logo
আপডেট : ২২ জুন, ২০২৪ ০৮:৩৩
একদিন তাহের ডাক্তার ও মরার বাড়ীতে ভোজন
গণপতি আদিত্য

একদিন তাহের ডাক্তার ও মরার বাড়ীতে ভোজন

পাগলা গ্রামের তাহের ডাক্তার একজন জনপ্রিয় পল্লীচিকিৎসক, নানা কারণে ছত্রপতির প্রিয়ভাজন ব্যক্তি। অষ্টাশির বন্যার পর ছত্রপতি যখন ফুলপুরে চিকিৎসা পেশা শুরু করে , প্রথমদিন থেকেই তাহের ডাক্তারের সাথে তার পরিচয়। ফুলপুরের অধিকাংশ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ তাহের ডাক্তারের সাথে আগে পরামর্শ করে এমবিবিএস ডাক্তার নির্বাচন করেন। একদিন মধ্যরাতে  তাহের ডাক্তার ছত্রপতির বাসায় পেটের ব্যথার এক রোগী নিয়ে হাজির ,
: দাদা দেখেন তো, রোগীটার ম্যাকবার্নিস পয়েন্টে ঝামেলা লাগতেছে! আইজ কাইলের এমবিবিএস যে কী হইছে সব!
ছত্রপতিও আইজ কাইলের, রোগীকে পরীক্ষা করে ম্যাক বার্নিস পয়েন্টে খুব ব্যথা লক্ষ্য করলো,
: তাহের ভাই, এইটা তো  একিউট এ্যাপেনডিসাইটিস, মমিসিং মেডিকেলে নেওন লাগবো!
: রাহুইন দাদা, এই যে মমিসিং এর কাগজ, দেহেন কী যে আবোল তাবোল লেকছে! আফনে চিকিৎসা দেইন!
: অপারেশন লাগতে পারে তো!
: রোগী মনে করুইন অপারেশন করতো না, আফনে চিকিৎসা দিতাইন না? আফনাদের বইয়ে "ওসনার সেরেন রেজিমেন" পড়েন নাই দাদা?
তাহের ডাক্তারের মুখে এ্যপেনডিসাইটিসের "ম্যাক বার্নিস পয়েন্ট" ও কনজারভেটিভ চিকিৎসার "ওসনার-সেরেন-রেজিমেন" শুনে ছত্রপতির চক্ষু ছানাবড়া! সেই মধ্যরাত থেকে তাহের ভাই ছত্রপতির কাছে একজন নির্ভরযোগ্য আপনজন হয়ে উঠলেন।
চারদিকে তখন হাইজাকারের উৎপাত। সম্পন্ন গৃহস্থ ঘরের শিশু কিশোরদের ঘর থেকে চুরি বা অপহরণ করে মোটা মুক্তিপণ দাবী করে একটি চক্র এলাকা জুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করছে। ছত্রপতি যে বাসায় ভাড়া থাকে সেই মালিকের নাতি,  পাঁচবোনের একভাইকে সিংহেশ্বর গ্রামের দালাইন্না বাড়ী থেকে হাইজাক করা হয়েছে। ছত্রপতির মা সেটা শুনেছেন,বাড়ী থেকে আসার সময় বার বার বলে দিয়েছেন "রাইতে কোথাও যাইস না!" 
ছত্রপতিও পাঁচবোনের একভাই! শীতকাল তখন, সেদিন ছিল শবেবরাতের রাত। তাহের ভাই সন্ধ্যা সাতটার দিকে দু'জন বন্দুকধারী ভদ্রলোক সহ ছত্রপতির বাসায় হাজির,
: দাদা, একটা কলে যাওন লাগবো, পংগুয়াই গ্রামে, সদরুদ্দিন সরকারের যা দশা!
