২৫ বছর পর চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডের রায় দিয়েছেন আদালত। শিল্পপতি আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ তিন জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। রায়ের খবরটি শুনে বারবার মনে পড়ছিল চিত্র নায়িকা দিতি আপার কথা। তিনি যে আমার বড় বোন ছিলেন। মারা যাওয়া আগে এই হত্যাকাণ্ড, সাোহেল চৌধুরীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনেক গল্প করেছেন আমার সঙ্গে। শেয়ার করেছেন তার কষ্টের জীবনের কথাও। আজ খুব মনে পড়ছে দিতি আপার একটি কথা রাখতে পারিনি। সেটিই শেয়ার করছি আপনাদের সঙ্গে।
সময়টা ২০০১ সাল। আমি তখন দৈনিক মানবজমিন-এ বিনোদন বিভাগে সাংবাদিকতা করি। রিপোর্টিং করতে গিয়েই পরিচয় হয় মহান হৃদয়ের মানুষ পারভিন সুলতানা দিতি আপার সঙ্গে। বিভিন্ন শুটিং স্পট ও অনুষ্ঠানে দেখা হতো তার সঙ্গে। প্রথম দিকে তিনি আপনি বলে সম্বোধন করতেন। কিছুদিন পরই তিনি তুমি বলে সম্বোধন করতে শুরু করেন। ভাল লাগে তার আন্তরিকতা নিয়ে ডাকাটা।
একদিন কি মনে করে তিনি আমাকে বললেন- 'তোমার কি কোন বড় বোন আছে।'
বললাম, 'না।'
সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন আজ থেকে আমি তোমার বড় বোন। আমার সেদিন কতটা ভাল লেগেছিল সেটা বলে বুঝানো যাবে না। এর পর থেকে দিতি আপার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এক ধরনের আত্মীয়র মতোই হয়ে যায়। তিনি আমাকে তুই বলে সম্বোধন করেন। তিনি প্রায়ই ফোন করতেন দুপুরে তার বাসায় খেতে যাওয়ার জন্য। প্রথম দিকে লজ্জা পেতাম। খেতে না চাইলে তিনি এমন ভাবে ধমক দিতেন যাতে মনে হতো সত্যি তিনি আমার আপন বোন। সে সময়টায় তিনি ফার্মগেটের পাশে ইন্দিরা রোডের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।
খাবার টেবিলে বসে কত গল্প করেছি তা বলতে গেলে অনেক সময়ের দরকার। তার ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কিছু তিনি শেয়ার করতেন। বলতেন কষ্টের কথা। তার প্রথম স্বামী চিত্র নায়ক সোহেল চেৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হওয়া থেকে শুরু করে অনেক বিষয়ে বলতেন। কখনো কখনো তিনি এমন দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন যেটা সত্যিই খুব কষ্ট দিতো। সোহেল চৌধুরী হত্যার পর তার অনেক কষ্টের কথাও শেয়ার করতেন। যা আজ খুব মনে পড়ছে।
২০০৩ সালের দিকে আমার লেখা একটি নাটক নির্মান করেন একজন পরিচালক। আমি যেমন নতুন লেখিয়ে ঠিক তেমনি সব শিল্পীও ছিল নতুন। একদিন দিতি আপার বাসায় যাই ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য। সে সময় আমি আমার লেখা নাটকের শুটিংয়ের কথা বলি তাকে। তিনি আমার দিকে কড়া চোখে তাকান। বলেন, 'তোমার নাটকের শুটিং হলো...অথচ আমি নেই। আমি কি তা হলে কোন অভিনেত্রী নই।' সত্যি সেদিন তার কথা শুনে নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলো। কারন শোবিজে দিতি আপার চেয়ে কাছের তখনও কেউ ছিল না আমার।
রাত ৮ টার দিকে তার বাসা থেকে বেরিয়ে একটি রিক্সা নিয়ে গুলশান-১ এর দিকে যেতে থাকি। দিতি আপা তখন গুলশানে তার নিজের বাড়িতে থাকেন। রিক্সায় বসেই ভাবতে থাকি দিতি আপাকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে একটি নাটক লিখবো। রিক্সায় বসেই নাটকের নাম ঠিক করে ফেললাম 'বড় আপা'।
