logo
আপডেট : ২৮ জানুয়ারী, ২০২৪ ১০:০৭
ধারাবাহিক উপন‍্যাস (সপ্তদশ পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন

গহীনে নীল

সবকিছু হারিয়ে সুমন এখন নিঃস্ব। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় গভীর সমুদ্রের দ্বীপ কুতুবদিয়ায় তার জন্মস্থানে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে তার এলাকা চিহ্নিত করতে পারেনি। এমন কী তার কোনো স্বজনেরও সন্ধান করতে পারেনি। তার এলাকার পুরোটাই সমুদ্রের অতলে বিলীন হয়ে গেছে। তাই আবার ফিরে আসে জেলা শহরে। বেঁচে থাকার তাগিদে এ বয়সেই নামতে হয় তাকে জীবন যুদ্ধের মহড়ায়। তখন তার বয়স সবে মাত্র এগারো কী বারো হবে। জীবন যুদ্ধের এই কঠিন মহড়ায় সুমন কী পারবে উত্তীর্ণ হতে? বাস্তবতা যে বড়োই কঠিন এবং নির্মম। শুরু হয় তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের পথচলা। সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। রাত হলে কোটকাচারীর বারান্দায় ঘুমায়। কেউ কিছু দিলে সেগুলো দিয়ে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করে। মাঝেমধ্যে স্থানীয় প্রশাসনের দারস্থ হলে কিছু আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা পায়। এভাবে চলতে থাকে তার প্রাত্যহিক জীবন যুদ্ধ। সুমন বয়সে ছোট হলেও সে খুব বুদ্ধিমান।  বিভিন্নজনের সহযোগিতায় তার কাছে এখন বেশকিছু অর্থ জমেছে। মানুষের কাছে হাত পাতা যে অভিশাপ সেটিও সে বুঝে কিন্তু এই মুহুর্তে তার আর কিছু করার ছিলো না। ঘৃণিত এই পথ থেকে সরে দাঁড়াতে চায় সুমন। মনে মনে সংকল্প আঁটে এখন থেকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য নিজের পথ নিজেই তৈরি করতে হবে। পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে ঝড়ের কবলে তখনই মরে যাওয়া অনেক ভালো ছিলো। এক ঝড় থেকে বেঁচে এসে এখন আবার বাস্তবতার আরেক ঝড়ের সম্মুখীন। এসব ভাবনা যখন তার মধ্যে ঘনীভূত হয়, সিদ্ধান্ত নেয় এভাবে পথে পথে না ঘুরে মানসম্মত জীবন গড়ার জন্য এখনই স্কুলে ভর্তি হবে সে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক স্থানীয় একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী হয় সে। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয় তাকে। তবু সুমন থেমে থাকে না। মনে তার অদম্য আশা আকাঙ্ক্ষা। যে আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি বানিয়ে এগিয়ে চলছে সে। এভাবে যেতে যেতে দক্ষতার সাথে একদিন ইন্টারমেডিয়েট অতিক্রম করে। পরবর্তীতে পাবলিক ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়। কিন্তু বিধিবাম, ভার্সিটিতে আর চান্স হয়নি। পরিশেষে ডিগ্রিতে অধ্যায়ন শুরু করে। অনিবার্য কারণে ডিগ্রিতেও আর বেশিদিন টিকতে পারেনি। তাই এখানেই থেমে যায় তার পড়াশোনা। এখন তার উপার্জন প্রয়োজন। ছুটে চলে চাকরির পেছনে। বর্তমান চাকরিটা হাতের নাগালে ধরা দিলে জীবনের গতিপথে  ফিরে আসে স্বচ্ছ সফলতা। 
 
পরন্ত বিকেলের ছিমছাম আবহাওয়া। আকাশটাও বেশ পরিষ্কার। ঝলমলে সূর্যটা দিনভর আলো বিলিয়ে ক্লান্ত দেহে দিনশেষের লালিমার কোলে হেলে পড়ে। ক্লান্তির পেয়ালা চুমে শ্রান্তির পরশ খুঁজে দূর সমুদ্রের মিলন কামরায়। সুমন তার অফিসিয়াল কর্মব্যস্ততা সেরে হোটেল কক্ষের বেলকনিতে বসে আবির মাখা বিশালদেহী থালাকৃতির সূর্যের বিশাল দেহটি নীরব সৈকতের অসীমে বিলীন হয়ে যাওয়ার দৃশ্যে মগ্ন। সুমন মনে মনে বেশ উৎফুল্ল। তার জীবন ধারায় তুফানীর মাত্রা যোগে নতুন এক পৃথিবীর স্বপ্ন আঁকতে শুরু করে। তুফানীকে নিয়ে যতোই ভাবে, ততই যেনো তুফানীর সৈকতসম হৃদয় গহীনে হারিয়ে যায় সুমন। তার মনের ঝোলাতে হাজারটা প্রশ্ন এসে ভীড় করে। তুফানী কী আমার কথা ভাবে? নাকি আমি একাই ভেবে চলেছি! ভাবনার ঘোরে যখন নিমগ্ন, তখন নিকষ কালো আঁধারের ঘনঘটায় ক্রমশই দৃষ্টিরেখা নাগালের সীমানায় আঙিনা পাতে। গভীর সমুদ্রে ওঠা সারি সারি ঢেউগুলো যেনো সুরের মূর্ছনায় সুমনের হৃদয় বীণার তারে তারে ঝংকৃত হয়। সারিবদ্ধ ঢেউগুলো যখন পালাক্রমে পাড় ছুঁয়ে দেয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া ঢেওয়ের কণাগুলো তখন সমুদ্রের তীর ঘেঁষা নিয়ন বাতির আলোতে আশার স্ফুলিঙ্গ সাজায়। সুমন তাতে স্বপ্নময়ী আশায় বুক বাঁধে। যে করেই হোক তুফানীকে তার মনের কথাগুলো নিরালায় বসে খুলে বলবে।
 
চলবে...