logo
আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ১১:১৩
আজকের গল্প
রমিছার মা
মুজাহীদুল ইসলাম নাজিম

রমিছার মা

মুজাহীদুল ইসলাম নাজিম

জীবনকে আরো বেশি সুন্দর করে দেখতে নিজের জন্মগ্রাম ছেড়ে আট দশ কিলোমিটার দূরে আমার গ্রামে এসে খানিক জমি কিনে একটি ঘর উঠিয়ে স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে নতুন স্বপ্নের পথে যাত্রা শুরু করলো রোমেজ উদ্দিন। এর বহু বছর আগে একই গ্রামে তার বড় ভাই সুমেজ উদ্দিনও বাড়ি করে বসবাস করে আসছেন। এমনকি বর্তমানে তার অবস্থান গ্রামের বিত্তবানদের সারিতেই। রোমেজ উদ্দিন এই গ্রামে আসার পথের সন্ধান পেয়েছিলো তারই বড় ভাই সুমেজ উদ্দিনের কাছেই। রোমেজ উদ্দিনের বাড়ি সুমেজ উদ্দিনের বাড়ি থেকে ফিতার মাপে নিকটে হলেও কিছু ঝোপঝাড় দু বাড়ির দূরত্ব অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। কাছাকাছি থাকলেও দু বাড়ির মানুষের মধ্যে তেমন সখ্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। সুমেজের স্বপ্নগুলো জমির ফসলের রঙিন ডানায় ভর করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ফোর লেন রাস্তায় পা-রাখলেও রোমেজের স্বপ্নগুলো আইসক্রিমের বক্সের ঠাসঠুস শব্দে হুঙ্কার ছেড়ে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দৌড়ঝাঁপে সামান্য নাচানাচি করে বেলা শেষে গামছার আঁচলে এক দুই কেজি চালে এসে মিলিয়ে যায়। এক মেয়ে রমিছা আর স্ত্রীসহ তিনজনের সংসারে এক দুই  কেজি চালে দিন সুন্দর পথে হাঁটতে গিয়েও পারে না তরিতরকারী কাপড়চোপড় সহ বিভিন্ন খরচের কারণে। তাছাড়া এক দুই কেজি চাল যদি প্রতিদিন আসতো তাতে খুঁড়িয়ে হলেও এগিয়ে যেতো জীবন। সেখানে বাঁধ সাধে রোমেজের অসুস্থতা। যেখানে একাধারে মাসের সবকটি দিন গতর খাটিয়েও সংসারের লাগাম ঠিকমতো ধরে রাখা যায় না সেখানে মাসে আট দশ দিন অসুস্থতার সাথে আলিঙ্গন করে ভালোভাবে মাস পার করা অসাধ্য সাধন বৈ কিছু নয়, এ অসাধ্য সাধন রোমেজের মতো রুগ্ন, হালকা গতরের মানুষের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব বলে মত দিতে অন্তত কোনো মানুষই কার্পণ্য করবে না। ফার্মেসির অল্প দামের কিছু ঔষধের সাথে রমিছার মার সেবা যত্ন যোগ হয়ে শোয়া থেকে বসার ব্যবস্থা করতেই মনের বলে দাঁড়িয়ে যায় রোমেজ। আড়ের গামছা হাতে নিয়ে এক পা এগিয়ে আইসক্রিমের বক্সের কাছে গিয়ে সযত্নে গামছায় পরিষ্কার করে বক্সের গতর। গামছা ভাঁজ করে মাথায় বসিয়ে স্ত্রীর সহযোগিতায় তার উপরে বক্স বসিয়ে পা বাড়ালো বাজারের দিকে। মহাজনকে বলে কয়ে আইসক্রিম নিয়ে গ্রামে বিক্রি করে আবার চাল নিয়ে ঘরে ফিরবে। এ না হলে যে খাবারের কষ্ট করবে স্ত্রী-মেয়ে। বক্সটি মাথায় নিতেই সারা শরীর কাঁপিয়ে দিলো দুর্বলতায়। তবু তাকে যেতেই হবে, ঘরে যে কিছু নেই। একরাশ মায়া নিয়ে রমিছার মা আজকের আইসক্রিম বিক্রির টাকায় একটি ভিটামিনের বোতল আনার অনুরোধ জানালো। 
