অসময়ের যাত্রা
শাহেদ উন নবী
রাত দশটাও বেজেছে কি না সন্দেহ।রাস্তাগুলো এর মধ্যেই জনশূন্য হয়ে পড়েছে। আমি খুব সাবধানে বাসা
থেকে বের হলাম। গলির একেবারে মাথায় দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। একজনের হাতে একটা লাঠিও
দেখলাম মনে হয়। আমি একটু দমে গেলাম। ব্যাপারটা যত সোজা ভেবেছিলাম, ততো সোজা না দেখছি।
পুরো পরিকল্পনা সাজানোর পর অবশ্য পানির মতো সোজা লেগেছিল। জোড়াবাগান থেকে বেরিয়ে সোজা চলে
যাব বাগুইহাতি। সেখানে মণির লোকজন আছে। রাত বারোটার মধ্যে সেখানে পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকে
ট্রাকে করে সোজা বর্ডার। বর্ডার পার করানোর দায়িত্বও মণির লোকজনের। আমি যখনকার কথা বলছি,
তখন করোনার প্রকোপ কেবল শুরু হয়েছে। বর্ডার বন্ধের নির্দেশ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মণি বলেছে সেটা
ব্যাপার না। সেন্ট্রাল অর্ডার শাখা-প্রশাখা পেরিয়ে বর্ডারে পৌঁছাতেও সময় লাগে। ততোক্ষণে আমি ওপারে
পৌঁছে যাব।
করোনার কারণে অনেকদিন পর একটা লম্বা বন্ধ পেয়েছিলাম। নতুন পুরাতন মিলিয়ে অনেকগুলো বই জমা
হয়ে ছিল। এই বন্ধে সব শেষ করে ফেলব ভেবেছিলাম। দিন মোটামুটি ভালোই যাচ্ছিল। মেসের অন্যদের
সাথে দাবা, লুডু খেলতাম। সারাটা বিকাল ‘ভাইরাসের অরিজিন’ নিয়ে নানারকম কন্সপিরেসি খিওরি বের
হতো আমাদের মাথা থেকে। এমন সময় বাড়ি থেকে ফোন আসলো।
বাড়ি থেকে সাধারণত মা অথবা বাবাই ফোন করে। সেদিন প্রথমবার দাদু কল করল। দাদুকে যখন
শেষবার দেখেছিলাম, তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়তাম। দাদুর চেহারাটাও এখন ভালোমতো মনে নেই।
দাদু ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বলল তার অবস্থা খুব একটা ভালো না। যেকোনো দিন উপরের ডাক আসতে পারে।
শেষবেলায় তিনি আমার মুখটা একবার দেখে যেতে চান। এতোদিন আমাদের দুজনের দেখা না হওয়ার
কারণও আছে অবশ্য। বাবার সাথে অন্য চাচাদের জমি নিয়ে কিসব বিরোধ ছিল। ‘বিরোধ’ না ঠিক,
‘মনোমালিন্য’ যাকে বলে। এজন্যে অনেকদিন ধরে আমাদর দাদুবাড়িতে যাওয়া হয় না, বাবাই নিয়ে যেতে
চান না। এবার বাবাও যেহেতু সেখানে উপস্থিত, ব্যাপারটা বেশ গুরুতর বলেই মনে হচ্ছে। সমস্যা হলো
যেদিন দাদুর সাথে কথা হলো, সেদিন সকালেই করোনার জন্য বেশ জোরেসোরে প্রস্তুতি নেয়া শুরু হয়ে
গিয়েছে। বিকেল হতে হতেই সাদা ইউনিফর্মের পুলিশ দিয়ে কলকাতার অলিগলি ভরে গেল। অকারণে (এবং
তুচ্ছ কারণে) বাইরে বের হওয়া নিষেধ। আমি দু তিনবার বের হবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। ঘর অন্ধকার
করে বসে থাকলাম।
এই অবরুদ্ধ সময়ে মণি আমাকে ‘পথ’ দেখালো। মণিচরণ আমাদের মেসের নিচতলায় থাকে। মোটামুটি