বন্দুকধারী দু'জনের একজনকে ছত্রপতি আগেও দেখেছে। তিনিই বললেন, দাদা ভয় পাবেন না, এগুলো আমাদের লাইসেন্স করা বন্দুক। প্লিজ চলেন দাদা, রোগী আমার শ্বশুর। সবার ইচ্ছা, মরণের আগে একজন এমবিবিএস ডাক্তার দেহাইতো!
ছত্রপতি তাহের ভাইকে বলে, এই রাইতের বেলা পংগুয়াই... চারদিকে যা শুনতেছি...
সাথের আরেক বন্দুকওয়ালা বললো, আমরা দুইটা রিক্সায় যাবো। বন্দুক লইয়া এস্কট কইরা আপনেরে ঠিক ঠিক বাসায় পৌঁছায়া দিয়াম।
তাহের ভাই বললেন, যাইন দাদা, দেইখা আসেন, আল্লাহ্ ভরসা! আমিও যাইতাম, কিন্তু আপনের ভাবীর শইলডা তেমুন বালা না!
ছত্রপতি এবার একটি সূত্র পেয়ে বেঁকে বসে যে, তাহের ভাই সাথে গেলে সে যাবে। এমন ভীতিকর হাইজাক পরিস্থিতির  মাঝে সে অপরিচিত স্থানে একা যাবে না! 
শেষে তাহের ভাই রাজী হলেন। দুটি রিক্সা টিম টিম করে গ্রাম্য কাঁচা রাস্তায় চলছে, ছত্রপতির রিক্সায় হ্যারিকেন নেই। রিক্সাওয়ালাটি খুবই বাচাল ও সবজান্তা টাইপের। সে বলতে লাগলো,
: সামনের যে মোড়টি পাইবেন, সেইখান থেকে গতকাল একটি বাচ্চার মাথা পাওয়া গেছে। মুক্তিপণ বনাবনি হয় নাই!
ছত্রপতি বলে,
: আপনে কী করে জানলাইন!
: আমি হুনছি, মাইনষে কইছে!
: মাইনষের কথা বিশ্বাস করুইন ক্যায়া?
: বিশ্বাস করন লাগে ডাক্তার সাব। হাইজাক যারা করতেছে হেরা তো আপনে আমার মতোনই মানুষ, না কি কন?
: তা তো বটেই!
: যারা হাইজাক করে, তারাও তো কেউ কেউ রিক্সা দিয়া আনাগোনা করে। না কি কন? রিক্সাওয়ালা তো রিক্সা বাইয়াই বৌ পোলাপান পালে। দুইচারজন রিক্সাওয়ালাও তো হেইতা দুইনম্বর কামের লগে থাকতো পারে! না কি কন? হেইতা দুইচারজনে আমারেও তো চিনবার পারে,  নাকি পারে না ডাক্তার সাব? এই হাইজাক বিষয়টা একটা হাওয়া। আমি আপনের মতো মাইনসের লেবাসেই হেরা ঘুরতাসে। সামনের মোড়টার দিক থাইকা হাউ মাউ হুনতেছি মনে হইতাছে...
ছত্রপতির পাশে বসা বন্দুকসাহেব এতোক্ষণে মুখ খুললেন,
: যা কইছো এতোক্ষণ, ঠিকই আছে। আমার বন্দুকে গুলি আছে মাত্র দুইটা। যদি গুলি শেষ হইয়া যায় পরে কী দিয়া ডাক্তার সাবরে বাঁচামু!
ছত্রপতির গা ভয়ে হিম হয়ে আসে। সহযাত্রী বন্দুকসাহেব ও রিক্সাওয়ালাকে তার হাইজাকার পার্টি বলে সন্দেহ শুরু হয়,
: আর কতদূর পংগুয়াই?
: চাইর মাইল।
: চাইর মাইল তো মেলা দূর, এক ঘণ্টা ধরে আসতেছি! 
: হ, চাইরমাইল তো সাড়ে তিনমাইলের আধা মাইল বেশী ডাক্তার সাব। অহন নামুইন, আইয়া পড়ছি।
 
