logo
আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ০৬:৪৩
ধারাবাহিক উপন‍্যাস (ত্রয়োত্রিংশ পর্ব)
গহীনে নীল
বেলায়েত হোসেন

 গহীনে নীল

শ্রাবণীর মা ঘরে ঢুকে এবার মেয়ের উপর খুব চড়াও হয়। বলে, এখন বেলা কয়টা বাজে বল? এখনো বসে আছিস! ফ্রেশ হওয়ার খবর নাই,নাস্তা খাওয়ার খবর নাই! ভাব ধরে বসে আছিস। উঠবি এবার! না হয় গায়ে হাত তুলতে বাধ্য হবো! মায়ের চোখ রাঙ্গানো ভাব দেখে শ্রাবণী নাক ফুলিয়ে ফুসফাস করতে করতে ওঠে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। এই ফাঁকে শ্রাবণীর মা, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে চিঠি ও চিরকুটটি বের করে দ্রুত পড়ে আবার ওখানেই রেখে দেয় এবং বেরিয়ে গিয়ে ডাইনিং এ নাস্তা রেডি করে।
 
শ্রাবণীর মা, চিঠি ও চিরকুটের ভাষায় পরিষ্কার বুঝে নেয় এগুলো তুফানীর নামে লেখা। তাতে শ্রাবণীর মন খারাপে কী এলো গেলো! এই চিঠির সাথে শ্রাবণীর কী সম্পর্ক! রহস্যের মারপ‍্যাঁচ বুঝতে না পেরে একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায় সে। শ্রাবণীর মা ভাবতে থাকে, কে এই সুমন! তাকে কী শ্রাবণী চিনে? তার সাথে কী শ্রাবণীর কোনো স্মৃতির যোগ রয়েছে ? রহস্যের অস্তিত্ব খুঁজতে শ্রাবণীর মায়ের ভাবনার শিকড়, আস্তে আস্তে গভীরে প্রবেশ করতে শুরু করে। 
 
শ্রাবণী ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা নাস্তার টেবিলে আসে। তার বাবা তখন নাস্তা সেরে নিজ কাজে চলে যায়। এই সুযোগে শ্রাবণীর মা শ্রাবণীকে জিজ্ঞেস করে,হ্যাঁ রে শ্রাবণী! তোর কী সুমনের কথা মনে আছে? মায়ের এমন প্রশ্নে শ্রাবণী চমকে ওঠে। শ্রাবণী মনে মনে ভাবে, হঠাৎ এতোবছর পর মা আমাকে সুমনের কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? সুমনের কথা কী আজও মায়ের  মনে আছে? কই, বিগত দিনে কোনদিন তো মায়ের মুখে সুমনের কথা উচ্চারণ করতে শুনিনি? নাকি ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রাখা তুফানীকে সুমনের দেওয়া চিঠি ও চিরকুট চুপেচুপে দেখে নিয়েছে? চিঠির নীচেই তো সুমনের নাম লেখা ছিলো। সেটি দেখেই কী আমাকে জিজ্ঞেস করছে আমি সুমনকে চিনি কি না?শ্রাবণীর মনে সন্দেহ ঢুকে যায়। শ্রাবণী কিছু সময় ভেবে সুমনকে না চেনার ছল করে, মায়ের কাছে জানতে চায় কোন্ সুমন মা? শ্রাবণীর মা বলে- বা রে তুই কী একেবারেই ভুলে গেছিস? ছোটো বেলায় সুমন আর তুই একসাথে কতো খেলা করতি, মাঝেমধ্যে সারাদিনের জন্য হারিয়ে যেতি, তোদেরকে না পেয়ে খুঁজাখুঁজি করে বের করে আনতাম! তোর মনে নেই? নাহ্ মা! সুমন নামের কাউকে চিনতাম বলে আমার মনে হচ্ছে না। আর ছোট সময়ের কথা, এতো বছর পরে কী করে  মনে থাকবে মা তুমিই বলো? শ্রাবণী মাকে বলে।
 
শ্রাবণী এমন একটা ভাব করলো যেনো সুমন নামের কারোর সাথে জীবনে কোনোদিন দেখাই হয়নি, চিনবে তো দূরের কথা। চতুর শ্রাবণী তার মায়ের প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় ঘুুরিয়ে প‍্যাঁচিয়ে তার মাকেই সে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে। কেনো মা? সুমনকে চিনি কি বা না চিনি, আজকে হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছো যে? সুমন দিয়ে কী হবে মা! ছোটোবেলার সময় আর এখনকার সময় কী এক সমান? সুমন দিয়ে আমি কী করবো। সুমনকে চিনলেই কী আসে যায় আর না চিনলেই বা কী আসে যায়! 
 
