আপডেট : ২৯ জানুয়ারী, ২০২৪ ১০:৩১
ধারাবাহিক উপন্যাস (অষ্টাদশ পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন
এদিকে তুফানী ও মাতব্বর নিরঞ্জন বাবুর মধ্যে ধস্তাধস্তির ঘটনার চরম মুহুর্তে সুমনের উপস্থিতি তুফানীর কাছে অলৌকিক বলে মনে হয়। একটি নারীর প্রধান ভুষণ হলো তার ইজ্জত। ঘটনাচক্রে সেটিই আজ লম্পট মাতব্বরের হাতে খোয়াতে বসেছিল। মুহুর্তের মধ্যে সুমন না আসলে হয়তো তার সর্বনাশ হয়েই যেতো। ভাগ্যিস সুমন এসেছিলো? কিন্তু হঠাৎ করে সুমন কোথা থেকে এলো! তুফানীর ভাবনায় মোটেও ধরা পড়ে না। বিষয়টি সত্যি সত্যি তুফানীকে সাংঘাতিকভাবে ভাবিয়ে তোলে। তুফানীর ইজ্জত রক্ষার্থে সুমনের মারমুখী ভূমিকা এবং চরম বিপদের সময় তার আচমকা উপস্থিতি,সুমনের প্রতি তুফানীর মনের আকৃষ্টতা আরো বেড়ে যায়। সারাদিন দোকানের কর্মব্যস্ততার মাঝেও একই বিষয় তুফানীর মাথায় ঘুরপাক খায়। আবার ভাবনার ফাঁকে ফাঁকে এই বলে সান্ত্বনার ঢোক গিলে, নিশ্চয়ই তাতে স্রষ্টার কোনো ইশারা রয়েছে।
তাই ভাবনার অবেলায় এসে ফুরফুরে মেজাজে দোকানের কাজ শেষ করে বাড়ির পথে পা বাড়ায় তুফানী। সে আজ মনে মনে খুবই উৎফুল্ল। হৃদয়ে তার সুখের গান। গুনগুনিয়ে ঘরে ঢুকতেই তুফানীর উৎফুল্ল ভাব,কুঁজোবুড়ির নজর কাড়ে। কুঁজোবুড়ি অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় তুফানীর মুখের দিকে। ভাবে, কী ব্যাপার! তুফানী আজ এতো খুশি ক্যান? কোনো নাগরের সন্ধান মিলছে না তো? ভাবতেই কুঁজোবুড়ির মনের ভেতরটা কিঞ্চিৎ মোচড় দিয়ে ওঠে। কারণ আগেও কুঁজোবুড়ির এমন একটা অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার আদরের নাতনি সোহাগি এভাবেই একদিন না বলে প্রেমের টানে উধাও হয়ে গেছে আজও তার খোঁজ মিলেনি। তুফানীর বেলায়ও কী একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে? চুন খেয়ে মুখ পুড়ে এখন যেনো কুঁজোবুড়ি দই দেখেও ভয়ের কারণ খুঁজে বেড়ায় সন্দেহের ছায়াতলে। সাহস করে কিছু জিজ্ঞেসও করে না তুফানীকে। যদি হিতে বিপরীত হয়?