ভয়ার্ত পরিবেশে রিক্সাওয়ালার রসিকতা ছত্রপতির মেজাজ খারাপ করে দিলো। আরো ভয় পেয়ে গেলো যখন তাহের ভাইয়ের রিক্সাওয়ালা বললো,
: আইজ রোগীর বাড়ীতে পরবাস থাহুইন যে ডাক্তর সাব। হেরা বালা মানুষ, ভিজেট বাড়াইয়া দিব। আফনে যে এলাকাত আইছুইন, দুই একটা ডাক্তার এ খবর পাইছে। তারা এক্কেবারে এফ.আর. সি. এস  ডাক্তার। ডাক্তর কারে কয় বুজ্জুইন তো?
: বুজ্জি, হাইজাকার!
: হ হ,  এই তো বুজ্জুইন।
 
(২)
তাহের ভাইয়ের বিবর্ণ মুখটা রিক্সার হ্যারিকেনের আলোতে প্রকট হয়ে উঠলো। সম্ভাব্য বিপদের হাতে নিজেকে করুণ সমর্পণ করে ছত্রপতি মায়ের মুখটা স্মরণ করে সদরুদ্দিন সরকারের ঘরে প্রবেশ করে।
অনেক বনেদী বাড়ী, দেখেই বুঝা যায়। দালানটি চুনসুড়কির, বেশ প্রাচীন ধনাঢ্য বাড়ী। ঘর ভর্তি মানুষ সরকার সাহবের জন্য আহাজারি করছেন। একজন ডাক্তারকে রাত নয়টায় পেয়ে সদরুদ্দিন সরকারের মুখে একটি আশার রেখা ঝলকে উঠতে দেখে ছত্রপতি।
: আদাব ডাক্তার সাব। ভালো আছেন? খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি, আহা!
: আদাব। না না কষ্ট নয়। বলুন তো আপনার কী কী সমস্যা বোধ হচ্ছে?
সদরুদ্দিন সরকার কাউকে ইশারা করে ঘরের খিল দিতে বলেন এবং ডাক্তারের জন্য নাস্তার আয়োজন করতে বলেন। দরজায় খিল লাগানো হলে সরকার সাহেব বলতে শুরু করেন,
: ডাক্তার সাব, আমার খুব গ্যাসের প্রবলেম আছে। নাইনটিন সিক্সটি ফাইবে ডা.পিবি রায়, এম.বি- ক্যাল, নাম শুনছেন বোধ হয়, তখন পাঁচ টাকা ফিস, লিলি কোম্পানীর কী যেন একটা ফাইল দিয়েছিলেন। এক ফাইল খাইয়া আমি বহুতদিন বালা আছিলাম। এহন কী সব রেনিটিড বড়ি বাইর হইছে, দিনে ছয়টা খাই কোন কাম হয় না...
: আপনার বুকে কোন ব্যথা আছে? শ্বাস কষ্ট হচ্ছে? বিছানায় শুইতে কষ্ট হয়?...
তাহের ভাই একটু বিরক্ত হয়ে ছত্রপতির কাছে এসে সবার সামনে বলা শুরু করে,
: কী, হিস্টোরী নেওয়া শুরু করছুইন দাদা! রোগীর হার্ট এ্যাটাক হইছে বুঝতাছেন না? রোগী ধড়পড় করতাছে, ঘামতাছে...
: ছত্রপতি দ্রুত নাড়ী দেখে ও ব্লাডপ্রেসার মেপে বুকে স্টেথোস্কোপ বসিয়ে নিশ্চিত হয় যে এটি এ্যকিউট লেফট্ হার্ট ফেইলুর। অক্সিজেন, মরফিন, নাইট্রেট ইত্যাদি জরুরী দরকার। ঘোষণা দেয় যে রোগীকে ময়মনসিংহ মেডিকেল হাসপাতালে নিতে হবে।
সরকার সাহেবের বড় মেয়ের জামাই ছত্রপতির হাতে ধরে নীচুস্বরে বলেন,
: ডাক্তার সাব, আমাদের কোন দাবী নাই। আপনি নিজে চেষ্টা করুন,  আল্লাহ্ ভরসা। এই রাইতে শম্ভুগঞ্জ গোদারা পার হয়ে মমিসিং যাইতে যাইতে রোগী শেষ হইয়া যাইবো, প্লিজ!
ছত্রপতি একটি কাগজে কিছু ঔষধের নাম লিখে একজনকে দ্রুত ফুলপুর থেকে আনতে বলে। নিজের ডাক্তারি ব্যাগে রাখা ল্যাসিক্স ইনজেকশন খুঁজে খুঁজে ছত্রপতি হয়রান হয়, কিন্তু পায় না! তাহের ভাই বলে,
: কী খুঁজতাছেন দাদা?
: ল্যসিক্স ইনজেকশন। দুটি আমার ব্যাগে ছিলো!
: আমারে কইবাইন না? আমার কাছে আছে।
ছত্রপতি চারটি ইনজেকশনের এ্যাম্পুল একসাথে সিরিঞ্জে নিয়ে সরকার সাহেবকে ইন্ট্রাভেনাস পুস্ করে দিলো, জিহ্বার নীচে নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে দিলো পরপর চার বার। দশ মিনিটের মধ্যে সরকার সাহেবের শ্বাস কষ্ট কমে গেলো, তাকে তরল কিছু খাওয়ানো হলো।  তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন, ঘরের ভিতরে ছত্রপতি ডাক্তারকে নিয়ে ধন্য ধন্য গুঞ্জন শুরু হলো, ঔষধটা ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে, ডাক্তার সাব খুব বালা!
বিবিধ প্রকার ফলমুল, সেমাই, মিষ্টি, জিলিপি ইত্যাদি এলো আপ্যায়নের জন্য। ছত্রপতি খাবে না বলছে। তাহের ভাই বললো,
: খাইনছে দাদা! আমার খিদা লাগছে। রাইতে আর খাওন নাই। শবেবরাতের রাইতে আমরাও কম বন্দেগী করতেছি না!
তাহের ভাইয়ের সাথে ছত্রপতিও আনীত সমুদয় খাদ্যসামগ্রী নিঃশেষ করলো। ভদ্রতাবশতঃ ইচ্ছে থাকলেও ক্ষুধাবশতঃ কোন পিরিচে খাদ্যবস্তু উচ্ছ্বিষ্ট রইলো না। প্রায় ঘণ্টাখানেক অতিক্রান্ত হতে চললো, মোটর সাইকেলে এতোক্ষণে ঔষধের স্লিপ বাহকের ফিরে আসার কথা। 
 