এরপর কাহিনী কি হবে তাই নিয়ে চিন্তা করতে থাকলাম। কাহিনীও পেয়ে গেলাম। আমার বন্ধু কামরুল হাসান রাসেলের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বললাম। কাহিনী তার পছন্দ হলো। কথা হলো নবীন পরিচালক বাশারুল ইসলাম মুন্নার সঙ্গেও। কাহিনী সবার পছন্দ হওয়ার নাটকটি লিখে ফেললাম আমি। বাশারুল ইসলাম মুন্না বললো এটি সিঙ্গেল নাটক না করে টেলিফিল্ম করা যায়। শেষ পর্যন্ত টেলিফিল্মেরই সিদ্ধান্ত হলো। টেলিফিল্মের প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন আল-হাজেন (বর্তমানে নাম করা পরিচালক)। টেলিফিল্মটিতে 'বড় আপা' চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দিতি আপা। আরো ছিলেন রোমানা, শাহেদসহ অনেকে। টেলিফিল্মটি ওই বছরই রোজার ঈদের অনুষ্ঠান মালায় এটিএন বাংলায় প্রচার হয়েছিল।
২০০১ সালের শেষ দিকের ঘটনা। আমি তখনও জানতাম দিতি আপা কাঞ্চন ভাই (চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন) এর স্ত্রী। কিন্তু হঠাৎ একদিন একজন চিত্র পরিচালক আমাকে জানালেন তাদের ডির্ভোস হয়ে গেছে। কিন্তু বিষয়টা কেউ জানে না। সাংবাদিক হিসেবে আমার কাছে এটা একটা বড় সংবাদ। অফিসে গিয়ে বিনোদন বিভাগের প্রধান প্রয়াত মোশাররফ রুমী ভাইকে ঘটনাটি বললাম। এ সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন মানবজমিন পত্রিকার তৎকালীন বার্তা সম্পাদক বর্তমানে এটিএন নিউজের হেড অব ইনপুট শহিদুল আজম ভাই। তিনি শুনে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমাকে বললেন নিউজ লিখতে এবং দিতি আপার কমেন্ট নিতেও বললেন। বুঝলাম বেশ বে-কায়দায়ই পড়ে গেলাম আমি। নিউজ এডিটরের নির্দেশ অমান্য করার ক্ষমতা আমার নেই। অন্যদিকে দিতি আপাকে কিভাবে ফোন করে বিষয়ের সত্যতা জানতে চাইবো ইতস্তত করছিলাম। কারণ তিন দিন আগেও তার বাসায় দুপুরে খেয়ে এসেছি। কাঞ্চন ভাইয়ের বিষয়ও এসেছিল আলোচনায়। কিন্তু তিনি আমাকে ডিভোর্সের বিষয়ে কিছুই বলেননি। আজ তাকে কি করে ফোন করি। এর পরও সাংবাদিক হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব। ব্রেকিং নিউজ। এটা করতে হবে আমাকে। মোবাইল ফোনে ফোন দিলাম দিতি আপাকে। তিন দিন কোন কথা না হওয়ায় তিনি অনুযোগ করলেন-
'কিরে বোনকে তিন দিন পর মনে পড়লো?' বিশ্বাস করুন, আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। ঠিক যেন আমি আমার মধ্যে নেই। কিভাবে প্রশ্নটা করবো। কোন উত্তর না দিয়ে চুপ হয়ে গেলাম। দিতি আপা জানতে চাইলেন-
'কিরে কথা বলছিস না কেন?'
আমি বললাম,
'নিউজের একটি বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলা দরকার।'
দিতি আপা হাসলেন,
'বল না। কি জানতে চাস?'
আমি সাহস সঞ্চয় করে তাকে বললাম
'আপা আমার অফিসের এক বস কোত্থেকে জানি জেনেছে আপনি কাঞ্চন ভাইকে ডিভোর্স দিয়েছেন। বিষয়টা সত্যি কি না আপনার বক্তব্যে নেওয়ার জন্য আমাকে বলেছে।' সঙ্গে সঙ্গে ওপাশে আমি যেমন একটু আগে নিরব হয়ে গিয়েছিলাম ঠিক তেমনি হয়ে গেলেন দিতি আপা। আমার কষ্ট হচ্ছিল খুব। মনে মনে ভাবছিলাম সাংবাদিকতা পেশা এমনি একটি পেশা কারো সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক করাটা একদমই উচিত না।
বললাম, 'আপা কিছু বলুন।'
দিতি আপা এবার বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, 'এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমি কাউকে ডিভোর্স দিয়েছি বলে আমার জানা নেই।'
তার বক্তব্যের বিষয়টি গিয়ে শহিদুল আজম ভাইকে জানালাম। তিনি বললেন- ইলিয়াস কাঞ্চনের কমেন্ট নিতে। আমি চলে গেলাম রাজধানীর কাকরাইলে কাঞ্চন ভাইয়ের অফিসে। কাঞ্চন ভাই অফিসেই ছিলেন। কাঞ্চন ভাইও আমাকে খুব স্নেহ করেন। কথাচ্ছলে কাঞ্চন ভাইকে বললাম, 'দিতি আপা আপনাকে ডিভোর্স দিয়েছে শুনলাম।' কাঞ্চন ভাই বললেন- 'হ্যা দিয়েছে। কার কাছ থেকে শুনলে?'