রোগভোগের পর দুর্বল শরীরে এক গ্রাম পেরিয়ে অন্য গ্রামে যাওয়ার সাহস না পেয়ে ফিরে এলো নিজগৃহে। ভিটামিনের বোতল আগামীকাল আনবে শর্তে স্ত্রীকে খুশি করতে এ যাত্রায় সফল হলো রোমেজ। 
রাতের আঁধার নেমে আসলেই কর্মময় দিনের সকল ক্লান্তি শিথান রাখে রোমেজের প্রতিটি লোমকূপে। 
একটি ঝলমলে সকালের প্রত্যাশায় কভারবিহীন বালিশে মাথা রাখে রোমেজ। ঝলমলে সকাল চোখ ভরে দেখলেও এর থেকে কোনো প্রকার সুবিধা নিতে দিলো না পেটের পীড়া। ইদানিং রোমেজকে যেনো অসুস্থতা ছাড়তেই চাচ্ছে না। বরাবরের মতো এবারও রোমেজের স্ত্রী বাজার থেকে ঔষধ এনে খাওয়ালো এবং নিজেকে স্বামীর সেবায় ব্যস্ত রাখলো। ফলও পেলো ভালো। রোমেজ সুস্থ হয়ে উঠলো। পেটের পীড়া থেকে সুস্থ হয়ে উঠলো ঠিকই কিন্তু পুরনো শ্বাসকষ্টটা বেড়েই চলছে তার। এতো অসুস্থতার ভেতরে লুকানো সংসার আলোর মুখ দেখবে কি করে সে ভাবনায় হতাশার পরিপাটি দেহ ভিন্ন অন্যকিছু চোখে ভাসে না তাদের। এ ব্যবসাটি বেশ কষ্টের, তাই ব্যবসা পরিবর্তনে স্ত্রীর প্রস্তাবে ভিন্ন স্বপ্নে গা ভাসালো রোমেজ। দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকা আর একমাত্র মেয়ে রমিছার ভাগ্য বুননে পরিকল্পিত পরিশ্রমের বিকল্প নেই মেনেই তিন চারদিন বিছানায় থেকে নেমে পড়লো নতুন ব্যবসায়। চালানের সাথে তেজপাতার ব্যবসা ভিন্ন অন্যকিছু না মিলাতে পেরে এ ব্যবসাই শুরু করলো সে। মাথায় কিছু না থাকলেও পাড়া ঠিকই ঘুরতে হয় তাকে। এ বাড়ি সে বাড়ি, এ পাড়া সে পাড়া ঘুরে গাছ হতে পাতা ক্রয় করে স্বামী স্ত্রী দু'জন মিলে রোদে শুকানো বস্তাবন্দী পাতার খবর মহাজনকে পৌঁছালেই পকেটে কিছু টাকা উঠতে খুব বেশি সময় পোহাতে হয় না। রোমেজের স্ত্রী তার পরিশ্রমের কিছুটা ভাগ নেয়ায় অনায়াসেই কাজ করতে পারছে। যদিওবা পরিশ্রমের পরিমাণ নেহায়েত কমেনি। 
ব্যবসা করে যা আয় হয় তা থেকে রোমেজের ঔষধ কেনার পর যা থাকে তা দিয়ে তিন সদস্যের সংসার কোনোমতে খুঁড়িয়ে চলে। আয়ের টাকার সাথে যোগ হয় দুই ঈদে ফেতরা ও চামড়ার টাকা হতে সমাজপতিদের দেয়া কিছু টাকা। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না তা পরিষ্কার টের পেলো রোমেজ। সময়ের ডালে ঝুলাঝুলি করে রমিছা বড়ো হয়েছে বেশ, তা জানান দিয়ে গেলো পাশের গ্রামের ঘটক। আজকাল রোমেজ ও তার স্ত্রীর স্বপ্ন যেনো ভিন্ন খালে ঝাপ খেলায়। বলাবলি, দেখাদেখি, শুনাশুনি শেষে ঠিক হলো রমিছার বিয়ে। বয়স আঠারো না হলেও দেহগঠনে বয়স হয়নি তা বলার জো নেই। একমাত্র মেয়ে বলে কথা। ঘটা করে বিয়ে দেয়ার স্বপ্ন যেনো তাড়া করে বেড়ায় প্রতিটি মুহূর্ত। ধার করা টাকায় পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হলো বিয়ের কাজ। বিলাপ কান্নায় মেয়েকে জামাইয়ের হাতে সঁপে দিলো রমিছার মা। রোমেজের জীবনকেও ছুঁয়ে দিলো অচেনা বেদনায়। সময় তার নিজ পথেই হাঁটে। রমিছা এখন স্বামীর ঘরে। হামাগুড়িতে চলছে রোমেজের সংসার। মেয়েকে স্বামীর ঘরে পাঠিয়েও খরচ কমেনি যৎসামান্যও। রমিছার বিবাহিত জীবনে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার টাকা দিতে হয়েছে জামাইকে। জামাই বিভিন্ন অজুহাতে বেশ মোটা অংকের টাকা হাতিয়েছে শ্বশুরের কাছ থেকে। রমিছা এরই মধ্যে তিন সন্তানের জননী। মেয়ে, মেয়ের জামাইয়ের অভাব দূর করার দৌঁড়ে মোটামুটি সফল হলেও সুদের টাকার লোহার জালে জড়িয়ে পড়েছে রোমেজ। 
স্বামী-স্ত্রী মিলে যা আয় করে সুদের অতিরিক্ত টাকা পরিশোধ করতেই ফুরিয়ে যায়, যথাস্থানেই থেকে যায় মূল টাকা। দুজনের খাওয়াপড়ায় বেড়েই চলছে ঋণের পরিধি। সাথে ঔষধ কেনা তো আছেই। ঋণের চিন্তায় শারীরিক অসুস্থতার সাথে মানসিক অসুস্থতাও যোগ হয়েছে রোমেজের। প্রতিনিয়ত বাড়িতে পাওনাদারের আনাগোনা। বিভিন্ন উচ্চবাচ্যে কান ভারি হয়ে বিছানায় গন্তব্য হলো তার। তার শরীরটা ইদানিং খুব বেশি খারাপ। শ্বাসকষ্ট ঝেঁকে বসেছে রোমেজের বুকপাড়ায়। কোনো ঔষধে স্বাভাবিক হতে পারছে না। বেঁচে থাকার তীব্র আকাক্ষায় স্ত্রীকে সাথে নিয়ে পাড়ি জমালো ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাতুড়ে ডাক্তারের ঔষধ খেয়ে খেয়ে বিভিন্ন রোগ বাঁধিয়েছে দেহটায়, বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর এমনটাই জানালেন কর্তব্যরত ডাক্তার। চলছে চিকিৎসা। ধার করে আনা টাকাও শেষের দিকে। টাকা আরো আগেই শেষ হয়ে যেতো যদি না তাদের খাবারের দায়িত্বটা সৃষ্টিকর্তা আমাকে দিতেন। আমি দীর্ঘদিন ময়মনসিংহ শহরে থাকায় এই সামান্য সেবাটুকু করার সৌভাগ্য হয়েছিলো। প্রতিদিনের মতো সেদিনও বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসি। (ছোট ভাই হুমায়ুনও মাঝে মধ্যে খাবার নিয়ে হাসপাতালে আসতো) এসে একটু দূর থেকে দেখি রমিছার মা কাঁদছে। আঁচলে চোখ মুছছে। একটি হাত রোমেজের কঙ্কাল সম দেহের উপর। আমার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। ভাবলাম রোমেজ নেই। কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম 'কি হইছে?' রমিছার মা অধর কাঁপিয়ে কিছু বলার ব্যর্থ চেষ্টা করে আঁচলে মুখ ঢেকে নিলো। রমিছার বাপ অন্যদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো “বাবা, টেহা যা আনছিলাম শেষ। আমার কাছে আর কোনো টেহা নাই। দাক্তর আবার অনেক পরীক্ষা দিছে। দুই ঘণ্টা আগে সুমেজ ভাইরে ফুন কইরা কইলাম কিছু টেহা ধার দিতে, সুজা না কইরা দিলো। এহন আবার ফুন কইরা কইলাম আমার বাড়ি বেইছা হালামু, দেহতো গাহেক পাও কি না। হে আমারে কইলো তর বাড়ি আমিই নিমু, আমি টেহা নিয়া আইতাছি। অহন সুমেজ ভাই টেহা নিয়া আইতাছে, বাড়িডা বেইছা হালাইলাম। অহন কনে থাকুম আমরা?” আমার কাছে প্রশ্ন রেখেই হাউমাউ করে কেদে ফেললো দুইজন। আমি বললাম, “আপনার ভাইকে ফোন করে বলুন টাকা লাগবেনা। বলুন, আমি বাড়ি বিক্রি করবোনা।” চোখ মুছতে মুছতে আমাকে বললো, “তাইলে টেহা পামু কনে? দাক্তর যে পরীক্ষা দিছে।” আমি বললাম, “টাকার ব্যবস্থা আমি করবো।” 
সাথে সাথে বালিশের নিচ হতে ব্যাকপার্ট বিহীন একটি মোবাইল বের করে তাড়াহুড়ো করে ভাইকে জানিয়ে দিলো বাড়ি বিক্রি না করার কথা। কথা শেষে জানা গেলো তার বড় ভাই খুব বিরক্ত হয়েছেন। 
কারণ, তিনি কিছুটা পথ চলে এসেছিলেন। তারা দুজন আমার গায়ে হাত রেখে জানালো, তোমার ওসিলায় মাথাগোঁজার সম্বলটুকু হাত ছাড়া হলো না। জায়গা কিনতে টাকা হয়, দানতো দূরের কথা ধার চাইলেও টাকা হয় না, ভাইয়ের বিরুদ্ধে এমন মন্তব্য করে গেলো দ্বিধাহীন। আমি ঐসবে তাদেরকে অনুৎসাহী করে ঝাঁপ দিলাম ভাবনার সাগরে। রোমেজকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টায় আমাকে আরো সিরিয়াস হতে হবে। খাবারের মান বাড়ানোর চেষ্টায় কিছুটা হলেও সফল হলাম। নিজের পকেটে না থাকলেও সমাজের প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ বন্ধুদের সহযোগিতায় অর্থ যোগানেও ব্যর্থ হইনি। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলো রোমেজ। বাড়ি ফিরে দুই তিন মাস ব্যবসা চালিয়ে আবার পড়ে গেলো বিছানায়। হাসপাতাল, ফার্মেসি, বিছানা এসবই এখন রোমেজের ঠিকানা। আমার দ্বারা যতটা সম্ভব পাশে দাঁড়িয়েছি। সে তো শুধু ডাক্তার দেখানো আর ঔষধ কেনা। তাদের খাওয়া পড়া, সামান্য সাধ-আহ্লাদ এসবের যোগান দিতো রমিছার মা। হ্যাঁ, রমিছার মা এখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে সাহায্য তুলে। সময়ে সময়ে এ পাড়া থেকে সে পাড়াও যায়। মেয়ে-মেয়ের জামাই তাদের পাশে দাঁড়াবে তো দূরের কথা তোলা টাকা থেকে মাঝেমাঝে এসে নিয়ে যায় বিভিন্ন অজুহাতে। রোমেজ এখন কোনো কাজই করতে পারে না। মাঝেমাঝে ঘর