আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ১০:১১
একালের রূপকথা
তফিল উদ্দিন মণ্ডল
রূপকথার গল্প বলা এবং শোনার রেওয়াজটা অজানা জগতে বিলীন হয়ে গেলেও নাতি নাতনিদের ধারা তো আর বন্ধ নেই। কালের পরিবর্তনের গতিধারায় তাদের মন মেজাজ বদলে গেলেও কথায় বলে, নদী মরে গেলেও তার রেখ বা চিহ্ন থাকে। নাতি নাতনিরা সারাদিন ভিডিও গেম নিয়ে থাকলেও তাদেরও রুচি পরিবর্তনের ইচ্ছে হয়। তাই ওরা নৈশকালে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, এবার গল্প শোনাও।
আমি ভাল গল্পকথক নই। গল্প বলতে আমার বড় ক্লান্তিবোধ হয়। তা ছাড়া তেমন মায়া জাগানো কল্পনাবিলাসী গল্প আমি জানিও না। তাই বলে অবোধ শিশুরা তো আর জানে না যে,পকেট গড়ের মাঠ বায়না করতে নেই।
সে রাতে গোটা পাঁচেক অলাঙ্গুল হনুমান আমাকে চেপে ধরলো । না, গল্প শোনাতেই হবে। আমি বলি যে গান শোন। গল্প বলা আমাকে দিয়ে হবে না। তো ওদের একই কথা গল্প তো বলতেই হবে। মনে মনে ফন্দি এঁটেছিলাম যদি কোনোভাবে একটা গান শোনাতে রাজি করতে পারি তাহলে আমার গানের যে গলা তাতে আমাকে নিষ্কৃতি দেয়া ছাড়া ওদের আর কোনো গতি থাকবে না। কেননা,একবার ক্লান্ত দুপুরে জাম গাছের ছায়ায় একা বসে মনের সুখে রূপবান গাইছিলাম। সেই গান শুনে বেরসিক এবং বেয়াদব পক্ষীকুল আমার মাথায় বদকাজ করে আনন্দে কিচির মিচির করতে থাকে। তাই অনন্যোপায় হয়ে গল্প বলতে রাজি হলাম।
এই গল্প যদিও শিশুকিশোরের উপযুক্ত নয় তবু একটা কিছু বলে ঘুমের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়াই মুখ্য উদ্দেশ্য।
বলতে শুরু করলাম, শোন, জীবনে বহুবিচিত্র লোকজনের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। আমি কর্মসূত্রে যেখানে ছিলাম সেখানকার সনাতনধর্মীয়দের মধ্যে শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের ভক্তকুল বেশি ছিলো । আমি সামাজিক লোক ছিলাম। শরীয়তি আলোচনা,গান বাজনা আর পূজা পার্বণেও ছিলো আমার অবাধ যাতায়াত। এলাকায় নতুন হলেও আমার এই বহুমুখী গতায়তের কারণে সমাজে আমি পরিচিত এবং খানিকটা জনপ্রিয়ও হয়ে উঠলাম।
রাতের বেলা আমি শ্রীশ্রী অনুকূল ঠাকুরের ভক্তগণের সভায় গিয়েছি। সেখানে ঠাকুরের জীবনীর উপর আলোচনা শুনছি। হঠাৎ দেখি সব মানুষ বাড়ির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আমি কিছু বুঝে উঠতে পাচ্ছিলাম না। একটু পরেই জানতে পারলাম আইনসভার সদস্য মহোদয়ের শুভাগমন ঘটেছে। মোসাহেবি প্রিয় বাঙ্গালরা তার পিছে মাছির মত ভনভন করতে লাগলো। এদিকে প্যান্ডেলও প্রায় ফর্সা হয়ে গেছে। বক্তৃতাও পানসে হয়ে উঠছে। ভিতর থেকে লোকজন কোনোভাবেই আর প্যান্ডেলমুখী হচ্ছে না।
কৌতূহল বশতঃ আমিও বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলাম। ঢুকলাম বটে তবে সামনে আর এগুতে পাচ্ছি না।
মনে মনে ভাবছি পারত্রিক মঙ্গল কামনায় যারা দল বেঁধে ঠাকুরের অমৃত বচন শুনতে এসেছেন এখন তারা পার্থিব স্বার্থ সঙ্গ কামনায় অস্থির।
