জবা আহমেদ যখন বাসায় ফিরলেন ঘড়িতে ঠিক তখন দুপুর একটা। চাকরি জীবনে আজই প্রথম একটার সময় বাসায় এসেছেন তিনি। যা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারেননি নাহিদ আহমেদ। একবার নিশি প্রচণ্ড অসুস্থ ছিল। তাও তিনি অফিসের কাজ ফেলে আসেননি। আর সেই মানুষ যদি একটার সময় বাড়ি ফেরে তা হলে কে না চমকে উঠবে।
জবার চোখে যেন বিদ্যুত চমকাচ্ছিল। প্রথমে দেখে ভয় পেয়ে যান নাহিদ আহমেদ। দীর্ঘ সময়ের দাম্পত্য জীবনে তাকে কোনদিন এমন রূপে দেখেননি। কখনো রাগ করলে নাহিদ আহমেদ হাসতেন শুধু। কিছুক্ষণ গুমরো মুখে থাকার পর জবাও হেসে ফেলতেন। বলতেন- ধুর, তোমার সঙ্গে রাগও করা যায় না। আজ তার চােখ দেখেই নাহিদ আহমেদ বুঝতে পারছেন কতটা রেগে আছেন জবা। রাগ হবেই বা না কেন। তার মেয়ের যেভাবে ছবি ছাপা হয়েছে তাতে তো রাগ হওয়ারই কথা। বরং নাহিদ আহমেদ নিজেই ভাবছেন তিনি তিনি কেন এমন রাগ করলেন না/। পত্রিকার ছবি দেখার পরই তার এমন রাগ হওয়া উচিত ছিল। তা হলে কি তিনি আজ পর্যন্ত রাগ জিনিসটা রপ্ত করতে পারেননি। তার মেয়েওতো তার মতো হয়েছে।
জবা কলিং বেল চাপলে নিশি দরজা খুলে দেয়। নিশিকে সামনে পেয়েও কিছুই বলেননি জবা আহমেদ। নিশি জানতে চেয়েছিলো-
আম্মু এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে, শরীর খারাপ লাগছে?
মেয়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে জবা সোজা নাহিদ আহমেদের ঘরে চলে যান।
জবার ব্যবহারে একটুও কষ্ট পায় না নিশি। পত্রিকার ছবি দেখার পর সে যে কষ্ট পেয়েছে , এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে। তার মা-ও ছবি দেখেই তার দিকে এমন রাগ কেরেছে. তার তার বুঝতে বাকি রইলো না। তা না হলে অন্যদিনের মতো একগাল হেসে মেয়েকে জিজ্ঞেস করতেন, কিরে কি খবর? ইউনিভার্সিট গিয়েছিলি? মনটা ভাল তোর--ইত্যাদি।
রাগ দুঃখ সইতে না পেরেই হয়েতা তিনি বাসায় ফিরে এসেছেন। নিশি তর সামনে গিয়ে কিভাবে দাঁড়াবে তাই খুঁজছিল। এক সময় তার মনে হলো আমিতো কোনো দোষ করিনি তা হলে দাঁড়াতে পারবো না কেন? নিশি সাহস করে মায়ের সামনে যাওয়ার জন্য নাহিদ আহমেদের রুমের দিকে যায়। কিন্তু দরজায় ফেলা পর্দা সরানোর আগেই জবা আহমেদের চিৎকার শুনে সে থমকে যায়। আর না এগিয়ে মা কি বলছে শোনার চেষ্টা করে।
জবা আহমেদ যখন ঢুকলেন তখন নাহিদ আহমেদ শুয়ে ছিলেন। মেয়েকে নিয়েই ভাবছিলেন। শুধু কি সমাজের চোখে তারা মান হারিয়েছেন? বিয়ে দিতে গেলেওেতা কত ধরনের প্রশ্ন উঠবে। পাশের বাড়ির রহিম সাহেবের পরিবারতো তাদের বিরুদ্ধে লেগেই আছে অনেক আগে থেকে। এমন কি নিশি পড়াশোনায় ভালো এ বিষয়টিও তাদের অপছন্দ। দুই বাড়ির পাশের এক হাত জমিই এই বিরোধের সৃষ্টি করেছে। বাড়ি করার সময় রহিম সাহেব নাহিদ আহমেদকে এক হাত ছেড়ে বাড়ি করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু নাহিদ আহমেদ তা করেননি। এরপর থেকেই তাদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। এমনকি পাশাপাশি বাড়ি হলেও দুই পরিবারের কোন যোগাযোগ নেই। দুটি বাড়ির বেলকনি লাগোয়া। এরপরও কথা হয় না দুই পরিবারের মানুষদের মধ্যে।
জবা ঢুকেই চিৎকার শুরু করেন। নাহিদ আহমেদ তাকে বারণ করেছিলেন। কিন্তু নাহিদ আহমেদের কোনো কথাই আজ শুনতে চাচ্ছেন না জবা আহমেদ। এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছেন। নাহিদ আহমেদ কোনো কথারই জবাব দেয়ার চেষ্টা করছেন না। দু'একটি কথার উত্তর দিতে চাইলে জবা বাধা দিয়েছেন। নিশি তার বাবার অসহায়ত্ব দেখে কষ্ট পায়। এক পর্যায়ে জবা আহমেদ বলতে শুরু করেন-
