পূবে সূর্য উঠলেও বরাবরের মতো দেখা যায়নি আজও। আশপাশের বিল্ডিংয়ের ফাঁকগলে নাহিদ আহমেদের বাসার বেলকিন ছুঁতে পারে না রোদ। অথচ এই রোদটা খুব প্রিয় নাহিদ আহমেদের। দো'তলা বাড়িটা যখন তিনি বানিয়েছিলেন তখন চারপাশ বলতে গেলে খালিই ছিল। সে সময় শুধু বেলকনিতে নয়, ঘরের ভেতর পর্যন্ত রোদ খেলা করতো। গত ১০ বছরে তার বাড়ির চারিদেক ছ'তলা ১০ তলা ভবন উঠেছে। এরপর থেকেই তার বাড়ির বেলকনি থেকে রোদ পালিয়েছে। এ নিয়ে প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন মানিয়ে গেছে নাহিদ আহমেদের।
আজ সকাল থেকেই চিরচেনা বাড়িটা তার কাছে অচেনা লাগছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। সকাল ছাড়িয়ে দুপুরের দিকে যাচ্ছে সময়। সূর্য বািড়েয়েছে তার প্রখরতা।
কিন্তু নাহিদ আহমেদের কাছে যেন সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে অথবা পূর্ণগ্রাস হচ্ছে। এমনতো তার কোনদিন হয় না। বিষয়টি ভাবতে গিয়ে হোঁচট খান তিনি। আবারও খবরের কাগজটা হাতে নেন। তিন নম্বর পাতায় চোখ বুলান। নিচের দিকেই একটি বক্স আইটেমের মধ্যে তার মেয়ে নিশির ছবি। ছবির ঠিক নিচে লেখা -একে ধরিয়ে দিন।
প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি নাহিদ আহমেদ। কম করে হলেও ১০ মিনিটের মতো তিনি তাকিয়ে ছিলেন ছবিটির দিকে। ৫০ বারের বেশি পড়েছেন নিচের লেখাটি। এরপরও বিশ্বাস হয় না তার। তার মেয়ের ছবি পত্রিকায় থাকবে কেন? কেনইবা ধরিয়ে দেয়ার বিজ্ঞাপন থাকবে? তা হলে কি তার মেয়ে ক্রাইমের সঙ্গে জড়িয়েছে? তার মেয়ে ক্রাইমের সঙ্গে জড়াতে পারে এটাও কি তাকে বিশ্বাস করতে হবে?
অবশেষে শান্তি খুঁজে পান নাহিদ আহমেদ। ভালো করে চোখ বুলিয়ে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, এ ছবিটি তার মেয়ের নয়। হয়তো দেখতে একই রকম হওয়ায় ছবিটি তার মেয়ের মনে হচ্ছে। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পর থেকেইতো নিশি বাড়িতে। তার সামনেই ঘোরাফেরা করেছে। রাতে দু'জনে বেলকনিতে বসে চা খেয়েছে। নাহিদ আহমেদকে একটা গানও শুনিয়েছে। গান বলতে বাথরুম সিঙ্গার যাকে বলে। কিন্তু এই গলাই নাহিদ আহমেদের ভাল লাগে। মেয়েও তার আবদার রক্ষা করে। গান শেষে রাত ১২ টার দিকে মা-মেয়ে ঘুমাতে গিয়েছে। সকালে উঠেই পত্রিকায় কেন দেখা যাবে একে ধরিয়ে দিন বিজ্ঞাপন। তার বন্ধমূল ধারণা, ছবির মেয়েটা দেখতে অনেকটা নিশির মতো। কিন্তু নিশি নয়।
এরই মধ্যে দু'বার নিশির ঘরে ঊঁকি দিয়ে এসেছেন নাহিদ আহমেদ। দেখেছেন কোলবালিশ জড়িয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে নিশি। শান্তির ঘুম। এমন ঘুম নাহিদ আহমেদ অনেকদিন ঘুমাননি। যে কারণে মেয়েকে ডাকতে গিয়েও ডাকেননি। এ ছাড়া ঘুম থেকে ডেকে তুললে নিশির মেজাজ খারাপ হয় সে বিষয়টাও মনে পড়ে তার।
পরেরবার নাহিদ আহমেদ পত্রিকার পাতাটা নিয়েই নিশির ঘরে গিয়েছিলেন। পত্রিকার ছবি ও মেয়ের মুখের দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন। কখনো মনে হচ্ছিল এটা নিশির ছবিই। আবার মনে হচ্ছিল, না। জানালায় পর্দা থাকায় আলোহীন ঘরে মেয়ের মুখটা পুরোপুরি দেখতে পেলেন না। নাহিদ আহমেদ বাতি জ্বালানোর সাহস করলেন না। তিনি জানেন বাতি জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গেই তার মেয়ে জেগে উঠবে। আর সারাটাদিন চিৎকার চেঁচামেচি করবে। সংসারের অশান্তি চান না তিনি। এর আগে একবার মেয়েকে ডেকে তুলে এই বিপত্তিতে পরেছিলেন।
বেলকনির চেয়ারটাকেও আজ নাহিদ আহমেদের অচেনা মনে হচ্ছে। চেয়ারটাও যেন তাকে দেখে উপহাস করছে। দেখেই সরে যেতে চাইছে। কিন্তু যখন মনে মনে স্থির করলেন, ছবিটা তার মেয়ের নয় নিশ্চিত অন্য কারো। তখন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকলো।
নাহিদ আহমেদ চেয়ারে বসে পত্রিকার অন্য পাতাগুলোতে চোখ বুলাতে লাগলেন। খেলার পাতায় বাংলাদেেশর মাশরাফি ও আশরাফুলের আইপিএলে যোগ দেয়া ও কত ডলারে বিক্রি হলো সে বিষয়টি দেখছিলেন। কিন্তু আবারো তার সেই তিন নম্বর পাতায় যেতে ইচ্ছে করে। অন্য সংবাদ তার মনকে টানতে পারছে না। সত্যিইকি মেয়েটার ছবি নিশির কি- না আরও একবার নিশ্চিত হতে চান। পরক্ষণই সিদ্ধান্ত নেন তিন নম্বর পাতা আর খুলবেনই না।
মিনিট দশেক পর তার মোবাইল ফােন বেজে ওঠে। মনিটরে ভাসে বন্ধু তারিকের নাম। খুশি হন নাহিদ আহমেদ। তারিক অনেকদিন পর ফোন করেছে। কত বছর এক সঙ্গে তারা পড়াশোনা করেছে। চাকরিও করেছে এক সঙ্গেই। আবসরে যাওয়াও এক সঙ্গে। তাদের দু'জনের পরিবারেই মাত্র একটি করে সন্তান। দু'জনের স্ত্রীই ব্যাংকে চাকরি করেন। দু'জনই চায়ের চেয় কফি খেতে বেশি পছন্দ করেন। দু'জনের বাড়িও দোতলা। একই নামের পত্রিকা পড়েন দু'জনই। পত্রিকা বদল করলে এক সঙ্গে বদলান। দু'জনের অদ্ভুত মিল। শুধু একটা অমিল আছে। এর একটা নাহিদের মেয়ে আর তারিকের ছেলে।
তারিকের কণ্ঠে করুণার সুর, দোস্ত ঠিক আছিস তুই? প্রশ্ন শােনে আৎকে ওঠেন নাহিদ আহমেদ।
চলবে............