logo
আপডেট : ২২ জানুয়ারী, ২০২৪ ১০:২৫
ধরাবাহিক উপন‍্যাস ( একাদশ পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন

গহীনে নীল

হারাধনের মৃত্যুর পর তুফানীদের বাড়িতে  মাতব্বরের অধিকতর যাতায়ত বেড়ে যায়। লম্পট মাতব্বর তুফানীকে ভয়ভীতিসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করতে থাকে। এই অবস্থায় মাতব্বরের হাত থেকে তুফানীর ইজ্জত রক্ষার্থে কৌশলে দুঃসাহসিক এক কাণ্ড ঘটিয়ে পালিয়ে এসে আজকের  এই অবস্থানে উপনীত হয় তুফানী। এসব শুনে কুঁজোবুড়ির চোখ দুটি জলে ছলছল করতে থাকে। মুহুর্তেই যেনো হতভম্ব হয়ে পড়ে সে। এক ফাঁকে চোখের জল মুছে তুফানীকে স্নেহের কোলে জড়িয়ে সান্ত্বনার কণ্ঠে বলে- আমি আছি তোর কোনো চিন্তা নাই। মরি বাঁচি দুইজনে হগ্গল সময় এক লগে থাহুম। তুই খালি আমারে ছাইড়া যাইছ না। 
এইসব সান্ত্বনা শেষে কুঁজোবুড়ি কাজের অন্বেষণে বেরুতে চাইলে তুফানী কুঁজোবুড়ির সাথে যাইতে বায়না ধরে। বুড়ি বলে-তুই কই যাইবি! উত্তরে তুফানী বলে- আমি তোমার সাথে কাজে যাবো। ঠাম্মা আমারে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দাও। দরকার হলে ঝি এর কাজ করবো। তুফানীর কথা শুনে দুঃখের মাঝে হাসি পায় কুঁজোবুড়ির। বলে- আরে পাগলি, তুই এহানে নতুন মানুষ, চিনা নাই জানা নাই তোরে কেডা কাম দিব। তুফানী বলে- তুমি আছো না? তুমি সাথে থাকলে দেখবা মানুষ আমারে ঠিকই কাজ দিবে। আর তোমার এখন অনেক বয়স হয়েছে। আমারে একটা কাজের সন্ধান করে দাও তারপর থেকে তোমার আর কোনদিন কাজে যাইতে হবে না। বুড়ি বলে-নাগো নাতীন, এইডা অইবো না।- ক্যান হবে না? দিনকাল ভালা না। উড়তি বয়সের ছেমরাগুলাইন মাইয়্যা মানুষ দেখলে ফেলফেলাইয়্যা চাইয়্যা থাহে। কোন্ সময় কোনডা ঘইট্টা যায় কওন যায় না। আর তোর যেই রূপ, তোরে কামে দিয়া চান্দের লাহান দেহডা নষ্ট করন যাইবো না। -ইস্ ঠাম্মা, পেটে ভাত না থাকলে রূপ দিয়া কী করবো?
ততক্ষণে পূর্ব দিগন্তের ঘুমন্ত সূর্যটা কুয়াশার আবরণ ভেদ করে আস্তে আস্তে চড়াও হয় মাথার উপর। কুয়াশার জলে জবুথবু নুয়ে পড়া নরম পাপড়িগুলো কিরণ কণিকার পরশ মেখে শক্তি সঞ্চারে ব্যস্ত। আশপাশের স্থিতমান লোকালয়ের নীরবতা ভেঙে সরগম হয় পথঘাট। সবাই সবার কর্মব্যস্ততার গন্তব্যে চলমান। কিন্তু কুঁজোবুড়ি কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। ঘরে বসে থাকলেতো আর অন্নের যোগাড় হবে না? তাই তুফানীকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ঘরে রেখেই বেরিয়ে পড়ে অন্নের সন্ধানে। এদিকে একলা ঘরে তুফানী নীরবতার দর্পণে প্রবাহগত ঘটনার প্রতিচিত্রে নিমগ্নে নজর বিলায়। আচমকা দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে তুফানীর মগ্নতা কাটে। তুফানী ভেতরে ভেতরে কিঞ্চিৎ ভয় পায়। ভাবে আমি এখানে নতুন। কাউকে চিনি না জানি না কে না কে এলো দরজায় কড়া নাড়ছে কোনো কথা বলছে না! যদি কোনো দুষ্টু ছেলেপুলে হয় তাহলে? শুনছি বস্তিতে নাকি দুষ্টু ছেলেপুলের অভাব নেই। প্রায় ছেলেপুলে নাকি নেশাগ্রস্ত হয়ে থাকে। তাই ভয়ে কোনো প্রত্যুত্তর না করে চুপচাপ বিষয়টি অবলোকন করে। চামেলি ভাবে, কী ব্যাপার নানু আজ দরজা খুলছে না ক্যান? তাহলে নানুর কিছু হয়ে যায়নি তো? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জোরেশোরে দরজায় কড়া নাড়ে আর চিৎকার করে ডাকে- নানু দুয়ার গুছাও। তোমার আইজকা কী অইছে দরজা গুছাও না ক্যান! এই বস্তিতে যারা থাকে পেটের দায়ে সবাই খুব সকালেই যার যার কাজে বেরিয়ে পড়ে। বিভিন্নজন বিভিন্ন কাজ করে থাকে। কেউ টুকাইয়ের কাজ করে, বস্তি থেকে শহরের দূরত্ব কম থাকায় অধিকাংশ মহিলা শহরে গিয়ে বাসা বাড়িতে ঝি এর কাজ করে। কেউ কেউ সমুদ্র পাড়ে ঝিনুক কুড়ায়ে জীবিকা নির্বাহ করে। এভাবে তাদের প্রতিদিনের জীবন অতিবাহিত হয়। চামেলিও তাদের মতো একজন। বস্তির এই ঘরটিতে কুঁজোবুড়ি তার নাতীন সোহাগিকে নিয়ে থাকতো। চামেলি অন্য একটি বস্তির মেয়ে। সোহাগি আর চামেলি একই সাথে ঝিনুক কুড়ানোর কাজ করতো। সেই সুবাদে সোহাগির সাথে তার কিছুটা বন্ধুত্বের ভাব ঘটে। যে কারণে এই বস্তিতে মাঝেমধ্যে আসা-যাওয়া হয় তার। তবে ততটা ঘনিষ্ঠতা ছিলো না। সোহাগি একটা ছেলেকে পছন্দ করতো। চামেলি একটু একটু জানতো। কিন্তু ছেলেকে কোনোদিন দেখেনি সে। সোহাগি ছিলো চাঁপা স্বভাবের। চামেলিকে তেমন কিছু খুলে বলেনি কখনো। সোহাগি প্রেমের টানে হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেলে কুঁজোবুড়ি একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। নাতিনের এমন কাণ্ডতে কুঁজোবুড়ি খুবই মর্মাহত। তাই তাকে সান্ত্বনা দিতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে এখানে এসে কুঁজোবুড়িকে সঙ্গ দেয় চামেলি। আজকেও একই কারণে তার এখানে আসা। তুফানী দরজার বাইরে মেয়ে মানুষের কণ্ঠ বুঝতে পেরে ভেতর থেকে জানতে চায় -কে আপনি! ঘরের ভেতরে স্বল্পবয়সী মেয়ের কণ্ঠ শুনে চামেলি একটু অবাক হলেও বিস্মিত সুরে জানায়-আমি চামেলি। তয় আফনে কেডা দুয়ার গুছান। তুফানী ওঠে গিয়ে দরজা খুলতেই চামেলির চক্ষু চড়কগাছ। -কী ব্যাপার আমি ভুল দেখতাছিনা তো! সোহাগি তুই? আমি সোহাগি না আমি তুফানী। আপনি ভুল দেখতেছেন। ভুল? হ্যাঁ ভুল। চামেলি একটু বিব্রত হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে, এইডা কেমনে সম্ভব বুঝবার পাইতাছি না। তয় অইবার পারে। মানুষ মানুষের লাহান অয় না? চামেলি নিজে নিজে এই সান্ত্বনার ঢুক গিলে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে বলে- সোহাগি আমার বান্ধবী আছিলো,দেখতে ঠিক আফনের লাহান। আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে আমি আপনার বন্ধু হইতে পারি না? -কী যে কইন পারতেন না কিয়ের লাইগ্যা। একশোবার পারবেন। এই বলে দু'জন দু'জনের বন্ধুত্বের হাত মিলায়। চামেলি কুঁজোবুড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে তুফানী জানায়-ঠাম্মা কাজে গেছে।
 
চলবে...