‘বাঁশফুল’, নামটি অনেকে শুনলেও দেখেছেন হয়তো খুব কম মানুষ। কারণ বাঁশফুল সাধারণত কয়েক যুগ পর ফুটে থাকে।
বাঁশগাছ যখন তার উৎপাদন সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তখন একবারের জন্য ফুল দিয়ে থাকে।
এই বাঁশফুল সম্বন্ধে সমাজে কিছু কথা প্রচলিত আছে। বলা হয়, যদি কোনও বাঁশঝাড়ে ফুল ফোটে, তবে তা ঐ এলাকায় ‘ইঁদুর বন্যা’ ঘটায়। অর্থাৎ, সেখানে ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে যায়।
অনেকে আবার এও বলেন, যেখানে বাঁশফুল হয়, সেখানে অতিশীঘ্রই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই কথাগুলো কি কেবলই কিছু ‘প্রচলিত ধারণা’? নাকি এর মাঝে কোনও সত্যতা আছে?
হঠাৎ বাঁশফুল কেন আলোচনায়?
সম্প্রতি ধানের জন্য বিখ্যাত দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার এলুয়াড়ী ইউনিয়নের পাকাপান গ্রামের একটি বাঁশ ঝাড়ে ফুল ফুটেছে। ফুল ঝরে পড়ার পর সেই বাঁশ গাছে বীজ হয়েছে এবং ওই বাঁশঝাড়ের বীজ সংগ্রহ করে তা থেকে চাল উৎপাদন করেছে ঐ গ্রামের সাঞ্জু রায় নামক এক দিনমজুর।
আজ থেকে এক দশক আগে তিনি তার দাদুর মুখে শুনেছিলেন, সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে তারা বাঁশ গাছের বীজ থেকে চাল তৈরি করেছিলেন।
“যুদ্ধের পর অনেক দুর্যোগ গেছিলো। তখন অভাব অনটন ছিল। তাই আমার দাদুরা বাঁশফুল চাল খেয়ে জীবন-যাপন করছিলো আর কি। আমার দাদু নাই এখন। ১০-১২ বছর আগে উনি আমায় বলছিলো এটা। এই কথাটা আমার মনে আছিলো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. সাঞ্জু।
সাঞ্জু রায় গ্রামের এক বিত্তবান মানুষের বাড়িতে কাজ করেন। প্রায় দুই বিঘা জমি জুড়ে পড়ে থাকা যে বাঁশঝাড় থেকে তিনি বীজ সংগ্রহ করেছে, তা সেই বাড়ির মালিকেরই। তার ভাষ্যে, “ওনারা বড়লোক মানুষ। বীজ নিলে তারা কিছু বলে না। এইসবের দিকে গুরুত্ব কম তাদের।”
বাঁশঝাড়ের পাশেই এক খণ্ড জমি আছে সাঞ্জুর। “এ বছর আমি দেখলাম যে বাঁশঝাড়ে ফুল আইছে। তারপর আমি হাতে নিয়ে পরীক্ষা নিয়ে দেখলাম যে আসলেই চাল, আঠা আঠা ভাব লাগছে। একটা ঘ্রাণ লাগছে। এরপর থেকে আমি জমিতে কাজ করতাম আর অপেক্ষা করতাম যে কবে বীজ আসে।”
ওই বাঁশঝাড় থেকে ১০ মণ বীজ সংগ্রহ করেছেন তিনি। বাঁশের বীজ থেকে কতটুকু চাল পাওয়া যায়, সেটা বোঝাতে মি. সাঞ্জু জানান—চার মণ বীজ থেকে দুই মণ পরিমাণ চাল পেয়েছেন তিনি।
বীজ ভাঙ্গিয়ে চাল তৈরি করে তা তিনি নিজের জন্য রেখেছেন। প্রতিবেশীদের কাছে বিক্রি করেছেন। এমনকি, কিছু চাল তিনি বাঁশঝাড়ের মালিককে উপহার দেওয়ার পাশাপাশি গবেষণার জন্যও দিয়েছেন।
হঠাৎ বাঁশের বীজ সংগ্রহ করার নেপথ্যের কারণও বর্ণনা করেন তিনি।
“এখন আমার কাম-কাজ নাই, অভাবের টাইম। ফুল আসার তিন চার মাস পর যখন বীজ আসলো, তখন আমি ভাবলাম যে যদি এইখান থেকে চাল উৎপাদন করতে পারি, আমার উপকার হয়।”
বাঁশ গাছে কতদিন পরে ফুল ফোটে?
