সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি শামসুদ্দোহা খন্দকারের স্ত্রী ফেরদৌসি সুলতানার ব্যাংকে ৪১ কোটি টাকা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া শামসুদ্দোহার অ্যাকাউন্টে পাওয়া গেছে ২১ কোটি টাকা। এসব টাকা অপরাধ লব্দ বলে দুদক অভিযোগ পত্র দিয়েছে আদালতে।
দুদক ২০১৮ সালে তাদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধান শেষে জ্ঞাত আয়–বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় মামলা করে ২০১৯ সালে। তাদের ‘অপরাধলব্ধ’ আয়ের পরিমাণ ৬২ কোটি টাকা। শামসুদ্দোহার চেয়ে তাঁর স্ত্রীর অপরাধলব্ধ আয় বেশি, পরিমাণ ৪১ কোটি টাকা। শামসুদ্দোহার অপরাধলব্ধ আয় ২১ কোটি টাকা।
জ্ঞাত আয়–বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে এই দুজনের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাতে অপরাধলব্ধ আয়ের এই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, তাঁদের দুজনের ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হয়েছে। স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবেই জমা হয়েছে ৪১ কোটি টাকার বেশি।
২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা শামসুদ্দোহা ও তাঁর স্ত্রীর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধান শেষে জ্ঞাত আয়–বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে মামলা করে দুদক। পাঁচ বছর তদন্ত শেষে মঙ্গলবার ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে দুজনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।
অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অস্বীকার করে শামসুদ্দোহা মঙ্গলবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, দুদকের মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। তিনি জামিনে আছেন। তাঁরা বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবিলা করছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে।
অবশ্য অভিযোগপত্রে দুদক বলেছে, শামসুদ্দোহা সরকারি কর্মকর্তা থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির আশ্রয় নেন। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ আয়কে বৈধ করার পূর্বপরিকল্পনা করেন তিনি। তাঁর নিজের বেতন–ভাতা বাবদ আয়ের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ জমা হয় স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানার নামে খোলা বিভিন্ন ব্যাংকে হিসাবে (অ্যাকাউন্ট)। তাঁর স্ত্রী একজন গৃহিণী। তাঁর বেতন–ভাতার চেয়ে স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ৪১ কোটি ২৯ লাখ টাকা বেশি। আর শামসুদ্দোহার ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ২১ কোটি ৫ লাখ টাকা।
১৯৮৬ সালে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন শামসুদ্দোহা। ২০১১ সালে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতি পান। তাঁকে ২০১১ সালে প্রেষণে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় সরকার। দায়িত্ব পাওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ওঠে। এরপর ২০১৫ সালে তাঁকে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ৩ মার্চ তিনি পুলিশ বাহিনী থেকে অবসরে যান।
শামসুদ্দোহার তিনটি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ২৯ কোটি টাকা জমা হওয়ার তথ্য পেয়েছে দুদক। এর মধ্যে অবসরে যাওয়ার দুই মাস আগে (২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর) ঢাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকে হিসাব খোলেন শামসুদ্দোহা। ২০২২ সালের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ওই হিসাবে জমা হয় প্রায় ১৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
দুদক বলছে, একটি ব্যাংকের ঢাকার নবাবগঞ্জ শাখা থেকে শামসুদ্দোহা ও তাঁর স্ত্রীর যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান অর্গানিক অ্যাগ্রো ফার্মসের নামে ৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামো তৈরির কাজে ব্যয় করা হয় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। বাকি অর্থ তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।
অর্গানিক অ্যাগ্রো ফার্মস নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব না পাওয়ার তথ্য আদালতকে জানিয়েছে দুদক। তারা বলেছে, ২০১২ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত শামসুদ্দোহার ব্যাংক হিসাবে ঋণের অর্থ বাদ দিয়ে লেনদেনের পরিমাণ ২১ কোটি টাকার কিছু বেশি। দুদকের অভিযোগপত্র বলা হয়েছে, এই লেনদেন একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর বেতন-ভাতাদির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ব্যাংক হিসাবে এই লেনদেনের অর্থের উৎসের সপক্ষে দুদকে তিনি কোনো প্রমাণ জমা দেননি।
এদিকে শামসুদ্দোহা ঢাকার গুলশানের ১৩৫ নম্বর সড়কে একটি সরকারি বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছেন। সাত দিনের মধ্যে বাড়িটি ছাড়ার জন্য তাঁকে গত ১৫ মে নোটিশ দেয় সরকারি আবাসন পরিদপ্তর। কিন্তু আবাসন পরিদপ্তর সূত্র বলছে, তিনি বাড়িটি ছাড়েননি।
স্ত্রীর হিসাবে ৪১ কোটি টাকা
দুদকের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, শামসুদ্দোহার স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানার আয়ের কোনো উৎস নেই। অথচ তাঁর ছয়টি ব্যাংক হিসাবে ৪১ কোটি ২৯ লাখ টাকা জমা হওয়ার তথ্য–প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁর নামে ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর একটি বেসরকারি ব্যাংকে হিসাব খোলা হয়। ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত শুধু ওই হিসাবে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০১২-১৩ থেকে ২০১৯-২০ করবর্ষ পর্যন্ত আয়কর নথিতে ফেরদৌসী সুলতানা যে হিসাব উল্লেখ করেছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
শামসুদ্দোহা ও ফেরদৌসীর চার সন্তান। দুদক বলছে, সন্তানদের তাঁরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়িয়েছেন। তিনজনকে পড়িয়েছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়। সন্তানদের পড়াশোনা এবং সংসারের ব্যয় মিটিয়ে শামসুদ্দোহা ও তাঁর স্ত্রী যে সম্পদ অর্জন করেছেন, তা জ্ঞাত আয়–বহির্ভূত।
ফেরদৌসী দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে সম্পদের উৎস হিসেবে স্বামীর দেশে-বিদেশে চাকরি, যুক্তরাজ্যে নিজের তিন বছরের চাকরি, কৃষি খামার ও ব্যবসার আয় এবং মায়ের দান, জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রির কথা উল্লেখ করেন। তবে দুদক আদালতে জানিয়েছে, এই উৎসগুলোর সপক্ষে ফেরদৌসী প্রমাণপত্র জমা দেননি। শামসুদ্দোহার কাছ থেকেও প্রমাণপত্র পাওয়া যায়নি।
দুদক আদালতকে জানিয়েছে, প্রমাণপত্র জমা দেওয়ার জন্য শামসুদ্দোহা ও ফেরদৌসীকে কয়েদ দফা নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা কোনো বক্তব্য দেননি, নথিপত্রও জমা দেননি। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ফেরদৌসীর ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন তাঁর স্বামী শামসুদ্দোহার অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বলে পরিলক্ষিত হয়।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মীর আহমেদ আলী সালাম প্রথম আলোকে বলেন, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার একজন সরকারি চাকরিজীবী ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে বিপুল অর্থের লেনদেনের ঘটনা অস্বাভাবিক। দুদক অভিযোগ প্রমাণের জন্য তথ্য–প্রমাণ আদালতে জমা দিয়েছে।