মাস্তান টাইপের ছেলে, পুরো বাসায় আমি ছাড়া কারো সাথে তার তেমন সখ্যতা নেই। আমার সাথে
মোটামুটি পরিচয় থাকায় আমার ওপর কৃতজ্ঞ সে, বিপদে-আপদে দেখা দেয়। বাংলাদেশে যাওয়ার কথা শুনে
বলল, ‘ধুর দাদা! এটা কোনো চিন্তার বিষয় হলো নাকি? তুড়ি মেরে ওপাশে পাঠিয়ে দোব।’ আধা ঘন্টা
ধরে এখানে ওখানে ফোন করল মণি, তারপর আমাকে রাস্তাটা বুঝিয়ে বলল। মালবাহী যানবাহন এখনো
পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, সেরকম একটায় উঠে বর্ডার পার হতে হবে।
অভিযানের গোড়ায়ই গলদ লেগে গেল। পুলিশ দুজনকে বললাম ঔষধ কিনতে বেরিয়েছি। ফলস্বরূপ আমি
এখন একজনের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছি, আরেকজন পুলিশ গেছে ডায়রিয়ার ঔষধ আনতে। আমি ঘড়ির
দিকে তাকালাম। সময় বেশি নেই। মণি বলে দিয়েছে, ওর লোকজনের আজকেই শেষ ট্রিপ। পার হতে হলে
আজকেই হতে হবে। আরেকজন পুলিশ আসার আগেই আমি দৌড় লাগালাম। অন্য পুলিশটা হকচকিয়ে গেল।
অনেকক্ষণ পরে ছোটা শুরু করল ঠিকই, কিন্তু ধরতে আর পারলো না। স্বল্প দূরত্বের কোনো যানবাহন নেই
আশেপাশে। আমি হেঁটে-দৌঁড়ে কোনমতে বাগুইহাতি পৌঁছালাম। দূরত্বটা কম না, আমি হাঁপাতে লাগলাম।
ট্রাকটা খুঁজে পেতে অবশ্য সমস্যা হলো না। নির্জন রাস্তা, একটা মাত্র ট্রাকই দাঁড়িয়ে আছে, ইন্ডিকেটরগুলো
জ্বলছে। ট্রাকটা নিউট্রালে দেয়া ছিল। আমি উঠতেই স্টার্ট নিলো। আমি খোলা আকাশের নিচে গা এলিয়ে
দিলাম।
ট্রাকে আমি ছাড়াও আরো তিনজন। দুইজন সামনে থাকে, ট্রাক চালায়। এদের মধ্যে একজন বাঙালি।
আরেকজন আমার আশেপাশে থাকে। আমি মনে করেছিলাম এক দিনের মধ্যেই বর্ডার পেরিয়ে যাব। বাস্তবে
আড়াই দিনের মতো লেগে গেল। বাগুইহাতি থেকে বর্ডার বেশি দূরে না। কিন্তু ট্রাক এখানে দুই ঘন্টা থামে
তো ওখানে তিন ঘন্টা থামে। একদিন কিসব বাক্স উঠানোর জন্য পুরো দুপুর থেকে সন্ধ্যা একজায়গায়
দাঁড়িয়ে থাকল। এইসব ঝামেলা পেরিয়ে বাংলাদেশে পা দিলাম অবশেষে। ততোদিনে বাংলাদেশেও ‘ছুটি’ শুরু
হয়ে গেছে। বাস খুব কম, তবে চলছে। সমস্যা হলো প্রতিটা বাসেই ভিড়। ট্রাকে নাহয় একজনের কাছ থেকে
তিন-চার হাত দূরে দূরে থেকেছি, বাসে সেটা কিভাবে সম্ভব? মানুষজনকেও দেখলাম কেবলমাত্র সচেতন হতে
শুরু করেছে, সবার মধ্যে সেই সতর্ক ভাবটা নেই। একটা এসি বাসে চড়ে দাঁতে দাঁতে চেপে ঢাকায়
পৌঁছালাম কোনমতে।
ঢাকায় তো পৌঁছানো গেল। দ্বিতীয় কাজ হলো টাকাপয়সার ব্যবস্থা করা। ব্যাংক সব বন্ধ। কারেন্সি কনভার্ট
করার কোনো উপায় নেই। দুইটা কার্ড ছিল, সেগুলো একেবারে নি:স্ব করে ফেললাম। এই কয়দিনের ধকল
সামলানোর জন্য ভাবলাম দুইটা দিন একটু বিশ্রাম নিয়ে যাই। সেই বিশ্রাম করাটা আরেক কাল হলো। যেদিন
রাতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিব, সেদিনই আমাদের দুই বাড়ি পাশে একজনের করোনা পজিটিভ ধরা পড়ল।
ফল হিসেবে আশেপাশের সবগুলা বাড়ি লকডাউন করে দেয়া হল।
লকডাউন করা হলো ঠিকই, কিন্তু আমার বের হতে তেমন কোনো বেগ পেতে হলো না। পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে
রাতে এলাকা ছেড়ে পালালাম। পাশের এলাকায় কয়েকজন পরিচিত লোক ছিল, তাদের বাড়ি আমার গ্রামের
বাড়ির দিকেই। সবাই মিলে একটা বড়সড় বাস ভাড়া করেছে গ্রামে যাওয়ার জন্য। আমি শেষ মূহুর্তে গিয়ে
ড্রাইভারের সিটের পাশে জায়গা পেলাম। সবার গন্তব্য যেহেতু একই জায়গায়, তাই বাড়ি পৌঁছানোর আগে
খালি সিট আর পাওয়া যাবে না। আমি ড্রাইভারের পাশের ‘ইঞ্জিনের’ ওপর বসে ঝিমাতে লাগলাম।
সাধারণত ঢাকা থেকে আমাদের বাড়ি যেতে দশ-বারো ঘন্টার মতো লাগে। এবার আমার যাত্রাভাগ্যে শনির
দশা চলছে মনে হয়, ষোল ঘন্টা লেগে গেল। বাস থেকে নেমে বুঝতে পারলাম শরীরের উপর অনেক ধকল
গেছে। অবসন্ন লাগছে, জ্বর-টরও এসেছে বোধহয়। কাউন্টারটা বাজারের কাছে, এখান থেকে বাড়ি যেতে
আরো আধা ঘন্টার মত লাগবে। আমি একটা হোটেলের এক কোনায় গিয়ে বসলাম। কয়েকটামাত্র দোকানই
খোলা আছে। নাস্তা খেতে গিয়ে দেখলাম বিস্বাদ লাগছে। পিপাসাও পাচ্ছে প্রচুর। হঠাৎ বুকটা ধক করে
উঠল। ভাইরাসে ধরল নাকি?
আধাঘন্টা ধরে মোবাইলে ঘাটাঘাটি করলাম। সব লক্ষণই আমার সাথে মিলে গেল। অবশ্য সব লক্ষণই খুবই
কমন, যেকোনো সর্দিজ্বরের লক্ষণের সাথে মিলে যাবে, তা-ও মনটা খচখচ করতে লাগলো। মাস্ক পড়াই ছিল,
এই গরমের মধ্যে গ্লাভস পড়লাম। তারপর রিকশা না নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।
বাড়িতে ঢুকতেই বিশাল এক উঠান সামনে পড়ে, উঠানকে কেন্দ্র করে চারদিকে ঘর। আমি আঙিনায় এক
পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। টের পেলাম গলায়ও মৃদু ব্যাথা করছে, অস্বস্তি লাগছে। আঙিনায় চৌকিতে দাদু
হেলান দিয়ে শুয়ে আছে, পাশে মা-বাবা, কাকারা। সবাই বয়ষ্ক। আমি কোন সাহসে ভিতরে যাই? যদি
আমার জন্য কারো কিছু হয়ে যায়?
দাদু আমাকে ততোক্ষণে দেখতে পেয়েছে। ক্ষীণ স্বরে ডাকল, ‘ভাই আনিস, এসেছিস তুই! ভিতরে আয়
দাদুভাই।’ সবাই আমার দিকে ফিরে তাকালো।
আমি ভিতরে পা দিলাম না। বললাম, ‘হ্যাঁ দাদু, আমি এসেছি।’ বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওরাও
আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। কোনো কথা বলছে না কেউ। আমার মনে হলো অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে
আছি, চারপাশে অদ্ভুত নি:স্তদ্ধতা।
মহামারির নি:স্তদ্ধতা তাহলে এরকমও হয়?