তাড়াহুড়ো করে সামনে এগুনো যাবে না। তাই আমি লোকের জনতা ঠেলে পিলপিল পায়ে ধীরগতিতে চলতে লাগলাম। এ অভিনব কায়দা বেশ ফলপ্রসু হল। আমি প্রায় মাননীয়ের উপবেশন স্থলের কাছাকাছি এসে গেছি। তিনি তার সামনে রাখা স্তূপীকৃত ফলফলাদি অক্লেশে উদরে চালান করছেন। বিশেষত মাননীয়গণ প্রায়শঃই বৃহতোদর হয়ে থাকেন। যদি কেউ মাননীয় তকমা প্রাপ্তির আগে পাটখড়ির মতো থাকেন তিনিও মাননীয় হওয়ার পর শতবর্ষী কড়ই গাছের মত চওড়া হয়ে যান। যেমন তেমন এক রশিতে সহজে তার পেট বেড় আসে না।
আইন সভার মাননীয় সদস্য আমাকে দেখে ফেলেছেন।কীভাবে যে আমি তার দৃষ্টিতে পড়লাম তা ঠিক ঠাহর করতে পারি নি। তিনি মেকী ত্রস্ততায় বললেন, আরে প্রফেসর সাহেব! আপনি কখন এলেন?
আমি বিনয়ের সাথে সালাম ঠুকে বললাম, জি স্যার,অনেকক্ষণ আগে এসেছি।
মিয়া সাহেব বিলাইকে আদর করলে বাড়ির চাকর বাকর যেমন সেই বিলাইকেও সমীহ করে তেমনি মাননীয় যখন বলেছেন আপনি কখন এলেন তখন আমাকে দোহার পার্টি কুরসি ফর্সা করে দেয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠলেন।
আমি আরে করেন কি করেন কি। আপনারা বসুন বসুন বলছি। মুখে যদিও বলছি আবার খালি চেয়ারে বসার জন্য অগ্রসরও হচ্ছি।
মাননীয় বললেন,আপনাদের মত উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিরা যদি এসব অনুষ্ঠানে আসেন তাহলে অনুষ্ঠানের জৌলুসই বেড়ে যায়।
তিনি শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সম্পর্কে বয়ান শুরু করলেন। তিনি ছিলেন একজন মহান মানবতাবাদী দার্শনিক। ধর্ম, ধর্মীয় বিভাজন,জাত ফাত ধর্মাধর্ম সম্পর্কে তিনি উদার মনেভাব পোষণ করতেন। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার মহান শিক্ষাই অনুকূল ঠাকুরের বেদমন্ত্র।
শ্রীশ্রী অনুকূল ঠাকুর সম্পর্কে আমার জানার যা পরিধি তা শূন্য না হলেও যতটুকু আছে তা গণ্য করার মতো নয়।তাই মাননীয় যা বলেন ঠাকুর সম্পর্কে আমি তাতেই মাথা ঝোঁকাই।
শ্রোতা হিসেবে বরাবরই আমি সীমাহীন ধৈর্যের অধিকারী।এতক্ষণ ধৈর্য ধরে শুনে আমার ধারণা হল মাননীয় গপ্পো করতে যতো পছন্দ করেন অন্যের গপ্পো শুনতে ততই অপছন্দ করেন। শ্রোতাদের অমনোযোগিতা তিনি একেবারেই সহ্য করেন না।
আমি তখনও মাননীয়ের বিদ্যা- প্রজ্ঞার গভীরতা অতল না বচনদক্ষতা তপ্তবালিতে ফুটন্ত খই সে সম্পর্কে ধারণা করতে পারি নি। এবার তিনি অনুকূল দর্শন প্রসঙ্গে ভারতীয় দর্শনের বিষয়ে ফিলোজফিক্যাল লেকচার শুরু করলেন। সে সব লেকচারে ফিলোজফিক্যাল এবং থিয়োলজিক্যাল ভ্যালু পরস্পরের মধ্যে কখন যে ঢুকছে আর কখন যে বের হচ্ছে তা মাননীয় বক্তা না খেয়াল করলেও আমি আমার গোস্পদজলপরিমিত জ্ঞানে ভালই বুঝতেছিলাম।
প্রফেসর সাহেব, জানেন? সাংখ্য ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। ন্যায় পতঞ্জল বেদান্ত সবই জগত এবং জীবন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তবে একটা কথা কি জানেন,কেউ কারো সাথে একমত হতে পারে নি।
আমি বললাম, এসব মত পথের কচকচানির চেয়ে চার্বাকরাই ভালো ।