(৩)
সদরুদ্দিন সরকারের কলেজ পড়ুয়া দৌহিত্র পারভেজ ওরফে হারবেজ্জ্যেয়া হাইজাক পার্টির ভয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে পাশের বাড়ীতে আবুল্লিয়ার মার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার বড় খালু রাগে আস্ফালন করে আরো চারজনকে সাথে নিয়ে বের হলেন "কানটা  ধরে " নিয়ে আসার জন্য। তাহের ডাক্তারের ব্যাগে মাত্র আর একটা ল্যাসিক্স ইনজেকশন অবশিষ্ট আছে। রোগীর সম্ভাব্য জটিলতাগুলো নিয়ে ছত্রপতি ও তাহের ডাক্তার যথাসম্ভব উপস্থিত জামাতাবৃন্দকে বুঝিয়ে দিলো। ছত্রপতি যতোটুকু বলে তাহের ডাক্তার তার চারগুণ বাড়িয়ে বলে, কানে কানে সে বলে,
: দাদা, রোগী যখন মরো মরো অবস্থা, কমপ্লিকেশন কমায়া বলার মানে আছে? আফনে অহন কতা কম কইন!
উপস্থিত সবাই তাহের ভাইয়ের কথা যে ভালভাবে বুঝলেন জামাইদের মাথা ঝাঁকুনি দেখে ছত্রপতি অনুমান করলো। ময়মনসিংহ শহর থেকে আগত সরকার সাহেবের পঞ্চম জামাতা তীব্র মাথাব্যথার কারণে রোগীর শয্যার পাশে অনুপস্থিত। তিনি ভিতরের বাড়ীতে "নতুন ঘরে" বিশ্রাম নিচ্ছেন! 
ছত্রপতি রোগীকে আবার দেখলো। প্রেসার অনেক কমে গেছে, বুকে পানি জমেছে। রোগীর বাহ্যজ্ঞান লোপ পাওয়ার পথে। তাহের ডাক্তারকে বিষয়টি বললে, সে সবাইকে ডেকে বলে,
: রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। আমাদের আর করার কিছুই নাই। খালি হাতে কী যুদ্ধ করবাম? আপনেরা আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেন, আইজ শবেবরাতের রাইত। আমাদের দয়া করে যেভাবে ফুলপুর থেকে আনছিলেন, সেইভাবে ইস্কট কইরা পৌঁছায়া দেন!
সাথে সাথে কানাঘুষা, গুঞ্জন শুরু হলো,
: কয় কি? মাথা খারাপ? কেডা যাইবো? রিক্সা নাই, গাড়ী নাই...জীবনের রিস্ক কেডা নিবো অহন? তাইনেরা কষ্ট কইরা রাইতটা পার করুক এখানে। ভিজিট বাড়ায়া দেওয়া হইবো!
তাহের ভাই একটু উত্তেজিত হয়ে বলে,
: গাং পার হইলে মাঝি শালা! বিপদ তো সবারই। ভবিষ্যতে আরো ডাক্তারের কাম তো লাগতেও পারে! যাহোক, ডাক্তার সাবরে ঘুমানোর একটু জাগা দেইন। আমি মসজিদে যামু গা!
 
