logo
আপডেট : ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১২:৩০
৩ আগস্ট ছাত্র আন্দোলন
যা দেখলাাম তা জীবনে ভুলবার নয়
ওমর ফারুক

যা দেখলাাম তা জীবনে ভুলবার নয়

৩ আগস্ট ২০২৪। ছাত্র জনতার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু করে শাহবাগ মোড়,জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকায় হাজার হাজার ছাত্র জনতা নামে রাজপথে। সাংবাদিক হিসেবে আমার আগ্রহ তখন গুলিস্তান এলাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামীলীগ-যুবলীগের অফিসের সামনের অবস্থা দেখার। দুপুর ২ টার দিকে গেলাম আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। গিয়ে দেখি ২-৩ শ নেতা কর্মী লাঠি সোটা নিয়ে উত্তেজিত অবস্থায় রয়েছেন। আওয়ামীলীগ নেতা আবু আহম্মেদ মান্নাফী একটি চেয়ার পেতে বসে আছেন। তাকে ঘিরে আছেন কয়েকজন। তারা স্লোগান দিচ্ছিলেন- শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই। 

কিছুক্ষণ পর লাঠি হাতে যুবলীগের নেতা পর্যায়ের একজন এসে সবাইকে মিছিলে যোগ দিতে বললেন। তিনি জানালেন মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে যাবেন। সঙ্গে সঙ্গে ৭০-৮০ জন লোক মিছিল শুরু করলেন। স্লোগান দিতে শুরু করলেন- আমি কে তুমি কে- বাঙালি বাঙালি। পরের স্লোগান শোনার জন্য অধীর আগ্রহ আমার। কারণ তখন ছাত্রদের স্লোগান- আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার,  কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার'- ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শুনতে চাচ্ছিলাম বাঙালি বাঙালির পর তারা কি বলে। কিন্তু না তারা শুধু বাঙালি বাঙালি বলেই এগুতে থাকলেন। মিছিলটি কার্যালয়ের সামনে থেকে সচিবালয়ের দিকের প্রধান সড়কে উঠতেই আরো ৫০-৬০ জন লাঠি সোটা নিয়ে যোগ দিলেন। সবার চোখে মুখে আক্রমনাত্মক একটা ভাব। আমি মিছিলের সঙ্গে থেকে মোবাইল ফোনে ভিডিও করতে থাকলাম। মনে মনে ভয় হচ্ছিল এই মিছিল শহীদ মিনারের সামনে গেলে যে সংঘর্ষটা হবে তাতে কতজন শহীদ হন তাই নিয়ে। নিজের জীবনও চলে যেতে পারে। তবুও ইতিহাসের সাক্ষী হতে মিছিলটির সঙ্গে যাওয়া শুরু করি। 
মিছলটি কিছুক্ষনের মধ্যেই জিপিওর পাশে নূর হোসেন স্কয়ারের এখানে গিয়ে শহীদ মিনার অভিমুখী না হয়ে ঘুরে যায়। ঘুরে গিয়ে কিছু লোক কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে চলে যান। আর কিছু লাঠি সোটা নিয় নূর হোসেন স্কয়ার ও সচিবালয়ের মাঝামাঝি রাস্তায় অবস্থান নেন। এ সময় পাশেই সচিবালয়ের দেয়াল ঘেষে শতাধিক পুলিশ সদস্যকে বসে থাকতে দেখা যায়। সেখােন অফিসারও ছিলেন কয়েক জন। 
দুপুর পৌনে তিনটার দিকে সচিবালয়ের সামনের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে একটি রিক্সায় করে ১৪-১৫ বছর বয়সী এক কিশোর গুলিস্তানের দিকে যেতে থাকে। তার মাথায় বাংলাদেশের পতাকা বাধা। এতো সুন্দর চেহারা দূর থেকে দেখে রাজপুত্তর মনে হচ্ছিল। রিক্সাটি সচিবালয় পেরুতেই লাঠি হাতে কয়েকজন যুবলীগ নেতা -কর্মী রিক্সাটি আটকে দেয়। একজন ওই কিশোরকে জিজ্ঞেস করেন
