ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের। সেসময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর নানা ইস্যু তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে হয়ে গেল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। হাসিনার সরকারের যখন পতন ঘটে তখন হোয়াইট হাউসে ছিলেন জো বাইডেন। এবার নির্বাচনে জিতে হোয়াইট হাউসে উঠতে চলেছেন রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প। হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকে আছেন দিল্লির আশ্রয়ে। মার্কিন মুলুকে ক্ষমতার পালাবাদল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কি কোন প্রভাব ফেলবে? তৈরি হবে নতুন কোনো সমীকরণ? কোন পথে হাঁটবে প্রতিবেশী দুই দেশ?
এমন প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমন কল্যাণ লাহিড়ী বলছেন, বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি আমরা চাই না। আবার বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশের অবনতি হোক সেটাও আমরা চাই না। বলতে পারি ট্রাম্প আসার ফলে বাংলাদেশে স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে এবং আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের যে ব্যবস্থা তা পুনর্বহাল হবে। দ্রুত নির্বাচনের পথে হাঁটতে হবে বাংলাদেশকে। তবেই ফিরবে স্থিতাবস্থা। সম্ভবত আগামী মে জুন মাসে হতে পারে নির্বাচন।
শেখ হাসিনার দেশে ফেরার বিষয়ে ইমন কল্যাণ লাহিড়ী বলেন, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় হাসিনার দেশে ফেরা উচিত। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কেন দেশ ছেড়ে পালাতে হবে? অস্বীকার করার প্রশ্নই আসে না যে, তার আমলে চরম দুর্নীতি হয়েছে। নেতা-মন্ত্রী থেকে একজন নিচুতলার সরকারি কর্মী বা তৃণমূল স্তরের নেতা—সবাই জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করেছে। দেশের অর্থনীতি তার আমলেই নড়বড়ে হয়েছে। হয় হাসিনা জেনেবুঝে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে এসবে ইন্ধন দিয়েছেন, নচেৎ তাকে সামনে রেখে তার দলের নেতাদের একাংশ লুট করেছেন।
ইমন কল্যাণ লাহিড়ী বলেন, আমি মনে করি, দুই ক্ষেত্রেই অতীত সরকারের কর্মকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত হতে পারে, ট্রাইব্যুনাল হতে পারে, তিনি পদত্যাগ করতে পারেন। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কখনোই দেশ ছেড়ে পালানো উচিত নয়। ভারতবর্ষে কোনোদিন শুনেছেন, কোনো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সে দেশ ছেড়ে পালালো?
তিনি এও বলেন, প্রথমত সুষ্ঠু বাংলাদেশ গড়তে হলে নির্বাচন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমেরিকার সহযোগিতা থাকবে। প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি জোট করে সরকার গঠন করতে পারে। আবার পৃথকভাবে ভোটের ময়দানে নামতে পারে। তবে একটা সরকার যতদিন না তৈরি হবে সুষ্ঠু বাংলাদেশ গড়ে উঠবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অত্যন্ত বিদগ্ধ ও পণ্ডিত মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করে ইমন কল্যাণ বলেন, তার উচিত দ্রুত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা। আমরা ভারতীয় বাঙালিরা সব সময় চাই বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্ক থাক। স্বাধীনতার আগে ও পরে এই দুই দেশের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। দুই বাংলার মানুষ একসঙ্গে অনেক আন্দোলন করেছে। বাঙালি হিসেবে আমরা চাইবো দুই দেশের মধ্যে যেন একটা সুসম্পর্ক বজায় থাকে। একটা সরকার গঠন না হলে কখনোই দুই দেশের সম্পর্ক সচল হতে পারে না।
এ বিষয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আরেক অধ্যাপক ও বিশ্লেষক ড. কনক সরকারের অভিমত, ট্রাম্পের জয় ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবাই জানে ট্রাম্পের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যথেষ্ট সখ্য রয়েছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশকে নতুন করে ট্রাম্পের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে হবে। নতুন একটা সমীকরণ গড়ে উঠতে পারে।
হাসিনা প্রসঙ্গে কনকের অভিমত, তার দেশে ফেরা বাস্তবে সম্ভব নয়। উনি পদত্যাগ করার সময় পাননি ঠিকই। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। ইতিহাস বলছে, একটা সময়ের শাসনামলে নেতা যখন পরিবর্তন হয় বা দেশ ছাড়ে, তখন তার শাসনের পতন ঘটে। তিনি দেশত্যাগ করেছেন, এটাই যথেষ্ট। তার লিখিত বিবৃতির প্রয়োজন পড়ে না। অতএব এক্ষেত্রে তিনি আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন। এখন নির্বাচনের মাধ্যমেই নতুন সরকার আসবে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সংকটময় হিসেবে উল্লেখ করে কনক বলেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবেই। আর এটাই ট্রাম্পের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ এবং তা ভারতের কাছেও।
আগামী নির্বাচনে কে ক্ষমতায় আসতে পারে? উত্তরে কনক বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিএনপির দিকে। তবে আওয়ামী লীগ বিরোধী আসন দখল করতে পারে। এর বাইরে কাউকে এখনই দেখছি না। এছাড়া এমন এক পরিস্থিতি হতে পারে যেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের যে উপদেষ্টারা রয়েছেন তাদের মধ্য থেকে কোনো নতুন মুখ উঠে আসতে পারেন। তাদের নেতৃত্বে নতুন কোনো রাজনৈতিক দল গঠন হয়ে সরকারের ক্ষমতায় আসতে পারে। কোনো কিছুই এখন অসম্ভব নয়। মনে রাখবেন, শেখ মুজিবুর রহমান একদিনে শেখ মুজিব হননি। তিনি ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা একজন। ফলে ছাত্র আন্দোলনকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার নেই। দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।