তুফানী ঘরে ঢুকেই ফ্রেশ হয়ে সরাসরি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। সুমনের ভাবনা ছাড়া তুফানীর মাথায় এখন আর কিছুই ঢুকে না। কুঁজোবুড়ি রাতের খাবার রেডি করে তুফানীকে বারবার ডাকছে খেতে আসতে। কিন্তু তুফানীর সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। নীরবে শুয়ে শুয়ে সুমনের স্বপ্নে বিভোর। স্বপ্নের তরী যেনো আজ বেপরোয়া হয়ে ছুটছে মোহনার খোঁজে। সুখের হাওয়ায় ভাসছে তার হৃদয় পাল। সুমন কী আমার কথা মোটেও ভাবে! নাকি আমি একাই ভাসিয়েছি ভাবনার সাগরে স্বপ্নের ডিঙি? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে দেহ মনে ক্লান্তির ছায়া নামে। ক্লান্তির রেশে কখন যে হঠাৎ তার চোখ দুটি ঘুমের রাজ্যে পথ হারায় তুফানী তা জানে না।
পাশেই কুঁজোবুড়ির বিছানা। তার চোখে আজ ঘুম নেই। শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। কারণ তুফানীর চোখেমুখে উচ্ছ্বাসের যে ছবি ভেসে উঠতে দেখেছে তাতে সন্দেহের যোগবিয়োগ আর কোনো সূত্র ছাড়াই অনায়াসে মিলে যায়। তুফানী তখন বিভোর ঘুমে। ঘুমের ঘোরে থেকেই হঠাৎ তার ঠোঁট দুটিতে উচ্চারিত হয় অভিমানী সুর। বলতে থাকে- আজ সারাদিন আসেন নি কেনো? সারাটাদিন আপনাকে খুব মিস করেছি। কথাগুলো স্পষ্টভাবে কুঁজোবুড়ির কর্ণকুহরে আটকা পড়ে। কুঁজোবুড়ির মনের সন্দেহ আরো বেড়ে যায়। ভাবে, তাহলে আমার ভাবনাই সত্যি?
রাত পোহায়ে পুবের আকাশটা ক্রমশই ফর্সা হচ্ছে। ভোরের পাখিদের কলরবে চারপাশের নীরবতা ভাঙে।
মানুষের পদচারণায় পথঘাট সরব। তখনো তুফানীর ঘুম ভাঙেনি। ক’দিনের কাজের চাপে তুফানীর সাথে চামেলির দেখা নেই। তাই ঘুম থেকে ওঠেই তুফানীর সাথে দেখা করতে আসে চামেলি। এসে দেখে তুফানী এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। এই ফাঁকে কুঁজোবুড়ি চামেলিকে আড়ালে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করে-তুফানী সম্পর্কে কিছু জানে কিনা! চামেলি জানায় সে কিছুই জানে না। কুঁজোবুড়ি তখন চামেলিকে তুফানীর রাতের ঘটনাটি খুলে বলে। চামেলি তুফানীর বিছানায় গিয়ে তাকে ডেকে তোলে। তুফানী চোখ কচলাতে কচলাতে চামেলিকে একটু বিরক্তির সুরে বলে- তোর চোখে কী ঘুম নাই? এতো সকালে আসছিস ক্যান। চামেলি উত্তরে জানায়-আমার চক্ষেতো তোর লাহান রঙিলা খোয়াব নাই। তয় ঘুম আইবো কইত্থনে।- আমার চোখে রঙিলা খোয়াব তোকে বলছে। চামেলি- হ' অইছে অইছে আর কওন লাগবো না। ডুবে ডুবে পানি খাও অমাবস্যার নাম জানো না। এবার রেগেমেগে বিছানা ছেড়ে চামেলিকে বলে-তুই কী সকাল বেলা আমার সংঙ্গে ঝগড়া করার জন্য আসছিস? হ' দরকার অইলে তাই-ই করুম। নতুন নাগরের হাত ধইরা ঘুইরা বেড়াইবা আমারে কইলে কী কাইরা নিয়া যামু? তুফানী- তবে রে শয়তানী দাঁড়া, আজকে তোর একদিন কী আমার একদিন। এই বলে চামেলিকে দেয় দৌড়ানি। চামেলি দৌড় খেয়ে ক্লান্ত। আর দৌড়াইতে পারতাছি না। এহন ঘরে আইতে কইবি না? নাইলে কইলাম চইল্যা যামু। তুফানী চামেলিকে বসতে বলে তুফানী ফ্রেশ হতে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে দু'জনে বসে গল্পে মাতে আর নাস্তা সারে। এর মাঝে সবকিছু খুলে বলে। চামেলিকে বারবার বারণ করে তার ঠাম্মার কাছে বলতে। কিন্তু তার ঠাম্মা যে আগেই বুঝে গেছে তা তুফানীর অনুমানের বাইরে।