ছত্রপতি একা কোন ঘরে থাকবে না শুনে সবাই অভয় দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। অগত্যা ছত্রপতি ও তাহের ডাক্তার কে নিয়ে ভিতর বাড়ীতে নতুন ঘরের একটি বন্ধ দরজায় সরকার সাহেবের বড় জামাই বার বার ধাক্কা দিয়ে ও কড়া নেড়ে ব্যর্থ হলে তাহের ভাই জোরে জোরে বলে,
: এভাবে হবে না, ঢেঁকি ঘর থেকে ঢেঁকি আনেন, দরজা ভাঙবো। ভিতরে মইরাও তো থাকতে পারে!
 
তখনি ঘরের ভিতর থেকে একটি মেয়ে কণ্ঠে উত্তর এলো, 
: তাইনের খুব মাথা বেদনা। ডাক্তর সাবরে এখানে একটু আনবাইন?
: আগে দরজা খুলুইন, ডাক্তর সাব লগেই আছুইন। 
 
দরোজা খুলার সাথে সাথে তাহের ভাই ঘরে ঢুকে ধমকের সুরে পঞ্চম জামাতাকে বলেন,
: কীয়ের ছাতার জামাই হইছুইন! শ্বশুড় বেডা মরতাছে আর আপনে বৌ লইয়া এহানে ফুইত্তা রইছুইন! যাইন যাইন মিয়া, শ্বশুড়ের পাশে যাইন, সবাইরে চেহারাডা দেহাইন! এখানে আমরা ফুতবাম!
 
