logo
আপডেট : ২৫ জানুয়ারী, ২০২৪ ০৯:৫৯
ধারাবাহিক উপন‍্যাস (চতুর্দশ পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন

গহীনে নীল

তুফানী হতবাক হয়ে লজ্জাবনত অবস্থায় মাথানিচু করে আড়চোখে লোকটিকে দেখে আর ভাবে, মানুষ এত সুন্দর হতে পারে? কোনোভাবেই তুফানীর চোখ দুটি সরে না লোকটির উপর থেকে। তুফানী কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে : কী বলবেন বলেন। লোকটি তুফানীর জানতে চাওয়া প্রশ্নের জবাবে বলে: আপনি অনেক সুন্দর।
 : প্রশংসার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। তবে আপনি কী প্রশংসা করার জন্য এখানে আসছেন? লোকটি তখন তুফানীর কথায় একটু আমতা আমতা শুরু করে। এবার তুফানী সুধায়: কী ব্যাপার আপনি এমন আমতা আমতা করছেন কেনো? কী বলবেন পরিষ্কার করে খুলে বলুন। দেখেন! আমি সোজা সরল মানুষ সোজা কথা বলি,সোজা পথে চলি, যাকে যা বলি সরল মনে বলে দেই। অন্যের কাছ থেকেও সোজাসাপটা উত্তর শুনতে পছন্দ করি। তুফানীর কথা শুনে লোকটি আরো ঘাবড়ে যায়। লোকটি তখন: না মানে...। 
: আবারও না মানে? 
: বলছিলাম কি? 
: কী বলছিলেন বলুন? 
: বলছিলাম, আমি অনেকক্ষণ যাবৎ লক্ষ করছি আপনি একা একা হাঁটছেন কেমন যেনো আনমনা একটা ভাব প্রকাশ পাচ্ছে আপনার মধ্যে। তাই জিজ্ঞেস করলাম। তুফানী জানতে চায় : আপনি কী করে বুঝলেন? আমি আনমনা হয়ে হাঁটছি?
:  না মানে.. একা একা হাঁটার মধ্যে অন্যমনস্ক একটা ভাব আপনার অঙ্গভঙ্গিতে ফোটে উঠছিল তাই বললাম। 
: বাহঃ দারুণ তো! আপনি দেখছি এ সম্পর্কে ভালোই ধারণা রাখেন। লোকটি একটু হাঁসফাঁস ছেড়ে বলে: তাইবুঝি? উত্তরে তুফানী জানায় : হ্যাঁ তাই। লোকটি এবার আবেদনের সুরে বলে:  কী ভাবছিলেন আমাকে শেয়ার করা যায়? তুফানী চুপ, কোনো কথা বলছে না। মনে মনে ভাবে, লোকটিকে আমি চিনি না জানি না, তাকে কেনো আমার কথা বলবো? তুফানীকে চুপ দেখে লোকটি আবারও জিজ্ঞেস করে : কী কিছু বলছেন না যে? তুফানী প্রত্যুত্তরে বলে: কী বলবো? : ঠিক আছে না বললেন। তবে আপনার নামটি তো জানতে পারি তাই না? তুফানী বেশ ভেবেচিন্তে বলে: আমি অনেক বড় তুফানের মধ্যে এই পৃথিবীর আলোর মুখ দেখেছিলাম তো? তাই সবাই আমার নাম রেখেছে তুফানী। 
: বাহ্ দারুণ তো? আপনি কী করেন? 
তুফানীর সোজাসাপটা জবাব। 
: আমি ঝিনুক থেকে মুক্তা কুড়াই। সেগুলো বিক্রি করে দাদী নাতিনের সংসার চালাই। 
তুফানী জানতে চায় : তবে আপনি কে মহাশয়? আপনার পরিচয় বলুন। লোকটি তুফানীকে আরো একটু পরখ করার ছলে, তার নাম পরিচয় গোপন রেখে জানায়:  আমি একজন মানুষ। লোকটির এমন কথা শুনে তুফানীর মনে একটু কষ্টের দাগ লেগে যায়। বাকি পরিচয় জানার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে তুফানী, লোকটির পরিচয় গোপন রাখার কারণে। মুহুর্তেই তুফানীর চোখেমুখে মলিনতার ছায়া মেলে। গোধুলি পেরিয়ে তখন আঁধার ঘনিয়ে আসছে। লোকটির কথায় পাওয়া কষ্টটা ভেতরে চেপে রেখে তুফানী বলে:  আমাকে এখনি বাড়ি ফিরতে হবে। নইলে ঠাম্মা চিন্তায় অস্থির হয়ে যাবে। তুফানী দ্রুত বাড়ির পথে পা বাড়ালে লোকটি পথরোধ করে জানতে চায় : আপনি কী চলে যাচ্ছেন? তুফানী এক কথায় জানায়: জ্বী। লোকটি জানতে চায়: আবার কখনো দেখা হবে? তুুফানীর ঠাটপাট উত্তর: জানি না। তুফানীর জবাবে যে অভিমানী সুর তা বুঝতে বাকি থাকেনি লোকটির। তুফানীর চোখেমুখে কিঞ্চিৎ রাগের ছায়া ফোটে উঠায় আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস পায়নি সে। শুধু বোবার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে দৃষ্টি বিলায় তুফানীর প্রস্থান পথে। মুহুর্তেই যেনো ঘনকালো আঁধারে মিলিয়ে যায় তুফানীর হেঁটে যাওয়া পথের দৃষ্টি সীমানা।
