আপডেট : ৫ এপ্রিল, ২০২৪ ২০:১২
উদ্ধার করলাে র্যাব
বান্দরবানের রুমা থেকে অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজারের সঙ্গে যা করলো সন্ত্রাসীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক
র্যাবের মধ্যস্থতায় সোনালী ব্যাংকের বান্দরবানের রুমা শাখার ম্যানেজার নেজাম উদ্দীন’কে বান্দরবানের রুমা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। পরে নেজাম উদ্দীন তাকে অপহরণ ও পরে সন্ত্রাসীরা তার সঙ্গে কি আচরণ করেছে বিস্তারিত জানিয়েছেন র্যাবকে।
র্যাব জানায়, গত ২ এপ্রিল রাত সোয়া ৮ টার দিকে বান্দরবান পার্বত্য জেলার রুমা থানাধানী রুমা বাজারের সোনালী ব্যাংকে শতাধিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত কুকি-চীন সদস্যদের অনেকেই তাদের পোশাক পরিহিত অবস্থায় সোনালী ব্যাংকের উত্তর দিক (বেথেল পাড়া) হতে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎ না থাকার সুযোগ নিয়ে অতর্কিত হামলা করে মারধর করতঃ অস্ত্রের মুখে পুলিশ, আনসার ও অন্যান্য লোকজনদেরকে জিম্মি করে ফেলে। আক্রমণকালে সোনালী ব্যাংকের ডিউটিরত গার্ড কনস্টেবলসহ সর্বমোট ১০ জনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ২টি এসএমজি ও ৬০ রাউন্ড গুলি, ৮টি চায়না রাইফেল ও ৩২০ রাউন্ড গুলি, আনসার সদস্যদের ৪টি শর্টগান ও ৩৫ রাউন্ড কার্তুজ ও সোনালী ব্যাংকের ভল্ট ভেঙ্গে টাকা লুটের চেষ্টা এবং সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার মোঃ নেজাম উদ্দীন’কে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
টনাটি জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার/প্রকাশ হলে দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি ও জনমনে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠে। ঘটনাটি জানার সাথে সাথে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে র্যাবের একাধিক আভিযানিক দল অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজার ও অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারের লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি ও তথ্য সংগ্রহসহ র্যাবের আভিযানিক কার্যক্রম শুরু করে।
এরই ধারাবাহিকতায়, র্যাবের আভিযানিক দল একপর্যায়ে অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজারের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় তার অবস্থান সনাক্ত করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে সন্ত্রাসীদের সাথে কৌশলে বিভিন্ন চাপ প্রয়োগের ফলে সন্ত্রাসীরা একপর্যায়ে ম্যানেজারকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে সম্মত হয়। ব্যাংক ম্যানেজারকে পরিবারের কাছে হস্তান্তরকালীন যাতে পরিবারের অন্য সদস্যরা অপহরণের শিকার না হয় সে লক্ষ্যে র্যাব সু-কৌশলে হস্তান্তর কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে র্যাবের একদল চৌকস সাদা পোষাকধারী সদস্য রুমা থানাধীন বেথেল পাড়া এবং বড়ুয়া পাড়ার আশেপাশে অবস্থান নেয়। অতঃপর গত ৪ এপ্রিল সন্ধ্যা আনুমানিক ১৯.২৫ ঘটিকায় সন্ত্রাসীরা ম্যানেজার’কে পরিবারে কাছে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দেয় এবং এরপর র্যাব সদস্যরা ম্যানেজার মোঃ নেজাম উদ্দিন এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরসহ নিরাপত্তা সহকারে র্যাব-১৫, বান্দরবান ক্যাম্পে নিয়ে আসে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে উদ্ধারকৃত ব্যাংক ম্যানেজার মোঃ নেজাম উদ্দিন র্যাবের নিকট সন্ত্রাসীদের অর্তকিত হামলা এবং হামলার পরবর্তী সময়ে তার সাথে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে।