-কোত্থেকে আইছিস? কিশোর প্রশ্ন কর্তার দিক না তাকিয়েই জবাব দেয়
-শহীদ মিনার থেকে। বলার সঙ্গে সঙ্গে একজন তার মাথায় থাকা বাংলাদেশের পতাকা ছো মেরে নিয়ে নেয়। কিশোর তার দিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করেনি। সে নির্ভয়ে অপলক সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। 
ওই সময় কয়েকজনের লাঠি উঠে যায় কিশোরের মাথার উপর। ছেলেটিকে মেরে ফেলার প্রস্তুতি তাদের। আমি কেঁপে উঠলাম। কিন্তু কিশোরটি নির্বিকার। 
একজন বললেন-
- ওই তাকায়া দেখতাছস কি ওরে মাইরা ফালা। আন্দোলন থাইকা আইছে। ওইহানে নাকি ওরা  স্লোগান দিচ্ছে আওমীলীগ গেল কই। মার এরে তাইলে বুঝবো আওমীলীগ মাঠে আছে। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে দু'তিনজনের লাঠি কিশোরের মাথায় আঘাত করার জন্য উদ্যত হয়। ঠিক ওই সময় আমিসহ ৩-৪ জন বাধা দেই।  আমি তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিই নিজে আঘাত পেলেও চেষ্টা করবো কিশোরটিকে বাঁচানোর। চােখের সামনে এমন একটি কিশোর মারা যাবে ভাবা যায় না। আমি কে আন্দােলনকারীরা হয়তো চিনতে পারছিল না। আমাকে হয়তো তারা তাদেরই লোক মনে করেছিল। আমি একজনের লাঠি ধরে ফেললাম ওই লাঠির উপর মুহূর্তে কয়কেটি লাঠির আঘাত। একটা ভয়ঙ্কর পরিবেশ তৈরি হলো। ওই অবস্থায়ও আমি কিশোরটির দিকে তাকালাম। সে আগের মতোই নির্ভয়ে বসে রইলো রিক্সার সিটে। তাকে না মারার জন্য কাউকে একটি বারের জন্যও অনুরোধ করেনি। আমি তখন ভাবছিলাম -কোথা থেকে এতো সাহস পেল এই কিশোর। সে জানে রাজধানীতে একের পর এক ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটছে। তাকেও মেরে ফেলা হচ্ছে। এ অবস্থায় কেউ এমন সাহসী হতে পারে! ভেবে অবাক হলাম। মনে হলো রিক্সার সিটে কিশোরকে নয় পুরো বাংলাদেশকে বসে থাকতে দেখছি। 
এই যখন অবস্থা ঠিক তখন কয়েকজন পুলিশ সদস্য সেখানে চলে আসেন। অফিসার পর্যায়ের একজন বলেন
-কি হচ্ছে এখানে। রিক্সা যেতে দেন।  তখন যুবলীগের নেতা পর্যায়ের একজন বলেন-
-না ওরে যেতে দেবাে না। আমাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এসেছে। ওরে মেরে ফলবো আমরা। রিক্সা চালক অসহায়ের মতো পেছনে তার যাত্রী কিশোরকে দেখছিলেন। কিন্তু কিশোর যে রাগ হচ্ছে তা তার এক্সপ্রেশন দেখে বুঝা যাচ্ছিল। কিন্তু সে কারো দিকে না তাকিয়ে যেন মৃতর প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
এবার পুলিশ কর্মকর্তা ক্ষ্যাপে গেলেন-
-রিক্সা ছাড়েন। এতো পারেন শাহাবাগ যান। এখানে মাস্তানি করছেন কেন। আমাদের সামনে কাউকে মারতে পারবেন না। এ সময় আরো ক;জন পুলিশ সদস্য চলে আসেন ঘটনা স্থলে। অফিসার পেছন থেকে রিক্সাকে ধাক্কা দিয়ে বলে
- এই যা। 
রিক্সা চালক কাঁপতে কাঁপতে রিক্সা সামনের দিকে টান দেয়। কিছুটা দূরে যেথেই রিক্সার হুডের উপর একের পর এক লাঠির আঘাত। তখনও নির্বিকার ওই কিশোর। কিছুক্ষনের মধ্যেই রিক্সাটি নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। পেছনে তাকিয়ে ভাবছিলাম -এ আমি কি দেখলাম। এতো জীবনে ভুলার নয়। এই তো সেই কিশোর যাকে উদ্দেশ্যে করে বঙ্গবন্ধু বলে গিয়েছিলেন- ধাবায়া রাখতে পারবা না।