শোক, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী অকুতোভয় বীর পুলিশ সদস্যগণকে স্মরণের মধ্য দিয়ে পালিত হলো পুলিশ মেমোরিয়াল ডে-২০২৪। পুলিশ মেমোরিয়াল ডে-২০২৪ উপলক্ষে বিগত ২০২৩ সালে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী ১৩৪ জন পুলিশ সদস্যের পরিবারবর্গকে স্বীকৃতি স্মারক প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশ পুলিশের সকল মেট্রোপলিটন, রেঞ্জ এবং জেলা ইউনিটেও যথাযোগ্য মর্যাদায় পুলিশ মেমোরিয়াল ডে-২০২৪ পালিত হয়েছে।
পুলিশ মেমোরিয়াল ডে-২০২৪ এর কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ শনিবার (৯ মার্চ ২০২৪) সকাল দশটায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান বিপিএএ, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, বাংলাদেশ চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বিপিএম (বার), পিপিএম এবং জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যগণের পরিবারবর্গ রাজধানীর মিরপুরে পুলিশ স্টাফ কলেজ বাংলাদেশ চত্বরে স্থাপিত পুলিশ মেমোরিয়ালে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বীর পুলিশ সদস্যদের প্রতি সম্মান জানান। এ সময় একটি সুসজ্জিত পুলিশ দল সশস্ত্র সালাম প্রদান করে। বিউগলে বেজে উঠে করুন সুর। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
পরে পুলিশ স্টাফ কলেজ (পিএসসি) কনভেনশন হলে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের পরিবারবর্গকে স্বীকৃতি স্মারক প্রদান করা হয়।
ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, বাংলাদেশ চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বিপিএম (বার), পিপিএম এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান বিপিএএ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যের পরিবারবর্গকে স্বীকৃতি স্মারক প্রদান অনুষ্ঠান উদযাপন কমিটির সভাপতি অতিরিক্ত আইজিপি (অর্থ) আবু হাসান মুহম্মদ তারিক।
অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) মোঃ কামরুল আহসান, র্যাব মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেনসহ অতিরিক্ত আইজিপিগণ, ঢাকাস্থ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধানগণ, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাগণ এবং জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যগণের পরিবারবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পুলিশ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কঠোর দায়িত্ব পালনকালে অনেক পুলিশ সদস্য প্রাণ হারান, আহত হন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাজারবাগে পুলিশ সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর আহবানে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। বাংলাদেশ পুলিশের এ অবদান জনগণ কোনদিন ভুলবে না।
তিনি বলেন, দেশ সেবার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত পুলিশ সদস্যরা জনগণের জানমাল রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট। করোনাকালে পুলিশ সদস্যরা যে চরম ধৈর্য ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন তা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা বিরোধী অশুভ শক্তি যখনই দেশের গণতন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য বিশৃঙ্খলা ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছিল তখনই পুলিশ তা রুখে দিয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারের রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। তিনি দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য পুলিশ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান।
সিনিয়র সচিব বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে পুলিশ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা প্রদান এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে অনেক পুলিশ জীবন উৎসর্গ করে থাকেন।
তিনি বলেন, দেশের ক্রান্তিকালেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিবেদিত পুলিশ সদস্যরা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে দায়িত্ব পালনে সদা তৎপর রয়েছেন।
আইজিপি বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ দেশমাতৃকার সেবায় আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছে। পুলিশ সদস্যরা দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতেও কুন্ঠাবোধ করে না। তিনি বলেন, দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালনকালে গত বছর ১৩৪ জন পুলিশ সদস্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের এ আত্মত্যাগ আমাদেরকে আগামী দিনে আরও পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালনে উজ্জীবিত করবে।
কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে আইজিপি বলেন, বাংলাদেশ পুলিশ একটি বৃহৎ পরিবার। জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের পরিবারের খোঁজ খবর রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সীমিত সাধ্যের মধ্যেও আমরা তা পালনে আপ্রাণ চেষ্টা করছি। আমরা অতীতেও আপনাদের পাশে ছিলাম, আগামীতেও থাকবো।
পুলিশ প্রধান বলেন, বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ, জঙ্গি, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বাংলাদেশ পুলিশ অঙ্গীকারাবদ্ধ। সম্প্রতি করোনা মহামারীর সময় বাংলাদেশ পুলিশ যে দৃঢ়তা, দক্ষতা ও কর্মকুশলতার পরিচয় দিয়েছে তা দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করেছে। এ গৌরবময় সফলতা জনমনে এক নিরাপত্তাবোধের সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, জনগণ বিশ্বাস করে বাংলাদেশ পুলিশ একটি নিরাপদ দেশ গঠনে বদ্ধপরিকর।
আইজিপি জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব এবং আইজিপি কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী সাত জন পুলিশ সদস্যের পরিবারবর্গের হাতে সম্মাননা স্মারক ও উপহার তুলে দেন। এসময় প্রিয়জন হারানো পরিবারের সদস্যরা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। আইজিপি ব্যক্তিগতভাবে জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের পরিবারবর্গের খোঁজখবর নেন। তিনি তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা ধৈর্য ধরে শোনেন এবং সম্ভাব্য সমাধানের আশ্বাস প্রদান করেন।
২০২৩ সালে জীবন উৎসর্গকারী বাকি সদস্যদের পরিবারবর্গকে মেট্রোপলিটন, রেঞ্জ এবং জেলায় সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়েছে।
২০২৩ সালে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী ১৩৪ জন পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ৩ জন, সহকারী পুলিশ সুপার ১ জন, পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র/সশস্ত্র) ৮ জন, সাব-ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) ১২ জন,
সাব-ইন্সপেক্টর (সশস্ত্র) ২ জন, সার্জেন্ট ১ জন, টিএসআই ১ জন, এএসআই (নিরস্ত্র/সশস্ত্র) ১৬ জন, নায়েক ৩ জন ও কনস্টবল ৮৭ জন।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সাল থেকে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের স্মরণে প্রতি বছর ১ মার্চ পুলিশ মেমোরিয়াল ডে পালিত হচ্ছে। এ বছর অনিবার্য কারণে ১ মার্চের পরিবর্তে ৯ মার্চ পুলিশ মেমোরিয়াল ডে পালিত হলো।