Main Logo
আপডেট : ১ মার্চ, ২০২২ ১০:২২

ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ

হামলার মধ্যেই আলোচনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

হামলার মধ্যেই আলোচনা

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভসহ বিভিন্ন শহরে হামলা অব্যাহত রেখেছেন রাশিয়ার সেনারা। এর মধ্যেই গতকাল সোমবার ইউক্রেন–বেলারুশ সীমান্তে আলোচনায় বসেছিলেন রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা। ইউক্রেন হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিল। তবে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়েছে। রাশিয়ার প্রতিনিধিদলের প্রধান ভ্লাদিমির মেদিনস্কি বলেছেন, আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে। তবে পরবর্তী আলোচনা কবে হবে, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

গতকাল পঞ্চম দিনের মতো কিয়েভ ছাড়াও ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চলীয় শহর চেরনিহিভ এবং উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় খারকিভে ক্ষেপণাস্ত্র, গোলা ও রকেট হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনী। এর মধ্যে স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার পর বেলারুশের গোমেলে আলোচনায় বসেন দুই দেশের নেতারা। বৈঠকে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকোভ ও উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী মিকোলা তোচিৎসকি অংশ নেন। 

অন্যদিকে রাশিয়ার উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী আলেকসান্দার ফোমিন এবং বেলারুশে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বোরিস গ্রিজলোভও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের আলোচনা সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াকের বরাত দিয়ে রুশ বার্তা সংস্থা আরআইএ জানিয়েছে, দুই দেশের প্রতিনিধিরা নিজ নিজ দেশের রাজধানীতে ফিরে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবেন। তার ভিত্তিতে দ্বিতীয় দফা বৈঠক হবে।

ইউক্রেনের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি এবং রাশিয়ার সেনা প্রত্যাহারের দাবি করা হচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গতকাল ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে টেলিফোন আলাপে তিনটি শর্তের কথা বলেছেন। সেগুলো হলো ক্রিমিয়া অঞ্চলের ওপর রাশিয়ার পূর্ণ সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি, ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ ও নাৎসিবাদের প্রভাব থেকে দূরে রাখা এবং দেশটির নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত করা।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্বাধীন দেশ হয় ইউক্রেন। ২০১৪ সালে বিক্ষোভের মুখে দেশটির রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হন। সে সময় ক্রিমিয়া দখলে নেয় রাশিয়া। ইউক্রেনের বর্তমান নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর সদস্য হতে চায়। সেখানে আপত্তি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের। তাঁর মতে, এটা হলে রাশিয়ার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়েছে রাশিয়ার আর্থিক খাতে। গতকাল দেশটির মুদ্রা রুবলের মান রেকর্ড ৩০ শতাংশ কমেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সুদহার বাড়িয়ে দ্বিগুণ (৯ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ) করেছে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার জেরে ইউরোপে গ্যাসের দাম বেড়েছে।

আলোচনার মধ্যেই হামলা

গতকাল সমঝোতা আলোচনা চলার মধ্যেই ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে রাশিয়ার রকেট হামলায় ১১ জন নিহত হন। এই যুদ্ধ বন্ধে দুই পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ইউক্রেন নিয়ে গতকাল নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশন বসে। সেখানে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, এখনই এই লড়াই বন্ধ করতে হবে। দিন–রাত রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান থেকে ফেলা বোমা ইউক্রেনের শহরগুলোকে ক্ষতবিক্ষত করছে। রাজধানী কিয়েভকে ঘিরে ফেলা হয়েছে এবং সবদিক থেকে সেখানে হামলা চালানো হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার রাশিয়া তিন দিক থেকে ইউক্রেনে হামলা করে। এরপর চার দিনে ৫ হাজার ৩০০ রুশ সেনা নিহত হয়েছে বলে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে। গতকাল প্রথম রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় লড়াইয়ে তাদের বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করেছে। তবে কতজন হতাহত হয়েছে, তা বলেনি। অন্যদিকে রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনে ১৪ শিশুসহ অন্তত ৩৫২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে বলে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। গতকাল রুশ বাহিনী ইউক্রেনের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় দুই শহর বারদিয়ানস্ক ও এনারহোদার দখলে নেওয়ার দাবি করেছে।

কিয়েভের অবস্থা

পঞ্চম দিনের মতো গতকাল সকালে কিয়েভে হামলা চালায় রুশ বাহিনী। শহরের কয়েকটি জায়গায় বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিয়েভের ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান নিয়েছে রাশিয়ার সেনাবহর। তাদের প্রতিরোধে ইউক্রেনের সেনাদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবীরা অস্ত্র হাতে শহরে পাহারা দিচ্ছেন।

এর মধ্যেই দুই দিন পর গতকাল সকালে কিয়েভে কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। এ সুযোগে শহরের পাতালরেলের সুরক্ষাকেন্দ্রসহ ভবনগুলোর মাটির নিচের তলা (বেসমেন্ট) থেকে বেরিয়ে প্রয়োজনীয় কেনাকাটাসহ অন্যান্য কাজ সারেন বাসিন্দারা। তাঁদের একজন কাসেনিয়া টানা ৩৬ ঘণ্টা পর ভূগর্ভস্থ সুরক্ষাকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত ঘরে ফিরতে পেরেছি। আমি খুব খুশি যে বেঁচে আছি, নিরাপদে আছি।’

রাশিয়ার হামলার মুখে ইউক্রেনের অন্যান্য শহরেও দুর্বিষহ সময় কাটছে মানুষের। খারকিভের বাসিন্দা দারিয়া সামোইলিক জানান, তিন দিন অনেকটা নির্ঘুম কাটিয়েছেন। প্রাণে বাঁচতে নিজেদের ভবনের বেসমেন্টে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, দিনরাত বিরতিহীনভাবে গোলাগুলি চলেছে। দারিয়া জানান, তাঁর পরিচিত অনেকে রাশিয়ায় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেখানে সবাই রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম থেকে খবর পাচ্ছেন। সেসব খবরে বলা হচ্ছে, ‘পুতিন আমাদের রক্ষা করছেন। তিনি কাদের কাছ থেকে আমাদের রক্ষা করছেন? কিসের থেকে রক্ষা করছেন? আমরা তা বুঝতে পারছি না। আমরা আমাদের দেশে শান্তিতে ছিলাম। কাউকে বলিনি আমাদের এসে উদ্ধার করুন।’

মানবিক সংকটের মুখে ইউরোপ

রাশিয়ার হামলার মুখে ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকেরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে থাকায় বড় ধরনের মানবিক সংকটের মুখে পড়েছে ইউরোপ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবিক সহায়তা ও জরুরি পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনাবিষয়ক হাইকমিশনার ইয়ানেস লেনারসিস এই সতর্কবার্তা দিয়েছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘অনেক অনেক বছর পর আমরা ইউরোপ মহাদেশে সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট দেখছি।’ জাতিসংঘের ধারণা, এই যুদ্ধে ইউক্রেনের ৭০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। ইয়ানেস লেনারসিস বলেন, যুদ্ধে ইউক্রেনের ১ কোটি ৮০ লাখের মতো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশ ছেড়ে শরণার্থী হওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখে পৌঁছাবে।

রাশিয়ার হামলা শুরুর পর ইতিমধ্যে ইউক্রেনের ৫ লাখের বেশি মানুষ পাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে বলে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে।

সূত্র : রয়টার্স

 
উপরে