logo
আপডেট : ৯ মার্চ, ২০২৪ ২৩:৩২
বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালকের যৌথ বিবৃতি
নিজস্ব প্রতিবেদক

 বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালকের যৌথ বিবৃতি

যৌথ আলোচনার দলিল (Joint Record of Discussions-JRD) স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫ দিনব্যাপী (০৫-০৯ মার্চ ২০২৪) সীমান্ত সম্মেলন আজ শেষ হয়েছে। বিএসএফ মহাপরিচালক শ্রী নিতিন আগ্রাওয়াল, আইপিএস এর নেতৃত্বে ভারতের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ ০৯ সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধিদল সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। অপরদিকে, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, ওএসপি, বিএসপি, এসইউপি, এনডিসি, পিএসসি, এমফিল এর নেতৃত্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও যৌথ নদী কমিশনের প্রতিনিধিসহ ১৬ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্যে বিজিবি মহাপরিচালক ভারতীয় প্রতিনিধিদলকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও পারস্পরিক সহযোগিতায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং এই সুসম্পর্ক ও পারস্পরিক সহযোগিতা ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বিজিবি মহাপরিচালক সীমান্ত হত্যার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং এটিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিএসএফ মহাপরিচালকের প্রতি আহবান জানান। তিনি সীমান্ত হত্যার পাশাপাশি মাদকসহ বিভিন্ন ধরনের চোরাচালান, মানব পাচার, অবৈধ সীমান্ত পারাপার এবং সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে আলোকপাত করেন এবং এসব অপরাধ দমনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিএসএফের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন। বিএসএফ মহাপরিচালক তাঁকে এবং ভারতীয় প্রতিনিধিদলকে উষ্ণ অভ্যর্থনা ও আন্তরিক আতিথেয়তার জন্য বিজিবি মহাপরিচালককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। তিনি গত ২২ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে সিপাহি মোঃ রইশুদ্দিনের দুর্ভাগ্যজনক নিহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বিএসএফের পক্ষ থেকে গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন। তিনি সাম্প্রতিককালে ভারতের সিকিমে আকস্মিক বন্যায় ভেসে আসা মৃত ভারতীয় সৈনিকদের মরদেহ ফিরিয়ে দেয়া এবং সহানুভূতিশীল আন্তরিকতার জন্য বিজিবির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি সীমান্তে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বিজিবি ও বিএসএফের যৌথ প্রচেষ্টায় সন্তোষ প্রকাশ করে উভয় বাহিনী ‘সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (সিবিএমপি)’ কার্যকর বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
সম্মেলনের আলোচ্য বিষয়ের উপর ভিত্তি করে আলোচনার সারসংক্ষেপ নিম্নে প্রদত্ত হল :
ক। ২০২২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতির চেতনাকে সমুন্নত রেখে সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা/আহত/মারধরের ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে অধিক সতর্কতামূলক ও কার্যকরী উদ্যোগ হিসেবে সীমান্তে যৌথটহল পরিচালনা জোরদার করার ব্যাপারে উভয় পক্ষ সম্মত হয়। এছাড়া সীমান্তবর্তী এলাকায় উন্নয়নমূলক কর্মসূচি জোরদারকরণ এবং সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের মাঝে আন্তর্জাতিক সীমানা আইনের বিধি-বিধান সম্পর্কে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণের ব্যাপারে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে।
 
খ। সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা-সিবিএমপি (Coordinated Border Management Plan-CBMP) এর ওপর গুরুত্বারোপ করে বিভিন্ন নিষিদ্ধ পণ্যসামগ্রী চোরাচালান যেমন- মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য, আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য, জালমূদ্রা, স্বর্ণ চোরাচালানসহ বিভিন্ন ধরণের সীমান্ত অপরাধ দমনের লক্ষ্যে CBMP বাস্তবায়ন এবং উভয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী উপকৃত হবে এমন তথ্য আদান-প্রদানে দুই পক্ষ সম্মত হয়েছে। 
 
গ। আন্তর্জাতিক সীমানা লঙ্ঘন/অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, মানব পাচার, সীমান্ত পিলারের ক্ষতিসাধন/উপড়ে ফেলা ও অন্যান্য সীমান্ত অপরাধ থেকে সীমান্তবর্তী জনসাধারণকে বিরত রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হন। উভয় পক্ষ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে বলপূর্বক বাস্তুচ্যূত মায়ানমার নাগরিকদের অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে যথাযথ ও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের ব্যাপারে একমত হন। সর্বোপরি উভয় পক্ষ সীমান্তের অলঙ্ঘনীয়তা বজায় রাখার ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করেন। 
 