বেচারা পঞ্চম-জামাতা নিজের মাথা নিজেই টিপতে টিপতে  বিরক্তি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। তাহের ডাক্তার ও ছত্রপতি শীতের রাতে একটি মাত্র লেপ নিয়ে শুয়ে পড়লো। লেপের ওয়্যার নেই, দু'এক স্থানে কার্পাস তুলা উঁকি দিচ্ছে। ঘরের কোণে রাখা কুপি বাতিটি তেলের অভাবে অল্প কিছুক্ষণ পরেই নির্বাপিত হলো। অন্ধকার ঘরে লেপের কভারে লেপ্টে থাকা অসংখ্য মানুষের উদ্ভট গায়ের গন্ধমিশ্রণ ক্রমশ প্রকট হতে থাকলো। লেপের দুর্গন্ধে হাইজাকারের মুলুকে এই ভীষণ অন্ধকারে ঘুম যদি এসেই যায় তবে তাকে নিদ্রাদেবীর আশীর্বাদই বলতে হবে। ছত্রপতি এসব ভাবছে আর  পাশে থাকা তাহের ভাইয়ের নাসিকা গর্জনে অন্ধকারটিকে কে আরো বীভৎস মনে হচ্ছে। তাহের ভাইকে বার বার ধাক্কা দিয়ে কৌশলে নাক ডাকা থামানোর একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টায় সে লিপ্ত হলো। ছত্রপতির ঘুমে সবে চোখটা লেগে আসছিলো,  হঠাৎ বাইরে রোদন ও কান্নার ভীষণ শব্দ ও কোলাহল। তাহের ডাক্তারকে ঠেলে ঘুম থেকে উঠায় ছত্রপতি। তাহের ভাই বলেন, " চলেন দাদা। রোগীর কাছে যাই!"
 
(৪)
পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে সদরুদ্দিন সাহেবের দেহে জীবনের কোন চিহ্ন পাওয়া গেলো না। ডেথ ডিক্লেয়ার করে ছত্রপতি। ছত্রপতি জীবনে এমন কান্নার রোল, এমন মর্সিয়া ক্রন্দন আর দেখেনি। যে কারো পক্ষে এখানে স্থির থাকা অসম্ভব। পঞ্চম জামাতার বিলাপ ও ঘন ঘন মূর্ছা যাওয়া সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় ছিলো, যিনি কিছুক্ষণ আগে দরোজা বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সুরেলা কান্নার চিৎকার ও  বিলাপে এখানে যে বক্তব্যটি এখানে পুনঃ পুনঃ ধ্বনিত হচ্ছে তার মর্মার্থ হলো, ফুলপুর থেকে একটি কাঁচা ডাক্তার এনে তাদের আব্বাকে মেরে ফেলা হয়েছে! বড় জামাই মূর্ছা থেকে উঠে ছত্রপতির দিকে রক্তচক্ষু করে প্রশ্ন করে,
: ডাক্তার সাব, কোরামিন ইনজেকশন্ আনছেন?
তাহের ভাই একটু রাগতঃ স্বরে বলে,
: কোরামিন দিয়া কীতা করবাইন? কোরামিন নাই।  এই নামে অহন কোন ঔষধ নাই।
 
অমনি এক মেয়ের বিলাপ সপ্তমে চড়লো,
: কী সব্বোনাশ হইছে গো আব্বা, মরার দুইডা ডাকতর, হেরা বুলে কোরামিনই  চিনেনা রে, হায় হায় রে, কোরামিনের লাগি আব্বায় আমার মইরা গেলো রে  এ এ এ এ....
 
সমবেত বিলাপের সুরের উঠানামায় ডাক্তারদের বিরুদ্ধে বক্তব্য শুনে, বিশেষত কী খেয়ে এমবিবিএস পাশ করেছে এসব শুনে  ছত্রপতির রাগ হচ্ছে, তাহের ভাইকে ঘরের বাইরে ডেকে নিয়ে বলে,
: চলেন তাহের ভাই, হেঁটে আমরা ফুলপুর চলে যাই!
 
: আপনের মাথা খারাপ দাদা! একটু অপেক্ষা করুইন। সবগুলো মেয়ে আর জামাই এক্কেবারে লেংগা অইয়া যাইবো, সারাদিন এরা কিছু খায় নাই মনে হয়। কান্দন- বিলাপ এগুলো সব অভিনয়, বুইড়া মরছে, পোলা নাই,  সম্পত্তির ভাগাভাগি কাইল থাইক্কা শুরু অইবো। আর একটু কাইন্দা লউক...
 