গত ২ এপ্রিল রাতে রুমা বাজারস্থ সোনালী ব্যাংকে অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত শতাধিক সশস্ত্র কুকি-চীন সদস্যদের প্রত্যেকেই সোনালী ব্যাংক ডাকাতির উদ্দেশ্যে পূর্বপরিকল্পিত ভাবে সোনালী ব্যাংক এবং আশপাশ এলাকায় ভীতি সঞ্চার করে রুমা থানাধীন সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজারকে খুঁজতে থাকে। জনৈক লোকের মাধ্যমে জানতে পারে, সোনালী ব্যাংক ম্যানেজার মোঃ নেজাম উদ্দিন পার্শ্ববর্তী মসজিদে এশার নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে অবস্থান করছেন। পরবর্তীতে আনুমানিক ০৮.১৫ ঘটিকার সময় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা মসজিদে প্রবেশ করে নামাজরত প্রত্যেক মুসল্লিকে জিম্মি করে প্রত্যেকের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন তাদের আয়ত্তে নিয়ে নেয়। অতঃপর তারা সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজারকে সনাক্ত করতে না পেরে মসজিদ থেকে তিন জনকে বের করে আনে এবং ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সে সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার কিনা? ম্যানেজার ব্যাপারটি অপ্রীতিকর মনে করে নিজেকে রক্ষা করার জন্য কৃষি অফিসার হিসাবে পরিচয় দেয়। কিন্তু সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সন্দেহ হলে তারা ম্যানেজারসহ তিনজনকে ব্যাংকে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত প্রহরীদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে ব্যাংক ম্যানেজারকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়।
সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মধ্যে একটি দল ব্যাংক নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের অস্ত্র ও গুলি নিয়ে তাদেরকে একটি রুমের মধ্যে আটকিয়ে রাখে। এ সময় সন্ত্রাসীদের সবাই এক ধরণের সামরিক পোষাক পরিহিত ছিল এবং প্রত্যেকের মুখমন্ডল কালো কাপড় দ্বারা ঢাকা ছিল। একই সাথে বর্ণিত সময় ব্যাংকের চারপাশে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ঘিরে রাখে।
অতঃপর ম্যানেজারের কাছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা জানতে চায়, আজকে অর্থ্যাৎ ঘটনার দিন ব্যাংকে কত টাকা নিয়ে আসা হয়েছে এবং ব্যাংকের ভল্টে মোট কত টাকা রক্ষিত আছে। সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে ম্যানেজারের নিকট ব্যাংকের ভল্টের চাবি চাইলে তখন ম্যানেজার তাদেরকে কৌশলে ভল্টের চাবি দিতে অস্বীকৃতি জানালে সন্ত্রাসীরা ভল্ট ভাঙ্গতে চেষ্টা করে এবং পরে ম্যানেজারের কাছ থেকে আরো জানতে পারে যে, ভল্টে আঘাত করলে সেন্সরের মাধ্যমে তাৎক্ষনিক ব্যাপারটি সোনালী ব্যাংকের হেড অফিস জেনে যাবে। তখন তারা ব্যাংকে ম্যানেজারকে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং পাহাড়ী এলাকায় পৌঁছানো মাত্রই তার চোখ বেঁধে ফেলে।