পরক্ষনই তার মনে পড়লো আসলে তিনি একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছেন। সঙ্গে সঙ্গেই কাঞ্চন ভাই বললেন- 'প্লিজ তুমি এটা নিউজ করো না। আমাদের ডিভোর্সটা হয়েছে ৪ মাস আগে। আমরা দু'জই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ বিষয়টা কাউকে জানাবো না।'
আমি তখন বললাম, নিউজ করার জন্যই আমি আপনার বক্তব্য নেওয়ার জন্য এসেছি।' কাঞ্চন ভাই কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে তাকলেন। এর পর বললেন- 'ঠিক আছে লিখবেই যখন তখন তুমি লিখো আমি তাকে এখনো ভালবাসি।'
আমি কাঞ্চন ভাইয়ের অফিস থেকে বেরিয়ে দিতি আপাকে আবার ফোন দিলাম। জানালাম ডিভোর্সের বিষয়ে কাঞ্চন ভাই স্বীকার করেছে। তখন দিতি আপা বলেছিলেন- 'এই রিপোর্টটা না করলেই কি নয়।'
'বোধ হয় সম্ভব নয়' বলে ফোন কেটে দিই। কষ্ট হচ্ছিল খুব। ভাবছিলাম পেশার কথাও। সেদিন আমি দিতি আপার কথা রাখতে পারিনি।
চলে গেলাম অফিসে। নিউজের শিরোনাম দিলাম- কাঞ্চন-দিতির ডিভোর্স। পরদিন মানবজমিন-এর প্রথম পাতায় দু'জনের ছবি দিয়ে আমার নামে রিপোর্টটি প্রকাশিত হলো। সেদিন থেকে দিতি আপাও আর আমাকে ফোন দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। আমি ফোন দিলে তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ করতেন না।'
কিছুদিন পর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস)-এর একটি অনুষ্ঠানে তৎকালীন শেরাটন হোটেলের উইন্টার গার্ডেনে গেলাম। সামনের দ্বিতীয় সারিতে নায়িকা একার পাশে বসেছিলেন আমার দিতি আপা। আমি দূর থেকে দেখে ওদিকে আর যাইনি। এক পর্যায়ে সামনে থেকে এক সাংবাদিক আমাকে ডাকলো। তার দিকে যাওয়ার সময় তাদের কাছাকাছি হয়ে যাই আমি। নায়িকা একা আমাকে দেখেই ডাকতে শুরু করেন। তার কাছে যাই। একা আমাকে দিতি আপার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে যায়। একা বলে, 'দিতি আপা, ওনার নাম ওমর ফারুক। সাংবাদিক।'
সঙ্গে সঙ্গে দিতি আপা আমার দিতে তাকিয়ে বলেন, 'ওনি সাংবাদিক। আমি ওনাকে চিনি। ওনি অনেক বড় সাংবাদিক।'
আমি লক্ষ্য করলাম দিতি আপার চোখ ছলছল করছে। আমার চোখেও তাই অনুভব করলাম। দু'জনের এ অবস্থা দেখে একা বিস্মিত। আমি সেদিন বলেছিলাম, 'দিতি আপা আমি যখন সাংবাদিক তখন আপনি নায়িকা দিতি। আর আমি যখন ব্যক্তি তখন আপনি আমার বোন।'
এর পর থেকে দিতি আপা আমার সঙ্গে কথা বলতেন। আমার টেলিফিল্মেও অভিনয় করেছেন। কিন্তু কোনদিন তুই বলে আর সম্বোধন করতেন না। আজ দিতি আপা নেই। আমার বড় বোন নেই। সরি দিতি আপা আপনার কথা রাখতে না পারার জন্য।