কথিত আছে, একটি বাঁশে নাকি প্রতি ৫০ বছর পর পর ফুল ফোটে। কিন্তু বিষয়টি তেমন নয় আসলে। বাঁশফুল এরকম নিয়ম মেনে একটি নির্ধারিত সময় পর পর ফোটে না।
নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলায় অবস্থিত আঞ্চলিক বাঁশ গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (আরবিআরটিসি) রিসার্চ অফিসার মো. আসাদুজ্জামান সরকার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বাঁশের জীবনকাল নির্ভর করছে তার প্রজাতির ওপর। একটি বাঁশ গাছে অন্তত ৪০ বছর থেকে শুরু করে ১২০ বছর বয়সেও ফুল ফুটতে পারে। প্রজাতিভেদে এটা ভিন্ন হয়।”
তিনি জানান, একটি বাঁশ গাছ তখনই ফুল দেয়, যখন সেই গাছের উৎপাদন সক্ষমতা শেষ হয়ে যায়।
তবে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সটিউটের চট্টগ্রামের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. মো. মাহবুবুর রহমান যদিও বলেন, “আমরা গবেষণায় দেখেছি, কোনও কোনও বাঁশ গাছে ২৫ বছর পরও ফুল ফোটে। তারপর সে মারা যায়। এটি আসলে প্রজাতিভেদে নির্ভর করে। কিন্তু অন্তত ২০-২৫ বছর সময় নেয়ই।”
পাকাপান গ্রামের বাঁশঝাড়ও কি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে?
মো. মাহবুবুর রহমান বলছেন, “বাঁশফুল আসা মানে ঐ বাঁশের জীবনচক্র শেষ, সেটা মারা যাবেই”।
দিনাজপুরে বাঁশফুল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ওই ঝাড়ের যেগুলোয় এ বছর ফুল আসছে, সেগুলো এবছরই শুকিয়ে মারা যাবে। যেগুলোয় আসে নাই, সেগুলোয় পরের দুই তিন বছর আসবে। এভাবে একটা সময় সব বাঁশ শুকিয়ে মারা যাবে।”
অর্থাৎ, “কয়েকবছর পর ওই বাঁশঝাড় সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।”
সেক্ষেত্রে নিশ্চিহ্ন যাতে না হয়, তার জন্য সব বীজ চালে রূপান্তরিত না করে বরং সেগুলো সংগ্রহ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই বন কর্মকর্তা।
তিনি এও বলেন যে আগামী দুই তিন বছর ওখানে প্রচুর বীজ উৎপাদন হবে।
“তাই, বীজ সংগ্রহ করে ওখানে নতুন করে চারা রোপণ করা প্রয়োজন। চারা রোপন করলে পাঁচ থেকে ছয় বছরের মাঝে আবার বাঁশঝাড় হয়ে যাবে।”
বাঁশ গাছের মৃত্যুর ‘অদ্ভুত নিয়ম’
বন কর্মকর্তারা শুরুতেই বলেছেন যে দিনাজপুরের ওই বাঁশঝাড় আগামী দুই থেকে তিন বছরের মাঝে মারা যাবে, যদি না সেখানে বীজ রোপন করা হয়।
এখন যদি কেউ এই বাঁশঝাড় থেকে চারা নিয়ে অন্য কোথাও যদি কেউ রোপন করে এবং সেই চারা কয়েক বছর পর বড় গাছে পরিণত হলেও, যখন মূল বাঁশঝাড় মারা যাবে, তখন অন্য জায়গায় লাগানো বাঁশ গাছেরও মৃ্ত্যু হবে।
এ প্রসঙ্গে মি. রহমান আরও বলেন, “বাঁশে ফুল এলে তার ফিজিওলজিক্যাল এক্টিভিটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন আর সে খাবার তৈরি করতে পারে না। যদি খাবারই তৈরি করতে না পারে, তার অস্তিত্ব টিকে থাকে না।”
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৭ প্রজাতির বাঁশ আছে এবং সারাবিশ্বে এই সংখ্যা ১৫ শ’রও বেশি। এর মাঝে শুধুমাত্র চীনেই আছে প্রায় ৯০০ প্রজাতি।
বাংলাদেশে যে সব প্রজাতির বাঁশ আছে, সেগুলোর ২৫-২৬টি প্রজাতিই হল গ্রামীণ বাঁশ। বাকিগুলো বুনো প্রজাতির। কিন্তু পৃথিবীর সকল বাঁশই জীবনচক্রের একটি পর্যায়ে গিয়ে এভাবে ফুল ফুটে মারা যায় না বলে জানান মি. রহমান।,
“কোনও কোনও বাঁশ আছে, যাতে কখনওই ফুল আসে না। সেগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় মারা যাবে।”
বাঁশ গাছের বীজ থেকে চাল কীভাবে?
