logo
আপডেট : ২৬ জানুয়ারী, ২০২৪ ১১:২৭
ধারাবাহিক উপন‍্যাস (পঞ্চদশ পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন

গহীনে নীল

বেলায়েত হোসেন

তুফানী চামেলির কথায় মন থেকে সবকিছু ঝেড়ে মুছে নতুন উদ্যমে আবারও তার কাজে মনোনিবেশ করে। ভেতরে তার জ্বলন্ত আকাঙ্ক্ষা, যে করেই হোক জীবন সংগ্রামে লক্ষ্যে পৌঁছতেই হবে তাকে। এই প্রতিজ্ঞায় সে অনড়। লক্ষ্য স্থির করে কাজের গতি ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে চলেছে সে। এভাবে সে বেশ লম্বা একটা সময় পার করে। দুই তিন বছরের ব্যবধানে অর্থকড়িও ভালোই জমেছে হাতে। সেই অর্থ দিয়ে সৈকত বীচে একটি দোকানের ব্যবস্থা করে তুফানী। প্রথমে স্থানীয় কয়েকজন মেয়ে নিয়ে একটি দল গঠন করে। দলের মেয়েরা দিনভর ঝিনুক কুড়ায়ে যে মুক্তোগুলো সংগ্রহ করে আনে, তুফানী সেগুলো উপযুক্ত দামে কিনে অলঙ্কার তৈরির কারখানায় সেল দেয়। সাথে ঝিনুকের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে তার দোকানে। এভাবে ব্যবসার উন্নতি ঘটলে সহসাই অর্থনৈতিক ভীত মজবুত হয় তার। কিছুদিনের মধ্যেই চারদিকে তার ব্যবসার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এ লাইনে সে এখন প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী হিসাবে চিহ্নিত। 
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ব্যবসার এইক্ষেত্রে আসতে পথে পথে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে তার। ছিলো নানানরকম বাধাবিপত্তি। বীচে অবস্থিত দোকানগুলো কতিপয় স্থানীয় বড়ভাইদের নিয়ন্ত্রণে। মাসের শেষে প্রতিটা দোকান থেকে তাদেরকে মাসোহারা দিতে হতো। জানা যায় তাদের উপরেও নাকি একজন বড়ভাই আছে। সে কখনো জনসমক্ষে দেখা দেয় না। এমন কী এই এলাকায় আসেও না। আড়ালে বসে তার পোষা ছেলেপেলেদের কাছ থেকে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে মাসোহারার ভাগ বুঝে নেয়। 
এসব নানামুখী ঝামেলা চুকিয়ে নির্বিঘ্নে ব্যবসা পরিচালনা করা ছিলো তুফানীর জন্য দুরূহ কাজ। কারণ একেতো সে মেয়ে মানুষ, দ্বিতীয়ত সে এই বীচে সকল দোকানীদের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠা। তার উপর আবার এলাকার বড়ভাইদের কুনজর। এসব ঝক্কিঝামেলা ধৈর্যসহকারে ঠাণ্ডা মাথায় উপযুক্ত বুদ্ধির কৌশল খাটিয়ে সবকিছুর মোকাবেলা করতো তুফানী। আস্তে আস্তে ব্যবসায় ফিরে আসে নির্বিঘ্নতা। সুগম হয় লক্ষ্যে পৌঁছার পথ। এই অবস্থায় তার ব্যবসার পরিধি আরো প্রসারিত করতে জেলাশহরে একটি শোরুম খোলার পরিকল্পনা করে। তবে তার আগে মাতব্বর নিরঞ্জন বাবুর নিকটে বন্ধকী রাখা কাকাবাবুর বাড়িভিটা ছাড়িয়ে আনতে চায় তুফানী। তার কাকাবাবুর একমাত্র সম্বল ছিলো এই বাড়িভিটা। তুফানীর কলেজের খরচ মেটাতে না পারায় এই বাড়িটা মাতব্বরের নিকট বন্ধকী রাখা ছিলো। সময়মতো বন্ধকীর টাকা পরিশোধ করতে না পারায় বাড়িভিটা হাতছাড়া হয়ে যায়। তুফানীর কাকাবাবু মারা গেলে মাতব্বর কর্তৃক তুফানীর উপর নানামুখী কুমতলবী উৎপাত শুরু হয়। একসময় উৎপাতের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেলে নিজেকে রক্ষা করতে পালিয়ে বাড়ি ছাড়া হয়েছিল তুফানী। তারপর দীর্ঘদিন ধরে পালানো অবস্থায় থেকে নানানরকম চড়াইউৎরাই পার করে জীবনের এ অধ্যায়ে পা রাখে তুফানী। 
 
