আপডেট : ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ১০:৩৬
বিয়াল্লিশ - বায়ান্ন
তাহমিনা রহমান
চোখ জ্বালা করছে নিলুর । আঁচলে ঘষাঘষি করাতে আরো বেশি লাল হয়ে ফুলে উঠেছে । সে মিছিল থেকে বের হয়ে রাস্তার একপাশে এসে দাঁড়িয়েছে । আশপাশের কিছুই দেখতে পাচ্ছে না । আনিস ছুটে এসে বললো,চলো তোমাকে মামার বাসায় রেখে আসি । নিলু মাথা নাড়ে - যাবে না । আনিস অস্থির হয়ে উঠে - আহা দেখছো না কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পুলিশ । আমাদের অনেককেই ট্টাকে তুলে নিয়ে গেছে । সমানে টিয়ার সেল ছুড়ছে । এখন তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে বলো । চারপাশে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে। নিলু তবুও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে । আনিস এবার কিছুটা কৌশল খাঁটিয়ে বলে, আচ্ছা ঠিকাছে মামার বাসাতো এখানেই এই পুরান ঢাকায় ওই যে আমার মামাতো ভাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মনিরুলদের বাসা । তুমি ওখানে গিয়ে চোখে-মুখে একটু পানি দিয়ে ঠিক হয়ে নাও । এরপর নাহয় আবার আসা যাবে । নিলু এবার আনিসের সাথে হাঁটতে শুরু করে ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় ১৪৪ ধারা জারি করা আছে । পুলিশ টহল দিচ্ছে । আনিস নিলুকে নিয়ে একটা গলির ভেতর ঢুকে পড়ে । কোনো যানবাহন বা রিকশাও পাওয়া যাচ্ছে না । এদিকে নিলু ঠিকঠাক হাঁটতে পারছে না চোখের জ্বালা বাড়ছে । কিছু দূর এগিয়ে একটা রিকশা দেখা গেলো কিন্তু সে ভাড়া যেতে সাহস পাচ্ছে না । আনিস তাকে বলে কয়ে রাজী করালো । রিকশায় উঠতে গিয়ে হাতের ব্যাথাটা প্রথম টের পেলো আনিস । কব্জিটা ফুলে উঠেছে । ব্যপারটা চেপে গেলো সে । নিশ্চয়ই পুলিশের এলোপাতাড়ি লাঠি চার্জের সময় এমনটা ঘটেছে ।
রিকশায় বসে কিছুটা স্বস্তি বোধ করছে দুজনই । এই প্রথম দুজনে এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে কিন্তু এই মুহুর্তে তাদের মাঝে উৎকণ্ঠা কাজ করছে । দুজনের মনেই দুশ্চিন্তা কী জানি হয় ।
বাসায় ঢুকেই মামার জেরার মুখে পড়ে আনিস । আনিস জানে মামা যে কোনো বিষয়েই একটু বেশি সিরিয়াস তাই নিজেই সিরিয়াস হয়ে উঠে - মামা ছাত্ররা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে শ্লোগান দিতে থাকে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।' আমরা ১৪৪ ধারা অমান্য করে সামনে এগোতে থাকি । মেডিকেল গেটের সামনে পৌঁছুতেই শুরু হয়ে গেলো পুলিশি এ্যকশন।
মামা এবার মাথা নাড়লেন - হু, তাতো দেখতেই পাচ্ছি একজনের চোখে টিয়ার গ্যাসের ঝাঁঝ আরেক জনের কব্জি ফোলা । মামার কথায় নিলু চমকে আনিসের হাতের দিকে তাকায় তাইতো এতোক্ষণ সে স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথাই ভেবেছে । আনিস ব্যপারটা উড়িয়ে দিয়ে বলে, মামা ও নিলু আমরা একই ডিপার্টমেন্টে পড়ি । মামা এবার উদার হয়ে উঠেছেন - হাই ভলিউমে মেয়েকে ডাকেন - পারভীন এদিকে আয় তো মা । ডাকার সাথে সাথে পারভীন এসে হাজির
হলো । মনে হয় খুব কাছেই কোথাও ছিলো । সে নিলুর হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়ে ওয়াসরুম দেখিয়ে দিলো । আর একটা বোলে করে পানিতে গামছা ভিজিয়ে আনিসের সামনে এনে রাখলো ।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে মামী কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তোমরা আমার মনিরুলকে কোথায় রেখে এলে বাবা ! আনিস ইতস্ততঃ করছে দেখে মামা ধমকে উঠেন - আহা অমন হুলস্থুলের সময় কেউ কারো খবর রাখতে পারে । ভেবো না চলে আসবে । আনিস মামিকে আস্বস্থ করে, চিন্তা করবেন না মামী আমি এক্ষুনি যাচ্ছি । গিয়েই মনিরুলকে পাঠিয়ে দেবো । মামির মনে উৎকণ্ঠা - তাই যাও বাবা ।