দেখলাম তিনি আমার আলাপের স্রোতে সংযুক্ত প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছেন। বৌদ্ধ দর্শনের কথা বলতেই তিনি খুবই উৎসাহিত বোধ করলেন। তান্ত্রিক সহজিয়া সম্পর্কে তার সহজ সমীকরণ ছিলো।
তিনি আমাকে বললেন, ভালো কথা মনে করেছেন।
এখানে এসে তিনি ষড়দর্শনের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এলেন।ধারণা করছিলাম,প্রসঙ্গটি যেদিকে যাচ্ছে তাতে দর্শনের জটিল আবর্ত থেকে বের হতে পারলে তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচেন।
মাননীয় বললেন,হ্যা, ভালো কথা মনে করেছেন। তন্ত্র সাধনার কথা বলছিলাম। একজন সাধকের যে কী কঠিন সাধনা করে আত্মমুক্তি লাভ করতে হয় তা বলে শেষ করা যায় না। আপনারা শেখ ফরিদের গল্প নিশ্চয়ই শুনেছেন।বোয়ালি কলন্দর তার হাতে একজোড়া কবুতরের বাচ্চা আর ছুরি দিয়ে বলেছিলেন,সারা জাহানের মধ্যে যেখানে আল্লাহতালার দৃষ্টি না পড়ে সেখান থেকে কবুতর জবেহ করে নিয়ে এসো। সারাদিন ঘুরেও শেখ ফরিদ তেমন জায়গা পান নি।
মাননীয় বললেন, একজন সাধক কেমন হয় আমি আমার প্রত্যক্ষজাত অভিজ্ঞতা থেকে আপনাকে বলছি। সাধনার কোন পর্যায়ে একজন সাধক দিব্যজ্ঞান লাভ করে আমার দেখা ঘটনাটি শুনলে বুঝতে পারবেন।
মাননীয়ের আলোচনা শীতের রাতে ভেজা খড়ে বসে থাকার মতো বিরক্তির উদ্রেক করছিলো। তবু মাননীয় বলে কথা। এখন গল্পের গন্ধ পেয়ে সবাই নড়েচড়ে বসলো ।
তিনি শুরু করলেন। আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর আমাকে রাষ্ট্রীয় কাজে ভারত বর্ষ সফর করতে হয়েছিলো । একবার হলো কি,আমি আমার গাইডকে বললাম, ঝাড়খণ্ডের যে অরণ্যপথে বখতিয়ার খলজি ঘোড়া হাঁকিয়ে নদীয়ায় এসে লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী দখল করেছিলেন আমি সেই ঐতিহাসিক পথটি দেখতে চাই।
বাংলায় মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে মহান অমিততেজা রণশার্দুল তার পূণ্যপদস্পর্শে ধন্য সেই বিজন অরণ্যের পথটি দেখার জন্য এক প্রত্যূষে রওনা হলাম। দুপাশে ঘনবন। সূর্যের আলোও কোন কোন জায়গাতে পড়ে নি। অনেকক্ষণ চলার পর ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে আমি নেমে পড়লাম। গাইড বললো ,স্যার জায়গাটা অতি বিজন। বাঘ ভল্লুকে পরিপূর্ণ। এখানে নামাটা বোধ হয় ঠিক হবে না।
বললাম, আমি সশস্ত্র। ভয়ের কিছু নেই। গাইডের কথার তোয়াক্কা না করে আমি বনের ভেতর দিয়ে সামান্য হেঁটে সামনে এগোচ্ছি। হঠাৎ একটা আওয়াজ ভেসে এলো কানে, তুমি নবাব বাহাদুরের ছেলে নও?
আমি ভাবলাম এটা হয়তো ভুল শুনলাম। না,আবার স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। তুমি নবাব বাহাদুরের ছেলে নও।
চারিদিকে চেয়ে দেখলাম। একেবারে জনমানবহীন। কেবল গাছে গাছে বুনো পাখিদের কিচিরমিচির আর বায়ুতাড়িত শুকনো পাতার খসখস শব্দ।
আমি দাঁড়িয়ে আছি একটি বহুপ্রাচীণ অশ্বত্থের তলে।আবছা অন্ধকার ছায়া। সবকিছু দেখা যায়। কিন্তু কে কথা বলে? কোত্থেকে বলে? আমাকে কি করে চিনে সে?