থেকে বের হওয়াও কঠিন হয়ে যায় তার পক্ষে। অসুস্থ শরীর আর অসুস্থ মন বিভিন্ন কিছু চায় রোমেজের কাছে। অপারগতায় নিজেকে ঢেলে দেয় চাওয়ার কাছে। কিছু খেতে মন চাইলে রমিছার মা'র কাছে বলতে দেরি হয় কিন্তু আনতে দেরি হয় না। স্বামীর খাদ্যাভাব পূরণে মানুষের কাছ থেকে হাত পেতে কিছু আনতে মন বাঁধলেও লুকিয়ে থাকা এক পৃথিবী সুখ ভেসে উঠে রমিছার মা'র চোখে-মুখে।
রমিছার মা এখন রীতিমত চেয়ে খাওয়া মানুষ। তবুও চলছে দিন। সৃষ্টিকর্তা যার রিজিক যেখানে রেখেছেন সেখান থেকেই আনতে হয় এমন সান্ত্বনাই তাদের ভরসা। রোমেজ এখন একেবারেই বিছানায় পড়া। রোমেজের জন্য সময়টা খুব বৈরী। তা না হলে এসময় ছড়িয়ে পড়তো না করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। করোনাভাইরাসের জন্য এখন আর কেউ রোমেজের বাড়ির দিকে পা ফেলে না। কারণ, সে খুব বেশি শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। সেজন্য রমিছার মাও পাড়া ঘুরতে পারে না। মানুষ রমিছার মাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না, ঘরে শ্বাসকষ্টের রোগী বলে কথা। শ্বাসকষ্টের সাথে করোনার নিবিড় সম্পর্ক আছে এটা সবারই জানা। এছাড়া ভাইরাসটি খুব ছোঁয়াচে। সে জন্য রমিছার মা একটি আতঙ্কের নাম। ঐ বাড়িটিও একটি আতঙ্কের বাড়ি। এক দুই দিন রমিছার মা বাহিরে এলোনা। 
হঠাৎ বাতাসে খবর ভাসছে রোমেজতো বিছানায় পড়েই আছে এখন না কি রমিছার মাও কথা বলতে পারে না। এমনকি নাড়াচাড়াও না। দু'জনই না কি ঘরে পড়ে আছে। মানুষের বলাবলিতে স্থান পেলো-করোনা হয়নিতো! তাই যতোটা সম্ভব ঐ বাড়ি এড়িয়ে চলাই ভালো। জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো তারা। মৃত্যুর দ্বারে অবস্থান করা রোমেজ নিজের দেহটাকে ঘরের বাহিরে আনতে পারে না, কি করে সে স্ত্রীর সেবা করবে। রোমেজ ঘরের ভেতর থেকে টের পেলো কেউ একজন আঙিনা দিয়ে যাচ্ছে। 
অস্পষ্ট শব্দে তার সাহায্য চাইতেই পাশের বাড়ির বিবাহিতা মেয়ে ঘরে উঁকি দিলো। রোমেজ ভাঙা কণ্ঠে পাতিল হতে ভাত বেড়ে দিতে বলতেই মেয়েটি কথা মতই কাজ করলো। মেয়েটিরও ঘরে মন বসছে না করোনার ভয়ে। চলে গেলো মেয়েটি। রোমেজ কোনোমতে ভাতগুলো তার স্ত্রীকে নিজ হাতে খাওয়ালো। কিছুটা সময় বসে থেকে রোমেজ দুর্বলতায় অস্থির হয়ে গেলো। শুয়ে পড়লো বিছানায়। 
রমিছার মা কিছু বলতে পারে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ঘরে একটা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় রোমেজের বুঝতে বাকি রইলো না যে, রমিছার মা কাপড় নষ্ট করেছে। কি থেকে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না রোমেজ। যে মানুষটি দুদিন আগেও তার সেবা করেছে সে কি না আজ নিজের প্রয়োজন টুকুও সারতে পারছে না। বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে রোমেজ আরো অসুস্থ হয়ে পড়লো। 
