logo
আপডেট : ৪ মে, ২০২৪ ১০:৩৬
ধারাবাহিক উপন্যাস- পর্ব- ১৮
নিশিকথা
ওমর ফারুক

নিশিকথা

নিশি কবে একদিন পত্রিকায় পড়েছিল, এক নবজাতককে কে বা কারা রাজধানীর একটি জায়গায় ডাস্টবিনের ভেতর ফেলে যায়। শিশুটি পলিথিনের প্যাকেটে এমনভাবে মোড়ানো ছিল যেন এটি কোন বস্তু। কি করার ছিল সেই শিশুর? নিশ্চয়ই পলিথিনে মোড়ানোর সময় শিশুটি কান্না করছিল। পাষণ্ড মা কিংবা বাবার দিকে তাকিয়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কারোরই মন গলেনি। তাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে জঞ্জাল দূরের মতো একটা ব্যবস্থা করেছে তারা।

পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী খুব ভোরেই তাকে ডাস্টবিনে ফেলে যাওয়া হয়। ভােরে কাকের দল খাবারের খোঁজে বেরিয়ে ডাস্টবিনের মধ্যে নরম দেহের এই শিশুকে পেয়ে উল্লাস করছিল। নিষ্পাপ এই মানুষটির প্রতি কাকও দয়া দেখায়নি। বরং উৎকৃষ্ট খাবার মনে করে তারা শিশুর নাকে মুখে ঠোকর বসাচ্ছিল। অসহায় এই শিশু গগনবিদারী চিৎকার করতে থাকে। এই টুকু শিশুর কান্না ছাড়া কি-ই বা করার ছিল।
সেই কান্নার শব্দ পাষণ্ড মা-বাবার কানে না পৌঁছালেও  পৌঁছেছিল এক হৃদয়বানর রিক্সাচালকের কানে। ওই সময় রিক্সাচালক যাত্রীর আশায় রাজধানীর বুক জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। ডাস্টবিনের কাছ দিয়ে যওয়ার সময়ই তিনি কান্নার আওয়াজ পান। কান্না শুনেই তিনি থামিয়ে দেন তার রিক্সার গতি। দেখলেন ডাস্টবিনের ভেতরে কাকের দল কি একটা নিয়ে টানাটানি করছে। আর সেখান থেকেই ভেসে আসছে শিশুর কান্না। তখন হাহাকার করে ওঠে রিক্সাচালকের মন। তিনি দৌড়ে যান ডাস্টবিনের কাছে। দেখতে পান কাকের দল তার নাক কান ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে। ক্ষত স্থান থেকে রক্ত ঝরছে। চোখ থেকে ঝরছে পানি। 
খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অনেক মানুষ ছুটে যান সেখানে। শিশুটিকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। সেখান থেকে পিতৃস্নেহে বড় করার জন্য তাকে নিয়ে যান এক মহান ব্যক্তি। 
নিশির মনে আছে ওই সংবাদটি পড়ে তার চোখের জলে পত্রিকার পাতা ভিজে গিয়েছিল। যে তাকে জন্ম দিয়েছে তাকে হত্যা করতে ইচ্ছে করছিল তার। শিশুর কি অপরাধ ছিল? এই পাপ কি সমাজকে একটুও তারিত করবে না?
শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া সেই মহান ব্যক্তির পা ছুঁয়ে সালাম করতে ইচ্ছা করছিল নিশির। তার বড় জানতে ইচ্ছে করছিল শিশুটি এখন  কেমন আছে। সে যখন বড় হবে তখন তা জেনে তার কেমন লাগবে। কাক ঠােকরানোর সেই দৃশ্যটি চোখের সামনে দেখতে পায় নিশি।
কিন্তু কে জানতো সে নিজেও তেমনি একজন শিশু। যাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে বড় করেছ মহান নাহিদ আহমেদ। নিজের অজান্তেই চোখ ভেজে যায় নিশির। আজ ইচ্ছে করে ওই মহান ব্যক্তি নয়, নাহিদ আহমেদকে তার সালাম করা উচিত। জবা আহমেদের কথা যদি ঠিক হয় তা হলে নাহিদ আহমেদ ওই মহান ব্যক্তির চেয়ে কোনো অংশেই কম নন। মনে মনে ভাবে এখন কি বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। সালাম করার জন্য দুটো পা এগিয়ে দিতে বলবে। 
কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না নিশি। তার মনে অনেক ধরেনর কথা খেলা করে যাচ্ছে। ভাবছে তা হলে সে কোনো রাস্তার পাশে পড়েছিল? তার গায়ে কি কোনা কাপড় ছিল? নাকি পাষন্ড মা খালি গায়েই ফেলে দিয়েছিল রাস্তার পাশে বা ডাস্টবিনে। তার দেহেও কি কাক ঠোকর খাচ্ছিল? তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে তার বাবা-মা আসলে কে?
নিশির ঘরে থাকা নাহিদ ও জবা আহমেদ দম্পতির একটি ছবি নিয়ে বাথরুমে যায় সে। ছবির সঙ্গে তার মুখের মিল খোঁজার চেষ্টা করে। না, একদমই মিলছে না। অন্যর সন্তান কেন তাদের সঙ্গে মিলবে। তবে সে এত সুন্দরী হলো কি করে? তা হলে নিশ্চয়ই তার প্রকৃত বাবা -মা বেশ সুন্দর ছিলেন। তা হলে তারা তাকে রাস্তায় ফেলে গেলো কেন? নািক মায়ের বিয়েই হয়নি। সে অবৈধ সন্তান। যে কারণেই তাকে তার মা রাস্তায় ফেলা ছাড়া বিকল্প পায়নি। সে কোথায় জন্মেছে, কোন নার্সিং হোমে, নাকি কোন বাসায়। জন্মানোর পরপরই কি তাকে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। মায়র স্তন পান কি সে করতে পারেনি। রাস্তা থেকে নাহিদ আহমেদ তাকে কিভাবে নিয়ে এলো- এমন হাজােরা প্রশ্ন এসে হাজির হয় নিশির সামনে। 
কষ্টের মধ্যোও হাসতে ইচ্ছে করলো নিশির্ কি আশ্চর্য তার জন্ম। হয়তো কোন বস্তির মেয়ের ঘরে সে জন্মেছে। কিন্তু বড় হয়েছে একজন উচ্চ পদের সরকারি কর্মকর্তার বাসায়। যান সুনাম, প্রতিপত্তি রয়েছে। যদি সে তার প্রকৃত মায়ের কাছে থাকতো তা হলে কি সে বস্তিতে বড় হতো? মানুষের বাসা/য় ঝি-এর কাজ করতো? গৃহকত্রীর কাজ পছন্দ না হলে তার গায়ে খুন্তির ছ্যাঁকা দিতো? নাকি সুন্দরী হওয়ার কারনে সাহেবদের লালসার শিকার হতো সে। যা একদম অপছন্দ তার। প্রায় দিনইতো এমন খবর পত্রিকার পাতায় পড়ছে নিশি। এ কারণেই কি তার নাম নিশি অর্থাৎ রাত রাখা হয়েছে। আসলেইতো তার জীবনটা রাতের মতো অন্ধকারই। 
সেদিন রাতে নিশি আর তার ঘর থেকে বের হয়নি। তবে সে দরজা আটকায়নি। তার বাবা-মাও তার তেমন খোঁজ নেয়নি। সন্ধ্যার দিকে দু'বার নাহিদ আহমেদ পর্দা সরিয়ে ঘরে চোখ ফলেছে, যা চোখ এড়ায়নি নিশির। মধ্যরাত পর্যন্ত তার ঘুম হয়নি। নানা চিন্তা তাকে ঘুমুতে দেয়নি। 
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পায় তার গায়ে কাঁথা জড়ানো। বুঝতে পারে বাবা-মা দু'জনের কেউ তাকে নজরে রেখেছে। রাতের কোনো এক সময় যখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে তখন তাদের একজন তার গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিয়েছে। যাতে শীতে সে কষ্ট না পায়। রাস্তা থেকে কুঁড়িয়ে পাওয়া একটি মেয়েকে কেন এত আদর করতে হবে, সেটাও মেলাতে পারে না নিশি।

চলবে..