এমন সময় আওয়াজ হলো তুমি অশ্বত্থের গোঁড়ায় আসো।
আমি ভয়ে ভয়ে অশ্বত্থের গোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
শুনতে পেলাম, আমাকে দেখতে পাচ্ছো?
কম্পিত কন্ঠে বললাম, না তো।
আওয়াজ হলো,ভয় পাচ্ছো কেন বেটা!একটু উপরের দিকে তাকাও। আমি নির্দেশ মত তাকালাম।
তাকিয়ে যা দেখলাম তা বর্ণনার অতীত। অশ্বত্থগাছের কোটরের ফাঁকে একটি মুখমণ্ডল। জটাজুটধারী। দাড়ি- গোঁফে সমস্ত মুখটা ঢেকে গেছে। চোখ দুটো কেবল জ্বলজ্বল করছে।
আমাকে বললো, আমি এখানে একহাজার তিনশত বছর ধরে সাধনা করছি। এই অশ্বত্থের বয়স প্রায় পাঁচ শত বছর। দৃষ্টি আঁধার করে, নিত্য উপোস করে ব্রম্মোপসনা করতে করতে কখন যে অশ্বত্থ তরু আমার গায়ের পোশাক হয়ে গেছে আমি বুঝতেই পারি নি।
আমি বললাম, বাবা,আপনি আমাকে কি করে চিনলেন?
অশ্বত্থ বাবা বললেন, সে কী কথা রে বেটা। তোমার উর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ অমুক না?
বললাম, জি বাবা
আজ থেকে তিনশ বছর আগে আমি সাধনারত ছিলাম। অকস্মাৎ এক কিন্নরী মায়াবলে আমার সাধনা ভঙ্গ করে।আমি তাকে অভিশাপ দিয়ে মায়ামৃগ বানিয়ে রাখি। কিন্তু ধ্যানভাঙার পর আমি এত তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ি যেনো আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছিলো। আমি যখন প্রচণ্ড তেষ্টায় ছটফট করছি তখন অকস্মাৎ কেউ একজন তার ভিস্তি খুলে দিলো আমার সামনে। আমি প্রয়োজনমতো জলপান করে মহাতৃপ্তি লাভ করি। আমাকে যে মহাপুরুষ জল দিয়েছিলো সে ই হলো তোমার উর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, কী চাও বেটা। সে কিছুই চায় নি। সে শুধু বলেছিলো, বাবা, কিছুই চাই না। শুধু আশীর্বাদ করো। আমার বুনিয়াদ যেন বংশানুক্রমে রাজকীয় জীবন যাপন করে। আর ক্ষমতার অধিকারী হয়। সম্মানের সাথে বংশানুক্রমে জীবন অতিবাহিত করে।
আমি ওর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বলেছিলাম, তাই হবে বেটা। তাই হবে।
আজ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি এক সুযোগ্য রাজপুরুষ। আমার আশীর্বাদ সফল হয়েছে।
মাননীয় বললেন,তাহলে দেখেন, হাজার বছর ধরে সাধনা করতে-করতে অশ্বত্থতরু তাকে গিলে ফেলেছে তবুও তিনি সাধনার পথ ত্যাগ করেন নি। তাই বলছিলাম, সাধক হওয়া এত সহজ নয়।
আমার কটিশূলের ব্যামো ছিলো । কোমর চিনচিন করছিলো । রাতও গভীর হচ্ছিলো ।
আমি সেই সাধুবাবাকে মনে মনে প্রণাম জানিয়ে বললাম, সাধুবাবা,তোমার সাধনার কী মর্ম। সামান্য আশীর্বাদেই রাজকীয় বুনিয়াদের ধারা বয়ে দিয়েছো । আরও দীর্ঘ করলে আমরা পাব্লিক আর কোমর সোজা করে ঘরে ফিরতে পারতাম না।
যা হোক,যাদের তাড়ায় গল্প শুরু করেছিলাম তারা ঘুমের দেশে হিজরত করেছে।
আহ! কী যে শান্তি!!