এক্ষেত্রে প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন যে বাঁশ কোনও গাছই নয়। এটি মূলত এক ধরনের ঘাস এবং চির সবুজ বহু বর্ষজীবী উদ্ভিদ, যা নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে জন্মায়। বন কর্মকর্তারা জানান, ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও বাঁশ টিকে থাকে।
এদিকে, ধান কিংবা গমও কিন্তু ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। পার্থক্য হলো, বাঁশের আয়ুষ্কাল অনেক। আর, গম ও ধানের আয়ু কয়েক মাসের। এদের আরেকটা পার্থক্য, আকার।
বাঁশ বড় হতে হতে একসময় এত বিশাল হয় যে তার গাছের আকার ধারণ করে। কিন্তু ধান ও গম জাতীয় উদ্ভিদ আকারে কখনওই এত বড় হয় না।
এখন যেহেতু এগুলোর সব-ই একই গোত্রের, তাই এদের বীজেও সাদৃশ্য থাকা স্বাভাবিক।
দিনাজপুরের কাটাবাঁশের ঝাড়ে যে বীজ হয়েছে, তা দেখতে অনেকটা গম বা ধান আকৃতির।
"বাঁশ তো ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। একই গোত্রভুক্ত হওয়ায় বাঁশের বীজ থেকে চাল বের করে তা রান্না করলে হতেও পারে ভাত। তবে বাঁশের বীজ থেকে চাল হচ্ছে, এটা আমি প্রথম শুনলাম। ভারতেও বীজ হয়, সেখানেও না কি এভাবে রান্না করে খায়," মি. রহমান বলেন।
তিনি আরও জানান, সব বাঁশের বীজের আকার একই রকম না। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে মূলি বাঁশ নামক এক ধরনের বাঁশ আছে। সেই বাঁশের বীজের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "বাঁশের বীজের সাইজ একেকরকম। কিছু আছে সরিষার দানার মতো। সবচেয়ে বড়টা মূলি বাঁশের বীজ, সেটা পিঁয়াজের মতো। আবার এই কাটা বাঁশের বীজ গমের মতো।"
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীদের কাছে বাঁশের সবজি খুব প্রিয় এক খাবার।
"বাঁশের বীজ খাওয়ার বিষয়টি আগে থেকেই চলে আসছে। মুলি বাঁশে বীজ আদিবাসী বা পাহাড়ি মানুষ সংগ্রহ করে খায়। আর সবজি হিসেবে কোড়ল তো তাদের খুব প্রিয়।"
তবে বাঁশফুল চালকে ধানের বিকল্প হিসেবে ভাবার এখনি কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না কর্মকর্তারা।
ডোমার উপজেলায় অবস্থিত আঞ্চলিক বাঁশ গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (আরবিআরটিসি) রিসার্চ অফিসার মো. আসাদুজ্জামান সরকার বলেন, " ধান গাছ থেকে আমরা তিন মাস পরে ধান পাই। কিন্তু একটি বাঁশের জীবনকাল তো মিনিমাম ৪৫ বছর। তাহলে সেটিকে ধানের বিকল্প হিসেবে ভাবা যায় না।"
"এছাড়া, ধানের পুষ্টি আর ওটার পুষ্টিগুণ কাছাকাছি কি না, তাও আমরা জানি না।"