তোমার আদর পেয়েই মেয়েটার আজ এই অবস্থা। রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা মেয়ে আর কি ভালো হতে পারে? আমি তোমাকে বলেছিলাম, কোন ভদ্র ঘরের মেয়েকে পালিত কন্যা হিসেবে আনার জন্য। আর আনলে কি না রাস্তা থেকে একটাকে। আজ দেখো, রাস্তার মেয়ের কাণ্ড দেখো। তোমার মান ইজ্জত কিভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।
নাহিদ আহমেদ কি বলে স্ত্রীকে শান্ত করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। তিনি শুধু চাপাস্বরে বললেন- চুপ করো। মেয়েটা শুনবে।
শুনুক। ওর জন্ম পরিচয় জানা উচিত। সে যে আমাদের মেয়ে না এ বিষয়টা তাকে আগেই বলা দরকার ছিল। তাহলে হয়তো সে এত বেপরোয়াভাবে চলতে পারতো না। আজ তার ছবিও ছাপা হতো না পত্রিকায়।
এবার ধমকে ওঠেন নাহিদ আহমেদ-
বলছি, চুপ করো।
কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না নিশির কাছে। কিন্তু বাবা তো প্রতিবাদ করলেন না। তার মানেতো এই যে, সে তাদের সন্তান নয়। রাস্তায় পড়েছিল সে। যা প্রা/য়ই পত্রিকার পাতায় দেখা যায়।
তার চোখ বেয়ে পানি ঝরতে থাকে। সে কি করবে, তার কি করা উচিত, কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। চোখের সামনে ভাসে পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন। একটি মেয়ে বড় হয়ে যখন জানতে পারে সে একজন পালিত কন্যা, তখনই সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। নিশির সামনেও আজ এই কাজটি সহজ সমাধানের পথ খোলা। সে কি তাহলে আত্মহত্যা করবে? কিছু সময়ের জন্য সে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
অনেক ভেবে সে সিদ্ধান্ত নেয় চুপ থাকবে। কিছুই শোনেনি সে। তার মা যা বলেছে রাগ করে বলেছে। সেও হয়তো মায়ের জায়গায় থাকলে এমনটিই করতো।
এমনিতে খবুই ঠান্ডা মেজাজের মেয়ে নিশি। খুব সহজে তার মাথা গরম হয় না। বিনা দোষে অন্য কোনো মেয়ের ছবি এভাবে পত্রিকায় ছাপা হলে সে মেয়ে হয়তো এতক্ষণে পত্রিকা অফিস গরম করে ফেলতো। কিন্তু নিশি চুপচাপ। একবারে চুপচাপ। সে বোঝার চেষ্টা করছে কেন তার সাথেই এমনটি হলো।
নিজের সাথে নিজেই বোঝাপাড়া করে সে। কিছুটা সময় একান্তে নিজেকে পেতে চায় নিশি। সোজা চলে যায় বাথরুমে। চোখ ধুয়ে নিজের কান্না মুছে ফেলার চেষ্টা করে। দু'বার আয়নার সামনে দাড়ায়। কাঁদলে তাকে কেমন দেখায় তা পরীক্ষা করে দেখে। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। এমন লাল চোখ দখলে বাবা ধরে ফেলতে পারেন। তাই নিশি যতটা পারে চোখে পানি দিয়ে লাল ভাবটা কাটানাের চেষ্টা করে। চােখের কান্না মুছলেও ভেতরের কান্না মুছতে পারে না সে। বারবার মনকে বোঝানোর চেষ্টা করে, সে যা শুনেছে তা একেবারেই মিথ্যা। এমনটি হতেই পারে না। যদি তাই হতো, তা হলে তার মা তাকে এতো আদর করতো না। কখনো না কখনো সে বুঝতেই পারতো। শুধু কি জন্ম দিলেই মা হওয়া যায়? হয়তো জন্ম দেয়া নারী তাকে এত আদর স্নেহ করতো না, যতটুকো জবা আহমেদের কাছ থেকে পেয়েছে। তা হলে কেন সে তার মা হবে না? নিজে নিজেই যুক্ত পাল্টা যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছে নিশি।
বাবার ডাক বাথরুম থেকে শুনতে পায় সে। ততক্ষণে জবা আহমেদ তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেছে। নিশি বাবার সামনে গিয়ে কি করবে কাঁদবে নাকি স্বাভাবিক থাকবে সে প্লান করে।