এডলফ হিটলারকে আমরা সবাই জানি একজন নিষ্ঠুর মানুষ হিসেবে। হাজার হাজার মানুষ হত্যায় একটুও হৃদয় কাপতো না তার। সেই হিটলারও ছিলেন প্রেমিক। ইভা ব্রাউনের সঙ্গে তার ছিল দীর্ঘ প্রেম। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল আত্মহত্যার আগের দিন বিয়ে করেছিলেন ইভা ব্রাউনকে। তারা স্বামী স্ত্রী ছিলেন মাত্র ৩৬ ঘণ্টা। এর পর দু'জনই আত্মহত্যা করেন। শুধু তাই নয় হিটলারের প্রিয় কুকুরকেও দুনিয়াতে রেখে যাননি। তাকেও আত্মহত্যার আগে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে গিয়ে আত্মহত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন হিটলার। সেটা বাস্তবায়ন করেন ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল দুপুরের দিকে। বাংকারে নিজের কপালের ডান পাশে গুলি করেন তিনি। সঙ্গী হন স্ত্রী ইভা ব্রাউন। তিনি বিষ পান করে মৃত্যুকে বেছে নেন। তার আগে হিটলার–ইভা তাঁদের প্রিয় কুকুরকেও বিষ খাইয়ে হত্যা করেন। হিটলারের মৃত্যুর দিনটি ছিল আজকের দিন অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল।
অ্যাডলফ হিটলার গত শতকে বিশ্বরাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত–সমালোচিত নেতাদের একজন। তাঁর জাত্যাভিমান ছিল প্রবল। জার্মানদের ‘আর্য জাতি’ মনে করতেন তিনি। অর্থাৎ তাঁর মতে, সব জাতির সেরা জার্মানরা। ইহুদিবিদ্বেষ হিটলারের চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য।
হিটলারের জন্মও এপ্রিলে। ১৮৮৯ সালে, অস্ট্রিয়ায়। জার্মানির রাজনীতিতে নাৎসি নেতা হিটলারের উত্থান বেশ নাটকীয়। ইতিহাসবিদেরা বলেন, হিটলার সুবক্তা ছিলেন। দেখতে ছোটখাটো হলেও বিশেষ এ গুণ রাজনীতিতে তাঁকে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিল। হিটলার ১৯৩৩ সালে জার্মানির চ্যান্সেলর হন। পরের বছর নিজেকে ‘ফুয়েরার’ বা সর্বোচ্চ নেতা ঘোষণা করেন তিনি।
১৯৩৯ সালে হিটলারের হাত ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়ায় জার্মানি। সঙ্গে ছিল মিত্র ইতালি ও জাপান। তাদের অক্ষশক্তি বলা হতো। প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নের জোট মিত্রপক্ষ নামে পরিচিত। এই বিশ্বযুদ্ধে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা দেখে বিশ্ববাসী। ইহুদি নিধনে হিটলারের নৃশংসতা এখনো ভয় জাগায়।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিটলার বা মুসোলিনি—কারও পরিণতি সুখকর হয়নি। ১৯৪৪ সালের শেষের দিকে ও ১৯৪৫ সালের শুরুর দিকে যুদ্ধে চরম কোণঠাসা হয়ে পড়ে অক্ষশক্তি। মিত্রবাহিনীর সেনারা জার্মানিতে ঢুকে পড়েন। বিশেষত ১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে সোভিয়েত সেনাবাহিনী জার্মানির রাজধানী বার্লিন অবরোধ করে ফেলেন।
হিটলার ও মুসোলিনি বুঝতে পারেন পরাজয় অনিবার্য। পরিস্থিতিও দ্রুত বদলে যেতে থাকে। একের পর এক ফ্রন্ট থেকে শুধু পরাজয়ের খবর আসতে থাকে। ইতালির পতন হলে পালানোর চেষ্টা করেন ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনি। তাঁকে আটক করে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। দিনটি ছিল ১৯৪৫ সালের ২৮ এপ্রিল।
ইভা ব্রাউন ছিলেন হিটলারের দীর্ঘদিনের প্রেমিকা। ইতিহাসবিদেরা বলেন, আত্মহত্যার এক দিন আগে ২৯ এপ্রিল ওই বাংকারেই ইভাকে বিয়ে করেন হিটলার। ছোট্ট সেই আয়োজনে শুধু ঘনিষ্ঠজনেরা উপস্থিত ছিলেন। হিটলার আর ইভার বিবাহিত জীবন ছিল মাত্র ৩৬ ঘণ্টার।