ব্যাংক থেকে ম্যানেজারকে বের করে টানা দুই থেকে আড়াই ঘন্টা কোন পাহাড়ের ঝিরি পথে হাটিয়ে নিয়ে যায়। এই সময় তার সাথে ১০/১২ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী ছিল। পথিমধ্যে তারা ম্যানেজারের চোখ বাধা খুলে দেয় এবং অন্ধকারে চলার সুবিধার্থে ম্যানেজারের হাতে একটি বাটন ফোন ধরিয়ে দেয়। পথে তারা কিছু সময়ের জন্য বিশ্রামের সুযোগ দেয়। এরপর আবার হাঁটায় একপর্যায়ে রাত আনুমানিক ০২.৩০ ঘটিকার সময় নীরব অজ্ঞাত এক স্থানে তাকে নিয়ে গিয়ে ঘুমানোর সুযোগ দেয় এবং ম্যানেজার যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য তারা পাহারা দেয়।
ঘটনার পরদিন অর্থ্যাৎ গত ০৩ এপ্রিল সকাল আনুমানিক ০৭.৩০ ঘটিকার সময় ব্যাংক ম্যানেজারকে সামান্য নাস্তা দিয়ে আবারও হাঁটিয়ে পাহাড়ী ঝিরি পথ দিয়ে অন্য একটি পাহাড়ের ঝিরিতে নিয়ে যায়। সেখানে প্রায় ৩০/৩৫ জনের মত সশস্ত্র সন্ত্রাসী অবস্থান করছিল। এ সময় তারা কলার পাতায় করে ম্যানেজারকে গরম ভাত, ডাল ও ডিম ভাজি খেতে দেয় এবং সেখান থেকে হাঁটিয়ে অন্য জায়গায় পুনরায় নিয়ে যায়। সেখানে ম্যানেজারকে ১৫/২০ মিনিটের মত বিশ্রামের সুযোগ দেয়। সন্ধ্যা আনুমানিক ১৯.০০ ঘটিকা পর্যন্ত তারা ধাপে ধাপে বিশ্রাম এবং হাঁটার পর ভিন্ন একটি জায়গায় গিয়ে পৌছালে এ সমময় তারা ম্যানেজারকে গরম ভাত, ডাল ও ডিম খেতে দেয়। উল্লেখ্য, সন্ত্রাসীরা সবসময় নিজেদের মধ্যে বম ভাষায় কথা বললেও ম্যানেজারের সাথে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলতো। সবসময় তাকে ২/৩ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী ঘিরে রাখত এবং ১২/১৩ জন তার আশে পাশে অবস্থান করতো। অতঃপর রাত আনুমানিক ২০.০০ ঘটিকার দিকে সন্ত্রাসীরা ম্যানেজারকে একটি টং ঘরে নিয়ে যায় এবং সেখানে তাকে নুডলস খেতে দিলেও ম্যানেজার খায়নি। ঐ রাতে উক্ত টং ঘরে ম্যানেজারের সাথে পাহারারত ৫ জন সন্ত্রাসী ঘুমায়।
এখানে উল্লেখ্য যে, ৩ এপ্রিল রাত আনুমানিক ০৮.০০ ঘটিকা থেকে পরের দিন বিকাল প্রায় ০৩.০০ ঘটিকা পর্যন্ত তারা প্রায় একই জায়গায় ছিল। অতঃপর বিকাল আনুমানিক ১৫.০০ ঘটিকার পর প্রায় এক ঘন্টা হেঁটে তাকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ঘন্টা খানেক বিশ্রাম নিয়ে ব্যাংক ম্যানেজারকে মোটর সাইকেল যোগে নতুন একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়।
অপহরণের পর সন্ত্রাসীরা ম্যানেজারকে তার পরিবারের সাথে যোগাযোগের সুযোগ দেয় এবং কোন প্রশাসনিক বা আইনি সহায়তা যাতে না নেয় তার পরিবারকে সেজন্য সর্তক করে। পরিবারের সাথে যোগাযোগ হওয়ায় ঐ সূত্র ধরে র্যাব তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় তার অবস্থান সনাক্ত করে এবং র্যাবের মধ্যস্থতায় সোনালী ব্যাংকের বান্দরবানের রুমা শাখার ম্যানেজার নেজাম উদ্দীন’কে বান্দরবানের রুমা বাজার ও বেথেল পাড়া মধ্যবর্তী কোন এক স্থান থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
এ ব্যাপারে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্তৃক পুলিশ ও আনসার সদস্যদের নিয়ে যাওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারের লক্ষ্যে র্যাবের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।