শ্রাবণীর মা তার মেয়ের শেষ কথাগুলোর মাঝে একটু  রহস্যের গন্ধ খুঁজে পায়। তা ছাড়া সেদিন ভ্রমণ থেকে ফেরার সময় তুফানী হঠাৎই চুপ হয়ে যাওয়া,আজকে আবার শ্রাবণীর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে পাওয়া চিঠি ও চিরকুট সব মিলিয়ে শ্রাবণীর মা আন্দাজ করে নেয়। দু'জনের অভিমানের কারণ একটাই, সেটি হলো সুমন। কারণ শ্রাবণীর ছোটো কালের বন্ধু ছিলো সুমন। তাদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ি একই এলাকায় ছিলো। এ বিষয়ে কী কোনোভাবে তুফানী জানতে পেরে গেছে! সুমনের বাড়িও এখানেই ছিলো? নইলে দ্বীপ থেকে ফেরার পথে তুফানীর মন খারাপের কারণ আর কী হতে পারে!
 
শ্রাবণীর মা একটি বিষয় কিছুতেই মিলাতে পারছে না। সুমন এতো বছর পর কোথা থেকে এলো। এসে আবার তারই মেয়ে শ্রাবণীর বান্ধবী তুফানীর সাথে পরিচয় বা সম্পর্ক হলো কীভাবে! সুমন এতোদিন কোথায় ছিলো? স্মরণকালের সেই ঝড়ের সময় যারা দ্বীপের ঐ বিশেষ এলাকাটায় বসবাস করতো তাদের কেউই তো বেঁচে নেই। এলাকারই কোনো চিহ্ন নেই। আমরাতো ভেবেই নিয়েছি সুমন আর বেঁচে নেই।  আমরাও ঐ দ্বীপে বসবাসকারী মানুষ ছিলাম। ভাগ্যক্রমে আমরা সেদিন শহরের বাসায় ছিলাম বলে ঝড়ের তাণ্ডব থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম। 
শ্রাবণীর চিন্তা হলো ড্রয়ারে রাখা চিঠি কী মায়ের হস্তগত হয়ে গেছে? নইলে আগে পরে কোনো কথা নেই, পার্সটাও আজই পাওয়া গেলো। আবার আজই মায়ের মুখে সুমনের নাম উচ্চারণ হলো! বিষয়টি খুবই গভীর ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় শ্রাবণীর কাছে। শ্রাবণী তার মায়ের এখান থেকে দ্রুত ওঠে এসে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খোলে চেক করে। দেখতে পায়, যেখানে যেভাবে চিঠি আর পার্স রাখা ছিলো ঠিক সেভাবেই আছে।
শ্রাবণী কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না কোন্ সূত্র থেকে তার মা আজ তাকে সুমনের কথা জিজ্ঞেস করলো! ভাবনার একই ঘোরে ঘুরছে শ্রাবণী।
 
এদিকে শ্রাবণীর মা ভাবে, এই সুমন যদি তার মেয়ের  কৈশোরকালের সেই সুমন হয়ে থাকে, তাহলে তুফানী আর সুমনের সম্পর্ক সামনের দিকে আর এগোতে দেয়া যাবে না। কারণ, তুফানী ও সুমন দু'জনই দুই ধর্মের অনুসারী। সমাজ কোনোদিন এই সম্পর্ক মেনে নেবে না। কাজেই যেখানে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, আর যাই হোক অন্তত এই সম্পর্ক প্রতিহত করতেই হবে।  নইলে দুটি জীবনই ধ্বংস হয়ে যাবে। শ্রাবণীর মায়ের কাছে তুফানীও শ্রাবণীর মতো সন্তানতুল্য। কোনো সন্তান যদি কোনো ভুল পথে হাঁটে, তবে সেই পথ থেকে ফিরিয়ে আনা পিতামাতার কর্তব্য। আজ তুফানীর মা বাবা বেঁচে থাকলে যেই কাজটি করতেন! ঠিক সেই কাজটিরই পবিত্র দায়িত্ব নিতে চায় শ্রাবণীর মা।
প্রশ্ন উঠতে পারে তার মেয়ে শ্রাবণীর সাথে সুমন কেমন করে কৈশোরকাল কাটিয়েছে? তখন তো সমাজ বাঁধা দেয়নি? হ্যাঁ,প্রশ্ন উঠতেই পারে। সেটি ছিলো তাদের অবুঝকাল। তাদের মধ্যে পরিণয়,পরিণতি এসবের ভাবনা পরিপক্ব ছিলো না। তাই তাদের সম্মুখে সমাজ বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
 
চলবে...