ঘ। সীমান্তবর্তী জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে উভয় দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে বন্ধ থাকা উন্নয়নমূলক কাজসমূহ উভয় দেশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সম্পৃক্ত করে দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে পারস্পরিক সম্মতি জ্ঞাপন করেন। এছাড়াও সীমান্তের অনুমোদিত স্থানে ১৫০ গজের মধ্যে একসারি বিশিষ্ট (অনুমোদিত ডিজাইনের) কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্নের উদ্যোগ গ্রহণ করার বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছেন।
 
ঙ। পারস্পরিক ঐক্যমতের ভিত্তিতে যৌথ নদী কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত সীমান্তের অভিন্ন নদী সমূহের বন্ধ থাকা তীর সংরক্ষণ কাজ পুনরায় শুরু করার জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে। 
 
চ। উভয় দেশের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য আইসিপি, এলসিপি, এলসিএস সমূহের দ্রুত নির্মাণ কাজে সহায়তা করতে এবং বর্ডার হাটের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে। 
 
ছ। বিজিবি মহাপরিচালক ‘কানেক্টেড বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় তিন বিঘা করিডোর হয়ে দহগ্রামে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য ভারতের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করতে বিএসএফ মহাপরিচালককে অনুরোধ জানান। বিএসএফ মহাপরিচালক এ ব্যাপারে সহায়তা প্রদানের আশ্বাস প্রদান করেন। 
 
জ। সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদী  গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে  নিজ নিজ সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির বিষয়টি তুলে ধরে উভয় পক্ষই এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ, সুনির্দিষ্ট তথ্য আদান-প্রদান ও নিজ নিজ সীমান্তে প্রয়োজনীয় আভিযানিক তৎপরতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছান।  
 
ঝ। সীমান্তবর্তী খাল হয়ে ভারতের আগরতলা থেকে বাংলাদেশের আখাউড়ায় ভেসে আসা শিল্পবর্জ্য মিশ্রিত পানির ক্ষতিকর প্রভাবের কথা উল্লেখ করে বিজিবি মহাপরিচালক যৌথ নদী কমিশনের কারিগরি কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক বর্জ্য শোধনাগার (Effluent Treatment Plant-ETP) স্থাপনের ওপর জোর দেন। উভয় পক্ষ যৌথ জরিপ পরিচালনা এবং সীমান্তবর্তী পরিবেশ সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছে।
 
ঞ। বিজিবি মহাপরিচালক জকিগঞ্জের কুশিয়ারা নদী তীরবর্তী ৫,০০০ হেক্টর চাষযোগ্য ফসলী জমির সেচ সুবিধা ও সীমান্তবর্তী জনগণের দুর্ভোগের কথা উল্লেখ করে মানবিক দিক বিবেচনায় অবিলম্বে কুশিয়ারা নদীর সাথে বন্ধ থাকা রহিমপুর খালের মুখ পুনরায় খুলে দেওয়ার জন্য বিএসএফ মহাপরিচালকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বিএসএফ মহাপরিচালক উভয় পক্ষের স্বার্থ বিবেচনায় দ্রুত রহিমপুর খালের মুখ পুনরায় উন্মুক্তকরণের আশ্বাস দেন। 
 
উভয় পক্ষ বিদ্যমান পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট রাখা ও পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধির জন্য ‘সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (Coordinated Border Management Plan-CBMP)’ এর আওতায় নোডাল অফিসার পর্যায়ে ত্রৈমাসিক বৈঠক, সমন্বিত টহল, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, জয়েন্ট রিট্রিট সিরিমনি, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বিনিময়, স্কুলগামী শিশু এবং উভয় দেশের সাংবাদিকদের পারস্পরিক শুভেচ্ছা সফর ইত্যাদি দ্বিপাক্ষিক কার্যক্রম বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণে সম্মত হয়েছেন।
 
উভয় মহাপরিচালক সম্মেলনের ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা উভয়েই সীমান্তে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য যৌথভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।