেখা। ঝড়ের তাণ্ডবে সেদিন সৈকত এলাকার সবকিছু তচনচ করে দিয়ে গেছে। জলোচ্ছ্বাসের স্রোতের টানে ভেসে গেছে তুফানীর বাবাসহ আরো বহুজন। সবাই যখন যার যার প্রাণ রক্ষার্থে ব্যস্ত তখন কেবা কারা তুফানী এবং তার মা'কে একটি কাঠের  চৌকিতে শুয়ায়ে দেয়। জোয়ারের পানির স্রোতে সেটি ভেসে গিয়ে একটি ঝোপের উপরে আটকে যায়। প্রকৃতির নাটকীয়তায় সেদিন তুফানী বেঁচে গেলেও তার মা মারা যায়। অবশেষে তুফানী আশ্রিত হয় উদ্ধারকারী এক কাকা বাবুর কাছে। সেই কাকা বাবুর মুখের বর্ণনায় জানতে পারে তুফানী তার বেঁচে থাকার জীবন কাহিনী।
তুফনীকে উদ্ধার সম্পর্কে তার কাকা বাবুর ভাষ্যমতে জানা যায়, সে পেশায় একজন জেলে মানুষ। মাছ ধরে সে তার জীবিকা নির্বাহ করে। ঝড়ের ক'দিন পূর্ব থেকে সাগর উত্তাল থাকায় মাছ ধরতে যেতে পারেনি। তাই দু'দিন যাবৎ সে উপোস। ঝড়ের প্রভাব কমে গেলে জোয়ারের পানিও কমে যায় এবং সাগর শান্ত হয়ে আসে। ঝড়ের পরেরদিন ভোরবেলায় সে মাছ ধরতে যাওয়ার সময় দেখে রাস্তার পাশে বেত ঝোপের উপরে একটি চৌকি আটকে আছে। চৌকিটি দেখতে পেয়ে কৌতূহল বশে সেখানে যায় সে। সেখানে যেতেই একটি অদ্ভুত ধরনের কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। আওয়াজটি স্পষ্ট নয়। কিছুটা মানব শিশুর কান্নার আওয়াজ বলে মনে হয় তার কাছে। লোকজন ডেকে এনে চৌকিটি নামিয়ে দেখে একটি সুন্দর ফুটফুটে বাচ্ছা। বাচ্ছাটি দেখে তার খুব মায়া হয়। তাই আর কালক্ষেপণ না করে বাচ্ছাটি নিয়ে হাসপাতালে চলে যায়। চিকিৎসা দেওয়ার পর সুস্থ হলে তাকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসে। তার সংসারে আর কেউ নেই। অনেক যত্নসহকারে ভালোবাসা দিয়ে বাচ্চাটিকে লালনপালন করে। সময়মতো স্কুলে ভর্তি করায়। স্কুল শেষে কলেজে ভর্তির সময় তুফানীর কাকাবাবুর অসুস্থতার কারণে আর্থিক সমস্যায় পড়লে এলাকার মাতব্বর নিরঞ্জন বাবুর শরণাপন্ন হয়ে নিজের বাড়িভিটা বন্ধক রেখে টাকা এনে তুফানীকে কলেজে ভর্তি করে। সময় মতো মাতব্বরের টাকা পরিশোধ করতে না পারার কারণে তুফানীদের বাড়িতে মাতব্বরের আসাযাওয়া বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে তুফানীর উপর মাতব্বর নিরঞ্জন বাবুর কুনজর পড়ে। মাতব্বর নিরঞ্জন বাবুর কুনজরের কথা তার কাকাবাবু হারাধনের কানে আসলে উত্তেজিত অবস্থায় হার্ট অ্যাটাক করে হারাধন মারা যায়।
 
চলবে...