সত্যি সত্যি কিছুক্ষণ পর কান্নার তীব্রতা অশ্রুত পর্যায়ে নেমে আসলো। পঞ্চম জামাতা তার ইয়সিকা ক্যামেরা নিয়ে আসলেন। ফিল্ম নাকি শেষের দিকে। তিনটি স্ন্যাপ নেয়া হয়েছে মাত্র, শেষের ছবিতে পাঁচ মেয়ে ও পাঁচ জামাইয়ের সাথে  মৃত সদরুদ্দিন সরকার চক্ষু বুঁজে পোজ দিচ্ছিলেন। তাহের ভাই গর্জে উঠলেন, বড় জামাই তার সম্পর্কে ভাতিজা হয়,
: কী গো জামাইরা, মাইয়ারা, আপনাদের কি ফুর্তি লাগছে? রাহেন এইসব ফটু-ফাডা তুলা! শবে বরাতের রাইত,  একটু আল্লাহ্ বিল্লাহ করুইন!
 
মুহূর্তেই সব নীরব হয়ে গেলো। বাড়ীতে লজিং থাকা মাদ্রাসার পড়ুৃযা ছেলেটি কোরান শরীফ নিয়ে সদরুদ্দিন সরকারের সিথানে বসে পাঠ করতে লাগলো। ঘরে আগর বাতি নেই। আগর বাতি নেই কেন  জিজ্ঞ্যেস করলে বড় মেয়ে বলে,
 "আব্বা আইজ মরবো জানি? দোহানের বেবাক আগর বাতি দিয়া ঠিহি দিতাম!"
তাহের ভাই ছত্রপতিকে বুঝালেন, এই যে ফটো উঠানো হলো, এটি বুড়ার ওয়ারিশনদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে। মৃত্যুকালে যারা উপস্থিত নাই তারা খুব বেকায়দায় পড়ে যাবেন। পঞ্চম জামাতার বুদ্ধি দেখে ছত্রপতি অবাক হলো এবং আরো অবাক হলো যে, এই যে গগণবিদারী বিলাপ হলো, প্রতিবেশী একটি লোকও সদরুদ্দিন সরকারের বাড়ীতে এলো না! হাইজাকারের ভয় এমনি ভয়, জীবনের সাথে টাকাপয়সা যায়, মানে সব যায়! দ্বিতীয় জামাই কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসে গেলো, মাইকে জানাজার আহ্বান জানানোর সময় কী কী বলতে হবে। তাহের ভাই ছত্রপতিকে কানে কানে বললেন,
: দাদা, রাগে আমার হাত টা, নিসপিস করতেছে!
 ছত্রপতি বললো,
: আমারও।
 
তাহের ডাক্তার কে নিয়ে  ছত্রপতি বারান্দায় বসে রইলো, যেন তারা মরা পাহাড়ায় আছে। ভিতরে মাদ্রাসা পড়ুয়া ছেলেটি একা একা অস্ফুট স্বরে কোরান পাঠে মগ্ন। অন্যেরা কোথায় গেলো, ছত্রপতি ভেবে পাচ্ছিলো না। ঘণ্টা দুয়েক রাত অবশিষ্ট আছে। ক্ষুধা ও ক্লান্তির জের ধরে ছত্রপতির চোখের পাতা ভারী করে ঘুম আসছে। তাহের ভাইকে ঘুমের কথা বলতেই,
: চলেন দাদা, ভিতরে যাই, একটু ঘুমিয়ে নেই।
 