নিলু অনেকক্ষণ ধরে চোখে পানির ঝাপটা দিয়ে ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে আসে । পারভীন গামছা এগিয়ে দেয় । নিলু হাসিমুখে বলে, তোমার নাম বুঝি পারভীন । পারভীন কিছুটা দম নিয়ে বলে, হ্যাঁ তবে আনিসভাই আমাকে পারু বলে ডাকে । আপনি জানেন না বুঝি ! নিলু হেসে উঠে , মিথ্যা করে বলে, ও হ্যাঁ হ্যাঁ একদিন আনিস তোমার কথা বলেছিলো । পারভীনের চটজলদি প্রশ্ন, কী বলেছিলো ? নিলুকে এবার কিছুক্ষণ ভাবতে হয় - বলেছিলো - বলেছিলো তুমি খুব ভালো মেয়ে , লেখাপড়ায় খুব ভালো এসব আরকি । পারভীন এবার অভিমানের সুরে বলে,ভালো না ছাই । আনিসভাই বলে আমি নাকি দশবারেও ম্যাট্রিক পাশ করতে পারবো না । আচ্ছা বলুনতো নিলু আপা এটা কী ঠিক ? নিলু দ্রুত পারভীনকে আস্বস্থ করে - না না এটা ঠিক না । একদম না ।
নিলু ড্রইংরুমে আনিসকে না দেখে সেও বাইরের দিকে পা বাড়ায় কিন্তু মামা তাকে বাঁধা দেন,আরে বসো বসো গল্প করি । আমিও একসময় বিপ্লবী ছিলাম । জীবনের বেশিরভাগ সময় ওভাবেই কাটিয়েছি। নিলু কিছুটা উৎসাহ বোধ করে সে মামার সামনের চেয়ারটায় বসে ।
মামা বলেন,যদিও আমি এখন আন্দোলনে সক্রিয় নেই তবুও তরুণ প্রজন্মের উপর তীক্ষ্মভাবে নজর রাখছি। তোমরা সফল হবে কারণ এখন বাঙালির জাতীয়তাবোধ জাগ্ৰত হয়েছে । ভাষার উপর আঘাত আসাতে বাঙালি জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ ।
বিয়াল্লিশে যখন উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়েছে ' ভারত ছাড় ' অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়েছে তখনও আমরা আমাদের লক্ষ্য স্থির করতে পারিনি । বাঙালি হিন্দু মুসলিম এক হতে পারেনি । আবার মুসলিমদের মাঝেও বাঙালি অবাঙালিতে সংস্কৃতিগত পার্থক্য ছিল আকাশ পাতাল । সাতচল্লিশে আমাদের যে দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে আমরা সেদিকেই ঝুঁকেছি।
নিলু উসখুস করছে । বারবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছে । মামা বলেই চলছেন,সাতচল্লিশের ভাগাভাগিতে পূর্ব বাঙলার জনগণের মনে কোনো সন্তষ্টি ছিলো না বুঝলে । তার উপর উর্দু ভাষা যখন চাপিয়ে দেয়া হলো তখনই আন্দোলনের মওকা এসে গেলো হাতে । রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে শেখ মুজিব,শামসুল হক ,অলি আহাদসহ অনেকেই গ্ৰেফতার হলেন । হরতাল ধর্মঘট লাগাতার চলতে লাগলো । অবশেষে বায়ান্নতে এসে যা দেখছি মনে আশা জেগেছে বাঙালি তার জাতিসত্ত্বা খুঁজে পেয়েছে । এখন আর কোনো শক্তিই তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না -
এমন সময় হাতে পায়ে ব্যন্ডেজ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরে ঢুকে মনিরুল । সবাই অস্থির হয়ে উঠে। মা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেন। মনিরুল সবাইকে শান্ত হতে বলে ।
নিলু প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ,মনিরুল তাকে
থামায় । দরজার বাইরে গিয়ে একান্তে নিলুর সাথে কথা বলে মনিরুল । নিলু বারবার একই কথা বলছে, আনিস ভালো আছে তো ! মনিরুল ওর হাতে কিছু টাকা গুজে দিয়ে বলে,আনিস বারবার তোমার কথা জিজ্ঞেস করছে । ওর কাছে তোমাকে ক'দিন থাকতে হবে । ওদের বাড়িতে খবর দেবো । খালা-খালুর আসতে হয়তো দুই একদিন সময় লাগবে । সবশেষে নিলুর মুখের দিকে তাকিয়ে মনিরুল অভয়ের সুরে বলে,ওর পায়ে গুলি লেগেছিলো । গুলি বের করা হয়েছে । এখন ঘুমাচ্ছে । বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে । তাদের নাম পুরোপুরি জানতে পারিনি । আহত হয়েছে প্রায় ষাট সত্তর জন । অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক । ছাত্ররা সব হাসপাতাল ঘিরে রেখেছে ।
নিলু পুরান ঢাকার গলি ধরে দৌঁড়াতে থাকে ।