মিত্র মুসোলিনির করুণ পরিণতি হিটলারকে ভাবিয়ে তোলে। একসময়ের পরাক্রমশালী হিটলার তখন বার্লিনে নিজের সদর দপ্তরের ২৫ ফুট নিচে বাংকারে জীবন কাটাচ্ছেন। ওই বাংকারে ১৮টি কক্ষ ছিল। পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহে নিজস্ব ব্যবস্থাও ছিল সেখানে।
বাংকারে হিটলারের সঙ্গী ছিলেন কয়েকজন ঘনিষ্ঠ মিত্র, মন্ত্রী ও রক্ষী। যেকোনো সময় সোভিয়েত সেনারা তাঁকেও আটক করবে, এ ভয় তখন হিটলারকে তাড়িয়ে ফিরছে। কিন্তু মুসোলিনির মতো দুর্ভাগ্য বরণ করতে চাননি তিনি।
শেষরক্ষা হচ্ছে না বুঝতে পেরে আত্মহত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন হিটলার। সেটা বাস্তবায়ন করেন ৩০ এপ্রিল দুপুরের দিকে। বাংকারে নিজের কপালের ডান পাশে গুলি করেন তিনি। কেউ কেউ বলেন নিজেকে গুলি করার আগে বিষ পান করেছিলেন হিটলার। মৃত্যুর পথে সঙ্গী হন স্ত্রী ইভা ব্রাউন। তিনি বিষ পান করে মৃত্যুকে বেছে নেন। তার আগে হিটলার আর ইভা তাঁদের প্রিয় কুকুরকেও বিষ খাইয়ে হত্যা করেন।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনের তথ্য, ওই দিন নাৎসি ইউনিফর্মের জ্যাকেট আর কালো ট্রাউজার পরেছিলেন হিটলার। ইভার পরনে ছিল নীল–সাদা পোশাক। নিজেদের বাংকারে প্রবেশ করার পর দরজা আটকে দেন দুজনে। এরপর হাতে হাত রেখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেন। তখন হিটলারের বয়স ৫৬ বছর। ইভার ৩৩।
এ ঘটনা নিয়ে পরে লিখেছিলেন, হিটলারের ব্যক্তিগত সহকারী হেইনজ লিঞ্জ। হিটলার–ইভা যখন আত্মহত্যা করেন, তখন বাইরে অপেক্ষা করছিলেন হেইনজ। সঙ্গে ছিলেন হিটলারের ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত মিত্র জোসেফ গোয়েবলস ও মার্টিন বোরম্যান। তাঁদের ওপর দুজনের মরদেহ পুড়িয়ে ফেলার দায়িত্ব দেওয়া ছিল।
এরপর হিটলার ও ইভার মরদেহ বাংকার থেকে বাইরে বাগানে আনা হয়। সন্ধ্যায় অত্যন্ত গোপনে পেট্রল (অনেকে বলেন গ্যাসোলিন) ঢেলে মরদেহ দুটি পুড়িয়ে ফেলা হয়। সরিয়ে ফেলা হয় হাড়গোড়।
কিন্তু দুজন রক্ষী এ ঘটনা দেখে ফেলেছিলেন। তাঁরা জেনে যান, হিটলার আর বেঁচে নেই। জানার পর বাংকারের রক্ষীরা পালিয়ে যান। হেইনজ এরপর বাংকারে ফিরে গোপনীয় নথিপত্র, রক্তাক্ত কার্পেট, হিটলারের ইউনিফর্ম আর ওষুধ পুড়িয়ে ফেলেন।
সোভিয়েত সেনারা যখন বার্লিন দখল করে হিটলারের বাংকারের সন্ধান পান, তখন হিটলার ও তাঁর সঙ্গী–সাথিদের কাউকেই পাননি। বাগানে তাঁরা ছাইয়ের মধ্যে মানুষের নিচের চোয়ালের হাড় ও দাঁতের পাটির অংশবিশেষ খুঁজে পান। সেসব ছোট একটি বাক্সে ভরে একজন দন্তচিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়।
ওই ব্যক্তি হিটলার ও ইভার দাঁতের চিকিৎসা করেছিলেন। নথিপত্র ঘেঁটে ও পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর তিনি জানান, দাঁতের পাটির একটি ও চোয়ালের হাড় হিটলারের। আর অন্য দাঁতের পাটি ইভা ব্রাউনের। এভাবেই সোভিয়েতরা নিশ্চিত হয়, হিটলার সস্ত্রীক মারা গেছেন।
ইতিহাসবিদেরা বলেন, মৃত্যুকে বেছে নেওয়ার আগে হিটলার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করেছিলেন। একটি, নিজের উইল তৈরি করা। দ্বিতীয়টি, বিয়ে করা।
হিটলার নিজের উত্তরসূরির নাম উইলে লিখে যান। নাৎসি জার্মানির রাষ্ট্রপ্রধান পদে নিয়োগ দেন অ্যাডমিরাল কার্ল দোনিত্জকে। আর গোয়েবলসকে দেশের চ্যান্সেলর করেন।
ইভা ব্রাউন ছিলেন হিটলারের দীর্ঘদিনের প্রেমিকা। ইতিহাসবিদেরা বলেন, আত্মহত্যার এক দিন আগে ২৯ এপ্রিল ওই বাংকারেই ইভাকে বিয়ে করেন হিটলার। ছোট্ট সেই আয়োজনে শুধু বাংকারে থাকা ঘনিষ্ঠজনেরা উপস্থিত ছিলেন। হিটলার আর ইভার বিবাহিত জীবন ছিল মাত্র ৩৬ ঘণ্টার।