এতদিন পরেও তুফানীর কথা ভুলেনি মাতব্বর। হায়েনার মতো ছিঁড়ে খাওয়ার আক্রোশী মনোভাব নিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় তুফানীকে। মাতব্বরের উপরের রূপ দেখে এলাকাবাসী কখনো আন্দাজ করতে পারেনি তার ভেতরটা কতো হিংস্র কুৎসিত এবং অপকারিতায় ভরা। সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে সে চাঁদাবাজিসহ নানানরকম অপকর্ম করে বেড়ায়। তুফানী এতদিন যাবৎ যে এলাকাটিতে ব্যবসা করে আসছে সেটি মাতব্বরেরই পোষা ছেলেপেলে দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু তুফানী সেটা জানতো না। মাতব্বরও জানতো না তুফানী এই এলাকায় থাকে।  নিয়ন্ত্রিত ছেলেপেলেরাও কখনো মাতব্বরকে সরাসরি দেখেনি। শুধু জানে তাদের উপরে শক্তিধর একজন বড়ভাই আছে। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা কথিত বড়ভাইরূপি মাতব্বর নিরঞ্জন বাবু ভিন্ন কায়দা কৌশলে নিয়ন্ত্রিতদের নিকট থেকে মাসোহারার হিসাব বুঝে নিতো। পোষা ছেলেপলেগুলো প্রথমদিকে সঠিকভাবে হিসাব বুঝালেও পরবর্তীতে তাদের আড়ালে থাকা বড়ভাইকে না দেখতে পেয়ে হিসাবে গড়মিল শুরু করে। তাতে মাতব্বরের মনে সন্দেহ জাগে। মাতব্বর গোপনে কাউকে না জানিয়ে হঠাৎ একদিন ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়ে সরেজমিনে যাচাই এবং বীচে অবস্থিত দোকানগুলির পরিসংখ্যানের জন্য। অনেকে এখনো দোকানে আসেনি। তুফানী সবেমাত্র দোকানের সার্টারটি খুলছে। এমন সময় মাতব্বর নিরঞ্জন বাবু সেখানে গিয়ে হাজির। তুফানী মাতব্বরকে এখানে দেখেতো অবাক। হতচকিত তুফানী ভাবে, কী ব্যাপার মাতব্বর এখানে কেনো বা কী করতে এলো? তবে কী মাতব্বর কোনোভাবে আমার সন্ধান আগে থেকেই পেয়ে গেছিলো? নাকি অন্য কোনো কারণে এখানে আসছে? মুহুর্তেই যখন এসব প্রশ্ন তার মনে দানা বাঁধতে থাকে, ঠিক তখনি মাতব্বরও তুফানীকে সামনে পেয়ে হুংকার ছেড়ে বলে 
: ও তুই তাহলে আমার হাত থেকে পালিয়ে এসে এতদিন যাবৎ এখানেই অবস্থান করছিলি? যাক্ ভালোই হলো আজ এক ঢিলে আজ দুই পাখি শিকার হবে। লম্পট মাতব্বর বলতে থাকে: আজ তোকে পেয়েছি। তোর পালানোর জয়গা শেষ। দেখি আজ আমার হাত থেকে তোকে কে বাঁচায়।
তুফানী কিছু বুঝে উঠার আগেই মাতব্বর প্রতিশোধের আগুন নেভাতে নরপশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তুফানীর উপর। তুফানী বাঁচাও বাঁচাও বলে সজোরে চিৎকারসহ প্রাণপণে চেষ্টা করে মাতব্বরের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য। তার চিৎকারে আশপাশের দু একজন এগিয়ে আসলেও এরা হলো ঝিনুক কুড়নো বাচ্চা পোলাপান। ভয়ে কিছু বলা বা সহযোগিতার সাহস পায় না তারা। শুধু সিনেমার দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখে।
তুফানীও হেরে যাওয়ার পাত্রী নয়। তার ভেতরেও দীর্ঘদিনের প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিলো। তুফানী প্রাণপণে চেষ্টা করে কোনোভাবে একটি হাত ছাড়িয়ে মাতব্বরের টুঁটি চেপে ধরে এবং চিৎকার চেঁচামেচিতে আকাশ বাতাস ভারী করে তোলে। এদিকে সম্ভবত গতরাতেই কোম্পানির কোনো কাজে এসে বীচের পাশে একটি হোটেলে অবস্থান করছিলো সুমন। এখনো তার পুরোপুরি ঘুম ভাঙেনি। আধা ভাঙা ঘুমের মধ্যে হঠাৎ মেয়ে মানুষের চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পায়। বালিশ থেকে মাথাটা তুলে বুঝতে পারে আওয়াজটা কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকেই আসছে। সুমন আস্তে আস্তে হোটেল থেকে বেরিয়ে সেখানে যায়। ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখে একটি দোকানে একজন আধবয়সী পুরুষ একটি মেয়ের সাথে ধস্তাধস্তি করছে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে মেয়েটি পুরুষটির নিচে পড়ে গেলে আপ্রাণ চেষ্টা করে উঠার জন্য। কিন্তু শক্তির ব্যবধানে পেরে ওঠে না। 
এ অবস্থা দেখে সুমনের মাথার রক্ত গরম হয়ে যায়। দৌড়ে গিয়ে পুরুষটির কলার ধরে টেনে তুলে পরপর কয়েকটি ঘুষি লাগিয়ে দেয়। লোকটি ঘুষির আঘাতে চোখমুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে। একপর্যায়ে জ্ঞান হারা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মেয়েটি তখন ওঠে দাঁড়াতেই  সুমন তুফানীকে চিনে ফেলে। বলে:  আরে তুফানী আপনি? তুফানী সুমনকে চিনেও না চেনার ভান করে। সেদিন সুমনের নাম পরিচয় গোপনের অভিমানটি আজ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তুফানীর মনে। তাই অভিমানী সুরে বলে: কে তুফানী? এখানে কোনো তুফানী টুফানী নাই। আর আমি তুফানী হই বা না হই তাতে আপনার কী আসে যায়? এ কথার ফাঁকে তুফানী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ওড়নার আঁচলে একবার চোখ দুটি মুছে নেয়। সুমনও ততক্ষণে খুঁজে নেয় অভিমানের সূত্র। সেদিন ভুল করেছে সুমন তবে আজ আর ভুল করতে রাজি নয়। তাই মুহুর্তের কালক্ষেপণ না করে তুফানীর হাত ধরে ঐ দিনের ঘটনার জন্য সরি জানায়। তুফানী আর স্থির থাকতে না পারেনি। খেয়ালের বাইরে কখন যে তুফানীর মাথাটা সুমনের বুকে হেলে পড়ে তা অনুমেয় নয়।
 
চলবে...