গভীর সমুদ্রে তখন বেসামাল গর্জন। একেকটা ঢেউ যেনো পালাক্রমে আছড়ে পড়ছে সৈকত কিনারে। যার আঘাতে অবিরত ভেঙে চলেছে সুমনের হৃদয় পাড়। সুমন হলো কথিত লোকটির নাম। তুফানীর এভাবে চলে যাওয়া কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না সুমন। নিজেকে সে খুবই অপরাধী ভাবছে। তুফানীর প্রশ্নের জবাব এভাবে এড়িয়ে যাওয়া মোটেও ঠিক হয়নি তার। নিজের ভুলের তীর নিজেকেই বিদ্ধ করে চলেছে অনবরত। তুফানী কোথায় থাকে তাও জানা হলো না। তাহলে হয়তো, একবার সরি বলা যেতো। এদিকে তুফানী বাড়ি ফিরে সাথে সাথে বিছানায় শুয়ে পড়ে। প্রচণ্ড মন খারাপ তার। এ অবস্থায় কুঁজোবুড়ি পাশে বসে তুফানীকে জিজ্ঞেস করে -তোরে আইজকা এমন লাগতাছে ক্যান! তোর কী অইছে বইন। আমারে খুইল্যা ক' দেহি? জবাবে তুফানী বলে: কিচ্ছু হয় নাই। : তোর শইলডা খারাপ করছে বইন? তুফানীর এক কথার উত্তর:  না। তয় মন খারাপ? তুফানী এবার মেজাজ গরম করে জানায়:  জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না। :আইচ্ছা জানুন লাগবো না। সারাদিনে আইছস্ আয় আগে খাইয়্যা যা। : আমার ক্ষিদা নাই। আমারে একটু একা থাকতে দাও ঠাম্মা। আমারে এখন বিরক্ত করো না তো? তুমি তোমার বিছানায় যাও। কুঁজোবুড়ির আর বুঝতে বাকি থকলো না। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। তবে মাথা ঠাণ্ডা হলে জানা যাবে। কুঁজোবুড়ি তুফানীকে আর বিরক্ত না করে নিজের বিছানায় চলে যায়। তুফানীর চোখে ঘুম নেই। লোকটির উপর থেকে রাগ যেনো কমছেই না তার। তুফানী নিজেকে প্রশ্নের জালে আবদ্ধ করে চলছে। লোকটি আমার সাথে এমন করলো কেনো? যদি তার পরিচয় নাইবা দিবে তাহলে আমার পরিচয় নেওয়ার মানে কী? আর কেনোইবা আমার পিছু নিয়েছে সে? তুফানী কিছুতেই এর হিসাব মিলাতে পারছে না। এসব ভাবনার ঘোরের মাঝে কখন যে যামিনী পেরিয়ে পূর্বদিগন্তের উদিত সূর্যটা গাছগাছালির মাথার উপর এসে স্থির হয়, তুফানীর তা বোধের বাইরে।
তুফানী এখনো বিছানা ছাড়েনি, কাজেও যায়নি। কুঁজোবুড়ি কিছু বুদ্ধি না পেয়ে চামেলিকে ডেকে আনে। চামেলি এসে তুফানীকে জিজ্ঞেস করে :এহনো উডোছ না ক্যান? উত্তরে জানায়:  এমনি। : খাইছস? : না। : কাজে যাসনাই ক্যান? :মন চায়নি তাই। : কী অইছে তোর, এমনে কথা কইতাছোস ক্যান! তুই আমারে ক' হুনি একটু। : দেখ চামেলি, তুই তোর কাজে যা। আমার এসব তোকে শুনতে হবে না। :আইচ্ছা আর হুনতাম চাইও না। তয় এইবার লক্ষী মাইয়্যার মতন উইট্টা খাইয়্যা ল'। : আমি খাবো না। এবার চামেলি তুফানীকে:  তবে রে শয়তানী...। জোর করে টেনে তুলতে যায় চামেলি। তুফানী চামেলির সাথে শক্তিতে কুলোতে না পেরে বাধ্য হয় বিছানা ছাড়তে। কুঁজোবুড়ি তড়িঘড়ি করে খাবার নিয়ে আসে। খাবার শেষে চামেলিকে সব খুলে বলে তুফানী। চামেলি সবকিছু শুনে তুফানীকে বুঝাতে চেষ্টা করে। : দেখ তুফানী, আমরা অইলাম গরীব মানুষ।  বামন অইয়্যা চাঁন ধরার স্বপ্ন আমাগর মানায় না। এইগুলাইন অইলো বড়লোকগর স্বপ্ন। আমাগর না। আইজ যদি গরীব না অইয়্যা প্রতিষ্ঠিত বড় কেউ অইতি তাইলে এমুনডা মানাইতো। হেরা অইলো বড়লোক মানুষ। হেগর বেলায় এইগুলাইন হাজে। হেরার যাই ইচ্ছা তাইই করবার পারে। কিন্তুক আমরা এইগুলাইন পারি না। আমাগর বুইজ্জা হুইন্যা পাও ফালাইতে অয়। বুদ্ধিমান চামেলির বুঝমান কথায় তুফানীর নিবৃত মনে সতেজতার পাখা মেলে।
 
চলবে..