তারপরও চেষ্টা করলো ঘরের বাহিরে গিয়ে কাউকে ডাক দিতে। বাহিরে গেলো ঠিকই কিন্তু দৃষ্টিসীমায় কাউকে না পেয়ে আপন ভাই এর সাহায্য পেতে তার বাড়ির দিকে যাওয়ার চেষ্টা চালালো। সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলো সৃষ্টিকর্তার ডাকে। না ভাইয়ের বাড়ি, না আপন ঘরে- কোথাও যাওয়া হলো না তার। পড়ে রইলো আপন আঙিনায়। সুমেজ উদ্দিনের নাতি গরু আনতে গিয়ে রোমেজের পড়ে থাকা দেহের খবর ছড়ায়। রোমেজের কাছে এসে সবাই বুঝতে পারলো আরো আগেই রোমেজ পাড়ি জমিয়েছে পরপাড়ে। কয়েকজন মহিলা এসে রমিছার মাকে গোসল করালো। স্বামীর লাশের পাশে আনা হলো তাকে। চোখের সামনেই দাফনের সকল কাজ সম্পন্ন হলেও শুধু চেয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো 
কাজই ছিলোনা তার। কারোর বুঝতে বাকি রইলো না যে, আরো দুদিন আগেই রমিছার মা স্ট্রোক করেছে। এরই মধ্যে স্বামী সন্তান সহ রমিছা এসে বাবার লাশ ধরে কান্নাকাটি করে দাফন শেষে মায়ের কথা না ভেবে চলেও গেলো স্বামীর ঘরে। দাফন হয়ে গেলো রোমেজের। রমিছার মার দেখভাল কে করবে তার খোঁজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সমাজপতিরা। রমিছার মার ভাই-বোনসহ আত্মীয়স্বজন কেউ রাজি না হওয়ায় কয়েকজন মিলে দিয়ে আসলো রমিছার বাড়িতে। দুদিন পর রমিছা তার স্বামীকে সাথে নিয়ে মাকে রেখে গেলো শূন্য ঘরে। মানুষের প্রশ্নের মুখে সাফ জানিয়ে দিলো এই যন্ত্রণা সে কাঁধে নিতে পারবে না। অনেকেই বলাবলি করলো রমিছাকে তার স্বামী বিবাহিত জীবনে এতো বেশি যন্ত্রণা দিয়েছে যে, তার ব্রেইন নষ্ট হয়ে গেছে। তাইতো নিজের মা আজ যন্ত্রণার নাম। দুদিন খালি ঘরে একা একাই রাত কাটালো রমিছার মা। কেউ কেউ এসে এটা সেটা খেতে দিয়ে গেলো। দুদিন পর সমাজপতিরা সিদ্ধান্ত নিলো রোমেজের বড় ভাইয়ের ছেলে শাহাদত রমিছার মার দেখভালের দায়িত্ব নিবে। বিনিময়ে সমাজবাসী শাহাদতকে লিখে দিবে রোমেজের রেখে যাওয়া ভিটেমাটি ও একটি গরু। রাজি হলো শাহাদত। রাজি হলো শাহাদতের বাড়ির অন্য সবাই। একটি হাত একটি পা নাড়াতে না পারলেও চার পাঁচ দিন পর সামান্য চেতনা ফিরলে লাঠি হাতে স্বামীর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে রমিছার মা। 
কথা বলতে না পারলেও সে এখন কাঁদতে শিখেছে। চোখের জল ভিজিয়ে দেয় রমিছার মার পরনের কাপড়। জলের সাথে ঝরে পড়ে সমাজের প্রতি নীরব অভিমান ও অভিশাপ।