তবে জেনেটিক পরিবর্তন করে বাঁশগাছের জীবনকাল কমিয়ে আনা গেলে সেটার সম্ভাবনা রয়েছে বলে কর্মকর্তারা বলছেন।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) আঞ্চলিক কার্যালয় রংপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. রকিবুল হাসান জানান, তারা ইতোমধ্যে আধা কেজি বীজ ও চালের নমুনা সংগ্রহ করেছেন।
“আমরা নমুনা সংগ্রহ করেছি। আমরা পরীক্ষা করে দেখবো যে দানার গুণমান বা পুষ্টিগুণ কেমন। অনেক পুষ্টিগুণ থাকলে আমারা দেখবো যে আয়ুষ্কাল কমিয়ে আনা যায় কি না।"
এ সময় মি. হাসান আরও বলেন, এরকম চাল ভারতের কেরালা, তামিলনাড়ু, আসামে বাণিজ্যিকভাবে হয় বলে তারা জানতেন। কিন্তু বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এরকম হলো।
"পাহাড়ি এলাকায় যা হয়, তা সাধারণত ইঁদুর খায়। এর আগে এত বেশি পরিমাণে বীজ হয়নি ও চাল হতে আমরা কখনও দেখিনি। তাই, বিষয়টা আমাদের জন্যও নতুন।"
‘ইঁদুর বন্যা’ ও দুর্ভিক্ষের সাথে বাঁশফুলের সম্পর্ক কোথায়
ধান যেমন ইঁদুরের খুব প্রিয় খাদ্য, তেমনি একই গোত্রভুক্ত বাঁশের বীজও ইঁদুরের খুব প্রিয়।
তাই, যখন কোথাও বাঁশের বীজ হয়, তখন সেখানে ইঁদুর ও পাখির সমাগম বেড়ে যায়।
তবে ইঁদুর নিয়ে শঙ্কার কারণ, এই প্রাণী থেকে প্লেগের মতো বিভিন্ন ইঁদুরবাহিত রোগ ছড়ায়।
বন গবেষণা ইন্সটিউটের চট্টগ্রামের বিভাগীয় কর্মকর্তা মি. রহমান বলেন, "যেখানে ধান হয়, সেখানে ইঁদুর থাকে। কারণ ধান ইঁদুরের পছন্দের একটি খাদ্য। তাই ওখানে যদি মানুষজন যায়, তাহলে অসুখ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। হবেই, তা বলা যাবে না।"
ইঁদুর যখন ধান খায়, তখন তার প্রজনন ক্ষমতা বেড়ে যায়।
মি. রহমান বলছেন, "বীজ খেলে ইঁদুরের ব্রিডিং ক্যাপাসিটি বেড়ে যায়। ফলে ঐ এলাকায় হঠাৎ করে ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে যায়।"
কিন্তু খেতে খেতে যখন বীজ একসময় শেষ হয়ে যায়, তখন ওই ইঁদুর "খাবারের জন্য আশেপাশের মানুষের বাড়িতে হানা দেয় ও ফুল চলে গেলে সেখানে দুর্ভিক্ষ বেড়ে যায়।"
কিন্তু একটি মাত্র বাঁশঝাড়ে এরকম ফুল থেকে ইঁদুর বন্যার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে না। সাধারণত পাহাড়ি এলাকার মতো যেসব স্থানে অনেক জায়গা জুড়ে বাঁশঝাড় থাকে, সেখানে বাঁশফুল আসলে এরকম সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
প্রচলিত ধারণা থাকলেও বাঁশগাছে ফুল আসার কারণে ইঁদুরের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়া বা এই কারণে দুর্ভিক্ষ হওয়ার মতো ঘটনা বাংলাদেশে কখনো শোনা যায়নি।
সূত্র : বিবিসি বাংলা