(৫)
ছত্রপতি ভিতরের বাড়ীর ঘরটিতে ঢুকেই একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলো। এমন একটি দৃশ্য এমন একটি পরিবেশে হতে পারে, ছত্রপতি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। পঞ্চম জামাই ঘরের একটি টেবিলে বসে আছে, সামনে থালা ভরা ভাত! পাশের একটি বাটি থেকে চারটি হলদেটে ডিমের ভুনা,  দারুচিনি ও জিরার আলগা আলগা সুবাস উদগীরণ হচ্ছে। দ্রুতপদে পঞ্চম মেয়ে একটি বাটিতে মুরগীর মাংস নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো, মুরগীর দুটো রান বাটির প্রান্তের বেশ উপরে,  অর্থাৎ মুরগীটি বেশ বড়ো ছিলো। মধ্যরাতে সদরুদ্দিন সাহবের নতুন জামাতার জন্য আহা বেচারা মুর্গী! আহা, যে লোকটি বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলো,  সেই ব্যক্তিটির জন্য শ্বশুড়ের মরদেহের পাশে ভোজনের আয়োজন দেখে একধরনের ঘৃণা ও আহা আহা বোধ ছত্রপতিকে মুহূর্তেই আচ্ছন্ন করে ফেললো। তাহের ভাই বললো,
: জামাই! আফনে এহন খাইতে বইছুইন? বেলাইজ্জা বেডা! আপনের শ্বশুড় তো একটু নড়ছে, যাইন যাইন, দেহুইন গা,,,
"আব্বাগো, আব্বাগো" বলে জামাতা ও মেয়ে ঘর থেকে নিস্ক্রান্ত হলে দ্রুত ঘরের খিল দিয়ে জামাই যে চেয়ারটিতে বসে খাবার গ্রহণের উপক্রম করছিলো, ছত্রপতিকে সেখানে বসিয়ে তাহের ভাই বলেন,
: খেয়ে নিন দাদা। আমার কিন্তু খুব ক্ষুধা পাইছে।
: তাহের ভাই, এই অবস্থায় খাওয়া?
তাহের ভাই তারপর একটি প্রবচন বললেন, যেটি ছত্রপতির মা প্রায়ই বলে থাকেন,
: যার মরা সে খায় মাছে ভাতে
  কাইন্দা মরে যোগীর পুতে!
 
দাদা, যাদের মরা তারা যদি মাইজ রাইতে মোরগ জবাই করে রান্না বাড়া করতে পারে, যারা কিছুক্ষণ আগে মরার লগে কাইন্দা কাইট্টা মারাই যাচ্ছিলো তাদের মুখে এই রাইতেই হাসিটা আসে কিভাবে দাদা? স্বার্থের দুনিয়া দাদা। আফনে আমি মন খারাপ কইরা, না খাইয়া মরবাম নাকি? নেন দাদা, খেয়ে নেন।
 
ছত্রপতি জীবনে এই প্রথম কোন মরার বাড়ীতে পাশের ঘরে মরা রেখে ডিমের কোর্মা ও মোরগের মাংস দিয়ে ভাত খেলো। এমন সুস্বাদু রান্না হয়েছে যে, নিমেষেই দুজনের পাত চেটেপুটে পরিষ্কার। পঞ্চম জামাতা লোকটা বেশ বুদ্ধিমান, সেই রাতে সে আর "নতুন ঘরে"  ফিরে আসে নি।
 
কুয়াশার মাঝে পাঁচমাইল পায়ে হাঁটার পর দুই মাইল রিক্সাযোগে ফুলপুর ফিরে আসলে তাহের ডাক্তার ছত্রপতির পকেটে একটি একশত টাকার নোট জোরে গুঁজে দিয়ে বললো, "ওরা ভিজিট দিয়েছে"।
টাকাটা যে তাহের ডাক্তারের নিজের পকেটের,  সে ব্যাপারে ছত্রপতির কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি স্নেহ মিশ্রিত সম্ভাব্য বকার ভয়ে ও নির্ঘুম রাতের দীর্ঘ সাহচর্যে, স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধায় ছত্রপতি আর কোন প্রশ্ন করে নি।